ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কে মহাফাটল

জোবাইদা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৪২, ২৯ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৭:০০, ২৯ জানুয়ারি ২০২২
শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কে মহাফাটল

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন প্রায় দুই সপ্তাহ অতিক্রম করেছে। আন্দোলন শুধু যে শাবিপ্রবিতেই সীমাবদ্ধ আছে তা নয়, এটি ডালপালা মেলে পুরো বাংলাদেশকেই কোনো না-কোনোভাবে আন্দোলনের সঙ্গে একীভূত করেছে।

এই দুই সপ্তাহে ঘটেছে নানা ঘটনা। আমরা জানি, আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত হয়েছিল শাবিপ্রবির নারী শিক্ষার্থীদের একটি হল থেকে। শুরুতে শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল তিন দফা। সেই নড়েচড়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে প্রথমে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের বাধা এবং পরবর্তীকালে পুলিশের টিয়ার শেল এবং সাউন্ড গ্রেনেড হামলা; আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা- সবই শিক্ষার্থীদের পক্ষে  গিয়েছে। এবং এর বিপরীতে জনরোষ ধীরে ধীরে প্রশাসনের বিরুদ্ধে যায়।

আরেকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীদের প্রতি শাবিপ্রবি উপাচার্যের একটি নারী-বিদ্বেষী বক্তব্যের রেকর্ড ফাঁস হওয়ার পর পরিস্থিতি আরেকটু ঘোলাটে হয়। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তখন থেকে একদফা দাবিতে পরিণত হয় এবং সেটি হয়ে পড়ে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবির আন্দোলন। মশাল মিছিল, প্রতিবাদী মিছিল ছাপিয়ে সেটি গড়ায় আমরণ অনশনে।

চলতে থাকে অনড়তা। শিক্ষার্থীরা অনড় তাদের দাবি নিয়ে, অন্যদিকে উপাচার্যও অনড়। তিনি বলে দিলেন- সরকার না চাইলে পদত্যাগ করবেন না। শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করলেও সেটি ফলপ্রসু হয়নি। সংসদে এ নিয়ে আলোড়ন ওঠে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমানের কিংবা দুর্বল করতে বেছে নেওয়া হয় গ্রেফতারের হুমকি। এই আন্দোলনে চাঁদা দেওয়ার অভিযোগে আটক করা হয় শাবিপ্রবির পাঁচ সাবেক শিক্ষার্থীকে। শেষমেষ অনশন ভঙ্গ হয় সেই বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক জাফর ইকবালের হস্তক্ষেপে। সরকারের প্রতিনিধি হয়েই তিনি সেখানে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙ্গাতে গিয়েছিলেন। সেই চেষ্টা সফল হয়, তবে দাবি পূরণের আশ্বাসে। তবে এখনও সমস্যা পুরোপুরি মেটেনি।

শাবিপ্রবির সাম্প্রতিক গড়ে ওঠা আন্দোলন অনেকগুলো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত আলোচনার দাবি রাখে: বেশ কয়েক বছর থেকেই বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গড়ে ওঠা প্রতিবাদ,  প্রতিরোধকে দমানোর সংস্কৃতি। পাঠক লক্ষ্য করুন, সেই একই কৌশল ব্যবহার করছেন সব উপাচার্য। শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়ার বিপরীতে গিয়ে প্রথমেই সেই আন্দোলন দমানের চেষ্টা করা হয় ক্ষামতাসীন সংগঠনকে কাজে লাগিয়ে। ফলে প্রথম দফায় এই হামলা আরও প্রতিবাদের আগুনে তুষ ছিটিয়ে দেয়। এরপরও যখন আন্দোলন চলতে থাকে তখন এর চেয়ে বড় কৌশল ব্যবহার করা হয়; আর তা হলো পুলিশী হামলা। 

খুব স্বাভাবিক যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে যখন পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়, তখন যে কোনো প্রশাসনের জন্য সেটি হিতে বিপরীত হয়। এবং এর পেছনে যত কাহিনি কিংবা রাজনীতি থাকুক না কেন তার দায় এসে পড়ে উপাচার্যের ওপর। 

তৃতীয়ত: শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার সংস্কৃতি হালের সংস্কৃতি। এর মধ্য দিয়ে ভয়ের সংস্কৃতি জারি রেখে প্রতিবাদের সংস্কৃতিকে নিরুৎসাহিত করার  চেষ্টা চলে।

