সংশয় শঙ্কার কঠোর লকডাউন
কাল সারাদিন গেছে সংশয়, শঙ্কায়। লকডাউন আসলে কতোটা কার্যকরী হবে এ নিয়ে অনেকের যেমন ছিল সংশয়, অনেকের মনে ছিল ভয়! বিকাল থেকেই রাস্তাঘাটে গাড়ি ও লোক চলাচল কমে আসছিল। কেমন একটা থমথমে পরিবেশ! যারা দূরে যাবার, দ্রুত চলে যাবার ব্যবস্থা করছিলেন আগের দিন থেকেই। অনেকে সপ্তাহের, কেউ-বা মাসের সব বাজার করে রাখছিলেন। লকডাউন আবার কবে শেষ হয়- এই ভেবে অনেকে ঈদের কেনাকাটা পর্যন্ত করছিলেন। মার্কেটগুলোতে প্রায় সারাদিনই ছিল ভিড়। যেন কোনো ছোঁয়াচে রোগের কারণে নয়, এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবার ভিড় বাঁচিয়ে আগামী সাতদিন ঘরে থাকলেই আপনি বেঁচে যাবেন।
যতটা সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত ছিল, মানুষ তারচেয়ে বেশি পেয়েছে ভয়। সেই ভয় যতটা না করোনার কারণে, তার চেয়ে সরকারের কঠোর হুঁশিয়ারেই ছিল এর কারণ। যদিও অনেকের মনে সংশয় ছিল লকডাউন সত্যিই কতোটা কার্যকরী হবে তা নিয়ে। সরকারী ঘোষণার মধ্যেও ছিল নানারকম দ্বিধা। ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে কিনা এ নিয়ে সারাদিন সংশয়ে ভুগেছেন ব্যাংকের কর্মকর্তারা। প্রথমে জানা গেল, শুধু বন্দর ও শিল্প এলাকার ব্যাংকের শাখাগুলো খোলা থাকবে। রাতেই টেলিভিশনের খবরে জানানো হলো ১৪ এপ্রিল থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ছুটির দিন ছাড়া সব ব্যাংক সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১.৩০ মিনিট পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপর ব্যংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শুরু হলো একে অপরকে ফোন করা। কীভাবে, কী করবেন তারা নিজেরাও বুঝতে পারছিলেন না। গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকলে সকাল নয়টায় তারা অফিসে যাবেন কী করে? সবার তো নিজের গাড়ি নেই। সবাইকে সব অফিস গাড়িও দেয় না। তাহলে?
এর মধ্যে রাতেই অনেকের শুরু হলো আরেক শঙ্কা। টেলিভিশনেই খবরে দেখানো হলো রাস্তায় বেরোতে হলে জরুরি পাস লাগবে। সেই পাস যোগাড় করতে হবে বিশেষ অ্যাপ থেকে। সেই অ্যাপ কেউ খুঁজে পায় না। ফেসবুকে মানুষ স্ট্যাটাস দিতে শুরু করলো- সেই অ্যাপ এখন পাই কই? আমার তো কিছু ডাউনলোড হয় না! যাদের অ্যাপ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের কী অবস্থা হবে? সবার সেরকম মোবাইল সেটও নেই, সবার মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগও থাকে না। তাহলে?
