ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে শ্রীলঙ্কা 

জয়দীপ দে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৩, ১২ এপ্রিল ২০২২  
পরিবারতন্ত্রের বেড়াজালে শ্রীলঙ্কা 

উপমহাদেশে পরিবারতন্ত্র নতুন কিছু নয়। ভারত পাকিস্তানের পরিবারতন্ত্র নিয়ে আমরা কমবেশি জানি। শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে অনেকটা অজ্ঞাত ছিলাম। সম্প্রীতি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের পর পরিবারতন্ত্রের কথা উঠে এসেছে মিডিয়াতে। অনেকে বলছেন শ্রীলঙ্কা সরকার প্রকারন্তরে ‘রাজাপাকসে এন্টারপ্রাইজ লি.’ হয়ে গেছে।

গত ৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ছাড়া মন্ত্রিসভার সব (২৬) সদস্য পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। অবশ্য শ্রীলঙ্কার সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ না করা পর্যন্ত মন্ত্রিপরিষদ অবলুপ্ত হয় না। তাই গোটাবায়ার সরকার এখনো টিকে আছে। এই মন্ত্রিসভায় রাজপাকসে পরিবারেরই ৬ জন সদস্য ছিল। ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আরো ৩ জন। এছাড়া রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থার প্রধান হিসেবেও বসে আছেন এই পরিবারের আত্মীয়রা। যেমন শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের কথা বলা যেতে পারে।

অবশ্য শ্রীলঙ্কার জন্য এ নতুন কিছু না। শ্রীমাভো বান্দেরনায়েকও আত্মীয়-স্বজন দিয়ে দেশ চালাতেন। তার পরিবারের ঘুষ-কমিশন বাণিজ্যে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। পরে দুর্নীতির দায়ে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। সেই শ্রীমাভোর এমপি ছিলেন মাহিন্দা। তার বাবাও এমপি ছিলেন। রাজাপাকসে পরিবারের শ্রীলঙ্কার অন্যতম পলিটিক্যাল এলিট পরিবার। চল্লিশের দশক থেকে তারা রাষ্ট্রক্ষমতার খুব কাছাকাছি আছেন। মাহিন্দা তখনই দেখেছিলেন স্বজনপ্রীতি আর দুর্নীতির দায়ে জনধিকৃত নেতা কীভাবে তুমুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ফিরে আসতে পারে। জনতার স্মৃতি বড়ো ক্ষীণ। নির্বাচনের আগে আগে একটা আবেগ তুলে দিলেই হলো। 

শ্রীমাভোর কন্যা চন্দ্রিকা রাজনীতি থেকে অবসর নিলে ২০০৫ সালে শ্রীমাভোর রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টির টিকেটে প্রেসিডেন্ট হন মাহিন্দা। দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের অভিযোগ ২০১৫-এর নির্বাচনে নিজ দলের সদস্য সিরিসেনার কাছে হেরে যান। তারপর তিনি আর ফ্রিডম পার্টির ছায়ায় থাকতে চাননি। গড়ে তোলেন নতুন সংগঠন শ্রীলঙ্কা পড়ুজানা পেরামুনা। নাম পাল্টালেও নেতা কর্মী সব সেই ফ্রিডম পার্টির। অর্থাৎ তিনি আর কারো ধার ধারেন না।

২০১৮ সালে তিনি ক্ষমতায় আসেন কূটকৌশলের বলে। তবে ২০১৯ সালে তীব্র মুসলমান ও তামিলবিরোধী সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে তিনি ৫২ শতাংশ ভোটে ক্ষমতায় ফিরে আসেন। অবশ্য আগে দুইবার প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সে সুযোগ তার ছিল না। তাই ছোট ভাইকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়ে নিজে হন প্রধানমন্ত্রী। আর ক্যাবিনেট সাজান নিজের মতো করে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ভাই বাসিল রাজাপাকসেকে করেন অর্থমন্ত্রী। আরেক ভাই চামাল রাজাপাকসে আগে পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন। এরও আগে নৌ-পরিবহন ও বিমান চলাচল মন্ত্রী ছিলেন। তিনি হন সেচমন্ত্রী। পাশাপাশি তাকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও দেখতে হতো প্রধানমন্ত্রীর সহকারীরূপে। 

এতো গেল গুণধর ভাইদের কথা। পরবর্তী প্রজন্মকেও তারা মন্ত্রিপরিষদে জায়গা করে দিয়েছিল। মাহিন্দার ছেলে নামালকে মাত্র ২৪ বছর বয়সে করা হয়েছিল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী। যার নামে আছে মানি লন্ডারিঙের বিস্তর অভিযোগ। মাহিন্দার আরেক ছেলে ইয়োশিতা রাজাপাকসেকে করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর চিফ অব স্টাফ। জামালের ছেলে শীর্ষেন্দু হন কৃষিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। সরকারের মোট ব্যয়ের ৭৫ শতাংশ এরাই নিয়ন্ত্রণ করত।

কী চাঁদের হাট বসিয়েছিল রাজা-পরিবার! এমন দেখে সত্যি গাইতে ইচ্ছে করে: বেঁধেছে এমনই ঘর শূন্যের উপর পোস্তা করে, ধন্য ধন্য বলি তারে…। অবশ্য আগের সেশনেই (২০০৫-১৫) উন্নয়নের ঢেউ উঠেছিল দিকে দিকে। গৃহযুদ্ধ শেষ। এবার সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়া বানিয়ে ফেলতে হবে দেশটাকে। চীনও ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের’ (বিআরআই) আওতায় এগিয়ে এলো টাকার ঝোলা হাতে। চাণক্যের নীতিতে শুরু হলো ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ…। এতে যে কিছু সুফল মেলেনি তা নয়। ২০১৫ সালে শ্রীলঙ্কা হয়েছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল পর্যটক গন্তব্য। পর্যটনের আয়ে ফুলে ফেপে উঠছিল অর্থনীতি।

চারদিকে যখন উন্নয়নের খোল-করতাল বাজছে, রাজাপাকসে পরিবার তখন আখের গোছাতে ব্যস্ত। মাহিন্দা, তার স্ত্রী ও ভাইদের নামে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। মিলিয়ন ডলারের অভিযোগ। ক্ষমতা থেকে নামার পর শুরু হয় বিচার কাজ। বাসিল রাজাপাকসে নিশ্চিত শাস্তির হাত থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্র পাড়ি দেন। তার বিরুদ্ধে ডিভি নাগাম দপ্তরের সাড়ে ৩৬ মিলিয়ন ডলার তহবিল তছরুপের অভিযোগ ছিল। ২০১৯-এর নির্বাচনের পর দুর্নীতির সব মামলা থেকে সবাই অব্যাহতি পেয়ে যান। কুখ্যাত কমিশনখোর বাসিলকে অর্থমন্ত্রী বানানোর জন্য নাগরিক আইন সংশোধন করা হয়। ২০২১-এর জুলাই মাসে তিনি অর্থমন্ত্রী হন। শুধু দুর্নীতি নয়, এদের বিরুদ্ধে ছিল গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনেরও অভিযোগ। 

তামিলরা আত্মসমর্পণের পরও হাজার হাজার বেসামরিক তামিলকে হত্যা করা হয়। কারাগারে নির্যাতন চালিয়ে ৮৫ জনকে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে মাহিন্দার বিরুদ্ধে। অর্ধশতাধিক তামিল নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের প্রমাণ মেলে। ২০২১-এর জানুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এ সংক্রান্ত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করে। রিপোর্টে অভিযুক্ত উচ্চপদস্থ জেনারেলদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাসহ অনেকগুলো সুপারিশ করা হয়। তাছাড়া ওই তদন্ত রিপোর্টে ২০০৯ সালে ৪০ হাজার নিরস্ত্র তামিল নাগরিক হত্যার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। উগ্র তামিল জাতীয়তাবাদী ধুয়ো তুলে সেসবও বেমালুম হজম করে ফেলে নৃশংস রাজাপাকসে পরিবার। বিশেষ করে ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে কলম্বোর বিভিন্ন গির্জায় বোমা হামলার পর সিংহলিজদের কাছে নিষ্ঠুর রাজাপাকসেকে জঙ্গী দমনে উপযুক্ত ব্যক্তি মনে হয়েছিল। আর বৌদ্ধ ভিক্ষুরা শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তারা বরাবর রাজাপাকসে পরিবারকে সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু এতো কারিকুরি কাজ দিলো না। সুখের দিন দীর্ঘায়িত হলো না। 

২০২০-এর প্রথম থেকে শুরু হলো অতিমারির উপদ্রব। যে পর্যটন খাতের আয় আর রেমিটেন্স নিয়ে শ্রীলঙ্কা সরকারের এতো আত্মবিশ্বাস, সেসবের প্রবাহ গেল বন্ধ হয়ে। কিন্তু ঋণ পরিশোধ তো আর বন্ধ হয় না। এতে বৈদেশিক অর্থের মজুদও কমতে থাকে। এসময় সরকার ঘোষণা দেয় সার ও কীটনাশক আমদানি বন্ধের। এতে কিছুদিনের মধ্যে শুরু হয় খাদ্য সংকট। চীন থেকে নিম্নমানের জৈবসার আমদানি করে গচ্চা দিতে হয় ৬৩ মিলিয়ন ডলার। রিজার্ভ ভেঙে আনতে হয় খাদ্যশস্য। এদিকে কৃষকরা সার না পাওয়ায় সরকার থেকে ভর্তুকি দাবি করে। সরকার ইতোমধ্যে ৪০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সেটা কীভাবে দেবে একমাত্র ঈশ্বর জানেন। 
পরিস্থিতি এতো জটিল হওয়ার আগে থেকেই গোটাবায়াকে বারবার বলা হয়েছিল আইএমএফ-এর কাছে ধর্না দেওয়ার জন্য। বেইল আউট নিতে। কিন্তু পরিবারকে নিয়ে এতো সুরক্ষিত এক ক্ষমতা কাঠামো তিনি তৈরি করেছিলেন, কাউকে পরোয়া করার প্রয়োজন বোধ করেননি। আর লক্ষ্য করুন- কৃষি অর্থ সেচের মতো স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয়গুলো তো গোটাবায়ার ঘরের মানুষের হাতে। এ নিয়ে কিছু বলার সাহসও নেই কারো।

কলম্বো টেলিগ্রাফ পত্রিকার পুরনো একটি খবরে দেখা যায় ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ১০ বছর রাজাপাকসে পরিবার ১.২ থেকে ১.৮ বিলিয়ন ডলার কমিশন কামিয়েছে। দুজন ব্যবসায়ীর নাম খুব করে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বান্দুলা ওয়েরদেনা আর চা-ব্যবসায়ী প্রভাত নারায়াকারা। এরা রাজাপাকসে পরিবারের ঘনিষ্ঠজন বলে পরিচিত। চাইনিজদের বড়ো বড়ো সব প্রকল্পে এরা সাব কন্ট্রাক্টের কাজ করেছে। তবে বাসিলকে অর্থমন্ত্রী করার পর এখন আর মিডলম্যান লাগছে না। তিনিই এখন শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড়ো চাঁদাবাজ। তাকে কমিশন না দিয়ে কেউ কাজ পায় না।

এখন অবশ্য সবাই বলছে চীনের ঋণফাঁদে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু ফাঁদ যদি কিছু থেকে থাকে সেটা রাজাপাকসে পরিবারের তৈরি। ২০০৫ থেকে এ পর্যন্ত চীন মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। যা শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ। রাজাপাকসে পরিবার শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির সবচেয়ে বড়ো যে সর্বনাশ করেছে তা হলো ২০০৭ সাল থেকে সার্বভৌম বন্ড (sovereign bond) ছেড়ে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা। সাধারণত একটি দেশ যখন নিজেদের অর্থনীতি নিয়ে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী থাকে, তখন এ ধরনের বন্ড ছাড়ে। এ ধরনের বন্ডের মেয়াদ থেকে ৫ থেকে ১০ বছর। সুদের হার ৬ শতাংশ। মেয়াদউত্তীর্ণের সঙ্গে সঙ্গে সুদসহ আসল ফেরত দিতে হয়। তাই এই বন্ড ইস্যু করলে একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা চলে যায়। যেখানে আমরা পদ্মাসেতুর ঋণ পেয়েছিলাম ১ শতাংশ সুদে এবং ৩৬ বছরে  কিস্তিতে কিস্তিতে পরিশোধের শর্তে। অবশ্য পদ্মাসেতুর মতো করে ঋণ পাওয়ার সুযোগ শ্রীলঙ্কার ছিল না। ১৯৯৭ সাল থেকে শ্রীলঙ্কা এলডিসির তালিকা থেকে মুক্ত হয়েছে। তাই তার জন্য সফট লোন প্রযোজ্য ছিল না।

রাতারাতি কিছু করে দেখানোর স্পৃহা থেকে রাজাপাকসে পরিবার ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেনি। ২০০৯-এ তামিল টাইগার্সদের পতনদের পর পর্যটন থেকে যেভাবে আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল, তাদের কাছে টাকা কোন সমস্যা মনে হয়নি। গৃহযুদ্ধের পর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য মাহিন্দা রাজাপাকসে করের হার কমিয়ে দিয়েছিলেন। এতে বেশ কাজ হয়েছিল। ২০১৯ সালে ছোট ভাই গোটাবায়া ক্ষমতায় এসে একই কাজ করেন। ১৫ শতাংশ ভ্যাট এক লাফে ৮ শতাংশ হয়ে যায়। এভাবে সরকারের আয় কমে যায় ২৫ শতাংশ।

এদিকে ব্যয় কমাতে গিয়ে কৃষি ক্ষেত্রের মতো জায়গায় হাত দিয়ে পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে তারা। শুধু স্বজনপ্রীতি নয়, রাজাপাকসে পরিবার অঞ্চলপ্রীতিও দেখিয়েছে চূড়ান্ত। যে হাম্বানটোটা ডিপ সি পোর্টের জন্য শ্রীলঙ্কা চীনের ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছে পশ্চিমারা, সেই হাম্বানটোটা রাজাপাকসেদের গ্রামের বাড়ি। এখান থেকে তারা বারবার নির্বাচিত হয়ে এসেছে। একটা জেলা সদরে অপ্রয়োজনে গড়ে তোলা হয়েছে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। ভূতুড়ে এক শহর। যার থেকে বাৎসরিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় পর্যন্ত উঠে আসে না। 

তামিল বিদ্রোহ দমনের পর জাতীয় বীর হয়ে ওঠা মাহিন্দা পরিবারতন্ত্রের চূড়ান্ত দাপট দেখিয়ে গেলেন। একটা পরিবার কীভাবে গিলে ফেলতে পারে একটি দেশ তা বিশ্ব দেখল। এরপর যদি উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের শিক্ষা হয়।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়