শাবিপ্রবির এই চিত্র হয়তো বাংলাদেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই। বর্তমানে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৬টি। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য আর রেজিস্ট্রার মিলে এখানে প্রশাসনিক পদ প্রায় দেড়শোর বেশি। এই পদগুলো পেতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থী শিক্ষকরা বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন নানামুখী তদবিরে। ফলে যখনই তারা নিয়োগ পান, তখনই তাদের কাজ হয়ে পড়ে সরকারকে খুশি রাখা। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেখানে শিক্ষার্থীরা মনোযোগ পায় না, যতোটা পায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। অনেক সময় উপাচার্য নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পরামর্শ নেন। ফলে কাঠামোগতভাবেই উপাচার্যদের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দূরত্ব তৈরি হয়। সেই দূরত্ব ঘোচানোর দায়িত্ব উপাচার্যদের। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা সেগুলো আমলে নেন না। 

উপাচার্যরা বেশিরভাগ সময়ই ভুলে যান তাদের প্রথম পরিচয় শিক্ষক। কিন্তু তারা হয়ে ওঠেন প্রশাসক। যে কারণে ক্ষমতা চর্চাটাই তখন হয়তো উপভোগ্য হয়ে ওঠে। আমরা ক্রমশ ভুলে যেতে থাকি শিক্ষার্থীদের জন্যই শিক্ষক। আসলে শিক্ষার্থীরাই শিক্ষক পরিচিতি তৈরি করে। এ জন্যই শিক্ষকতা অন্য পেশার চেয়ে আলাদা। এখানে শুধু পেশার জোরে সবাই শিক্ষক হয়ে ওঠেন না। ফলে শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়া কেন্দ্রিক আন্দোলন ‘ব্যক্তিগত আক্রমণ’ কিংবা একটি গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র হিসেবে পাঠ করে সেগুলোকে ঠেকানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতে যদি সেগুলোকে আমলে নিয়ে, কান পেতে শুনে মেটানোর ক্ষেত্রে মনোযোগী হওয়া যায় তাহলে হয়তো অনেক ঘটনাই আর ঘটতো না।

কেন এমন হচ্ছে? গত দুই দশকে এ ধরনের শিক্ষার্থী আন্দোলনের ফল হিসেবে তিনজন উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হয়েছে কিংবা সরে যেতে হয়েছে। এর কারণ ৯০-এর পর দেশে গণতন্ত্র ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি থাকলেও আদতে দেশে গণতন্ত্রের সংকট যে রয়েছে তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছে। ভিন্নমতকে দমানো এবং দাবি দাওয়াকে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার প্রবণতা আসলে খুব ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশের জন্য। বারবার আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যবস্থাপনা মেরামতে কোনো কাজ হচ্ছে না। 

কিন্তু তারপরও এ থেকে শিক্ষা কেউ নেয়নি। হয়তো তারা মনে করেছেন- শিক্ষকরা কেন শিক্ষা নেবেন? কিন্তু শিক্ষা বিষয়টিই আসলে বহুমুখী। আমরা প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নানামুখী শিক্ষা নেই। আর এই বিনিময় হয় বলেই শিক্ষার্থীদের কাছেই শিক্ষকরা সুন্দর। 

এই ধরনের আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অবস্থা তৈরি হচ্ছে তাতে আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের সম্পর্ক। যে সম্পর্কটি হওয়ার কথা সবচেয়ে আস্থার, নির্ভরতার, ভালোবাসা ও সম্মানের, সে সম্পর্ক হয়ে উঠছে ক্রমশ বিপরীতমুখী, দোষারোপমুখী ও হেনস্থাকাঙ্ক্ষী। কোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ই এ ধরনের সম্পর্কের ওপর চলতে পারে না। 

আমাদের আরও মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কোনোভাবেই শিক্ষা আন্দোলনের বাইরের কিছু নয়। তাই এটিকে দমানো নয়, বরং শুনতে হবে, আমলে নিতে হবে। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় তো শিক্ষার্থীদের জন্যই। তাই আলোচনার দরজা সব সময় খোলা রাখতে হবে। সেটি বন্ধ করে আন্দোলন ঠেকানোর চেষ্টা কারো জন্যই যে ভালো পথ নয়, সেটি অতীত আমাদের অনেকবার দেখিয়েছে। 

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়