তার ওপর আজ প্রথম রোজা, বাংলা নববর্ষ। নববর্ষের কথা বাদ। উৎসবের আমেজ ও মেজাজ আর নাই বাঙালির ঘরে। প্রতি মুহূর্তে এখন জীবন নিয়ে টানাটানি। সামনে আসছে ঈদ, এর মধ্যে শুরু হয়েছে লকডাউন। করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে, সামনে কী হবে কেউ বলতে পারে না।
আজ মৃত্যু ৯৬। কাল শত ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। হাসপাতালগুলো এখন সিরিয়াস রোগীও রাখতে পারছে না। ডাক্তাররা বলছেন, সরকার যদি আরো কঠোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না যায় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবকিছুই হতে হবে সুপরিকল্পিত। তা না-হলে হবে হীতে-বিপরীত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যেন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়।
অনেক কাপড়ের দোকানদার সারাবছর তাকিয়ে ছিলেন এবার ঈদ লক্ষ্য করে। গত বছর ঈদে বেচাবিক্রি হয়নি, হয়নি সারা বছর ধরেই। ভেবেছিলেন এবার বোধহয় পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হবে। একেবারে ঈদ ও নববর্ষের মুখে মুখেই আবার সেই ভয়াল পরিস্থিতি। অনেকের পাঁচ-ছয়মাসের বাসাভাড়া বাকি পড়েছে। বাড়িওয়ালাকে বুঝিয়েছেন এবার ঈদে বেচাবিক্রি করে সব দেনা শোধ করে দেবেন। বাকি পড়েছে অনেকের মুদি দোকানে। অনেক অফিসে বেতন বন্ধ। অর্থনীতির চাকা কারো একার ওপর নির্ভর করে না, একজনের সঙ্গে আরেকজন এখানে সুতোর মতো জড়ানো। হঠাৎ এই স্থবিরতা সামগ্রিক পরিস্থিতির মধ্যেই একটা ধস নামিয়ে দিলো।
কিন্তু সব আবার অতি শীঘ্রই বন্ধ না করে দিলেও হচ্ছিল না। প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাও অনেকে লকডাউন মানতে চাচ্ছে না। কারণ করোনায় না মারা গেলেও অনেকের না খেয়ে মরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকারি সাহায্য-সহযোগিতাও এবার অনেকে পাচ্ছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, এবার সবকিছু কেমন যেন হুটহাট, দ্বিধায় জড়ানো। সরকারি কঠোর নির্দেশ যে কতোটুকু পালন হবে তা নিয়েও যেমন অনেকের সংশয়, তেমনি আসলেই পরিস্থিতি কোন দিকে যায় তা নিয়েও অনেকের ভয় রয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) সব ইউনিট প্রধানকে নির্দেশনা দিয়েছেন করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারি বিধিনিষেধ কঠোরভাবে পালনের জন্য। রাস্তাভর্তি পুলিশ। রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো খা খা করছে। সত্যিই মানুষজন নেই। এর মধ্যে রিকশা-ভ্যানে অনেকে রোগী নিয়ে হাসপাতাল ছুটছেন। কেউ-বা জরুরি কাজে কোথাও যাচ্ছেন। সন্দেহ হলেই পুলিশ ধরছে। উপযুক্ত কারণ বলতে পারলে ছেড়েও দিচ্ছে। তবে, পরিস্থিতি আসলেই কঠোর। অনেকে যেমন ফেসবুকে ফান করছিলেন ‘এবার কঠিন লকডাউন’, তারপর ‘বিশ্বাস করেন এবার কিন্তু চরম কঠিন লকডাউন’, ব্যাপারটা আসলেই তাই।
গত সপ্তাহে ‘লকডাউন’ বলার পরও সরকার যেমন কিছুটা ছাড় দিয়েছে এবার তেমন ছাড় নেই। ছাড় দেওয়া উচিতও নয়। কঠিন কঠোর লকডাউনই চলছে। যদিও তার মধ্যেই লোকজন আস্তে-ধীরে বেরোতে শুরু করেছে। দুপুর থেকেই গলিগুলোতে ভিড় বাড়ছে। বিকেলে ইফতারির দোকানগুলোতেও দেখা গেছে ভিড়। অনেকে এমনও বলছে- প্রথম দিনটা বোধহয় একটু কঠোরই যাবে। দুদিন পর নিশ্চয়ই সব আগের মতো হয়ে যাবে। সত্যি বলতে, কথাটা অমূলক নয়। কারণ আজ ছিল ছুটির দিন। কাল তো ছুটি নয়। অফিস, শিল্প-কারখানায় যেতে হবে। চাকরিজীবীকে ঘর থেকে তখন বের হতেই হবে। সবার তো গাড়ি নেই। সব অফিস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাড়ি দেয়ও না। সুতরাং কালই বোঝা যাকে ‘লকডাউন’ কতটা কঠোর হচ্ছে? মানুষ কতটা মানছে এই লকডাউন?
তবে এটা আমাদের মানতেই হবে- সরকারকে দোষারোপ করে লাভ নেই। আজও মৃতের সংখ্যা ৯৬। সাবধান আর কবে হবেন? জনগণ বুঝতে না পারলে রাষ্ট্র একা এই বিপর্যয় সামাল দিতে পারবে না। অতএব চোর-পুলিশ খেলে যে করোনা ঠেকানো যাবে না এটা আমাদেরই আগে বুঝতে হবে। এবং লকডাউন কতোটা কঠোর হলো বা না-হলো এই ভরসায় না থেকে নিজেকেই কঠোরভাবে নির্দেশ দিতে হবে- না, বিনা কাজে এক মুহূর্তও আর ঘরের বাইরে নয়।
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন