ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বই বিক্রির কমিশনের পূর্বাপর

খান মাহবুব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:১৬, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৩:৫৯, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
বই বিক্রির কমিশনের পূর্বাপর

ছবি: সংগৃহীত

জাগতিক প্রয়োজনেই পণ্যের বিক্রয় ও বিক্রয়লব্ধ অর্থ লভ্যাংশসহ উৎপাদক কিংবা কারবারির কাছে ফেরত আনা বহমান সংস্কৃতি। বইকে ‘প্রচলিত পণ্য’ বলতে অনেকেই গররাজি হলেও পূর্বকাল থেকেই বইয়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টির  বৈপরীত্যের দেখা মেলেনি।

শিল্পীর পণ্য হিসেবে এবং বইয়ের সঙ্গে রুচি ও সংস্কৃতির সংশ্লেষ থাকে বলে বইয়ের মূল্য নির্ধারণ ও বাজারজাতকরণ কৌশলে কিছু ভিন্ন ভাবনার সংশ্লেষ থাকে। তবে আমাদের দেশে ফিকশন, নন-ফিকশন, একাডেমিক ও নানান বিষয়ের বইয়ের ক্ষেত্রে খুচরা পর্যায়ে ক্রেতাকে যে কমিশন দেওয়ার রীতি স্থির হয়ে আছে তা আমার বিবেচনায় যৌক্তিক নয়। এবং এই পদ্ধতির ফলে এই সেক্টরে অনেকাংশে বিশৃঙ্খলা বিরাজমান।

উন্নত বিশ্বের বই কিনলে বইয়ের সুনির্দিষ্ট মূল্য ব্যবস্থাকে ভিত ধরে অনেক দেশে বই বিপণন হয়। এবং এ কার্যক্রমটি আইনের আওতায় সম্পন্ন হয়। এ তালিকার সর্বাগ্রে ফান্স ও জার্মানির নাম নেয়া যায়। অনেক উন্নত দেশে বইয়ের উৎপাদক ও বাজারজাতকারীরা যৌথভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করেন।

মূল্য নির্ধারণ ও বাজার চ্যানেলে বিভিন্ন পর্যায়ে কমিশনের ব্যবস্থা থাকলেও পাঠক পর্যায়ে কমিশনের রেওয়াজ কম। পাঠক বা ক্রেতা পর্যায়ে কমিশনে বিশৃঙ্খল প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বরং যৌক্তিক এবং প্রতিযোগী মূল্যে যেন পাঠক বই পায় সেটিই দেখার বিষয়। উন্নত বিশ্বের বইবাজার ব্যবস্থাপনার দৃষ্টি সেদিকে।

অনেক উন্নত দেশে পাঠক পর্যায়ে সামান্য কমিশন বিক্রেতার কমিশন থেকে শেয়ার করা হয় পাঠককে প্রণোদনার মাধ্যমে আকর্ষণ করতে। ফ্রান্সে ৫ শতাংশ কমিশন প্রদান করা হয় পাঠক পর্যায়ে- এটা রীতিশুদ্ধ ও অনেকটা ধ্রুব। পাঠক বা বিক্রেতা পর্যায়ে এ বিষয়টি নিয়ে আর দরকষাকষি নেই। পশ্চিমা বিশ্বের বইয়ের গ্রাহকদের কাছে গায়ের মূল্যই অগ্রগণ্য। কোন বই কতটা চলবে তার উপরও কমিশন নির্ভরশীল নয়। এ তালিকার দেশগুলোতে ফ্রান্স, জার্মানি ছাড়াও রয়েছে পর্তুগাল, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসের নাম। এসব দেশে খুচরা বিক্রেতারা অভিন্ন পূর্ব নির্ধারিত মূল্যে বিভিন্ন টাইটেলের বই গ্রাহকদের অফার করে। এখানে গ্রাহক পর্যায়ে গায়ের মূল্য নির্ধারণের বিষযটি মুখ্য। গ্রাহক পর্যায়ে কমিশন অফার করে বাজারে অস্থিতিশীল ও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরিতে তারা গররাজি।

অভিজ্ঞতা ও বাজার বিশ্লেষণে এ কথা প্রতীয়মান হয় পাঠক পর্যায়ে কমিশন দিলে কখনই সন্তুষ্টি আসে না তাদের মানে। যত বড় বা যত ভালো অফারই হোক- পাঠকদের আরো চাই। বরং গায়ের মূল্যে বই বিক্রি করে পাঠক তুষ্টি সাধন করা যায়; সেটি দেখভাল করা বড় বিষয়।

নরওয়ে ও হাঙ্গেরির মতো কল্যাণনিষ্ঠ রাষ্ট্রে বাণিজ্য চুক্তির ভিত্তিতে বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এই দেশগুলোতে বই বিক্রেতারা জাতীয় প্রবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ডিগ্রিতে ছাড় প্রয়োগ করার অনুমতি পায়। অন্যদিকে সুইডেন, লাটভিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র বাজার মূল্য অনুসারে বইয়ের মূল্য নির্ধারণ করে। বিষয়টি একটি প্রতিযোগিতামূলক এবং স্থিতিস্থাপক বই খাত তৈরি করেছে। উন্নত দেশ বই উৎপাদন ও বিপণনে একটি কাঠামোবদ্ধ ও সুসংহত পদ্ধতিতে এগিয়ে যায়। ফলে বই ব্যবসা হয় প্রশস্ত ও বহুমুখী। একটি ফিক্সড বুক প্রাইস (এফবিপি) সিস্টেমের অধীন চূড়ান্ত ক্রেতার কাছে বিক্রি করা গেলে সব দিক বিবেচনায় তা লোকপ্রিয় ও ব্যবসাবান্ধব।

আমাদের দেশে ট্রেড ডিসকাউন্টে বইয়ের ক্ষেতে বিভ্রাট আছে। আমরা ডিসকাউন্ট বা কমিশনকে খুচরা পর্যায়ে অসহনীয় করে ফেলি। বিক্রয় বৃদ্ধির প্রত্যয়ে কমিশন এমন পর্যায়ে যায় যে ব্যবসার আর্থিক নির্ণায়ক ভারসাম্য বিন্দুর নিচে (Break even point) নেমে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে। অথচ ট্রেড ডিসকাউন্ট পরিচিত তালিকা মূল্যের হ্রাসকে বোঝায়, যা একটি সরবরাহকারী গ্রাহকের কাছে অনুমোদিত হয়, যখন পণ্যটি সাধারণভাবে বাল্ক পরিমাণে সংশ্লিষ্ট ভোক্তার কাছে বিক্রি করে ব্যবসার বিক্রয় বাড়ানোর জন্য। কারণ যখন কমিশন দেওয়া হয় তখন আরো গ্রাহক আকৃষ্ট হয়। প্রতিটি ব্যবসার একটি মৌলিক উদ্দেশ্য পণ্য বা সেবার বিক্রয় বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় অর্জনে দীর্ঘমেয়াদী টিকে থাকা নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে কমিশন একটি ইতিবাচক হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশের বই জগতের প্রয়োগ বাস্তবতায় পাঠক পর্যায়ে কমিশন প্রদান হিতে বিপরীত হয়েছে। বই বিক্রিতে বিভিন্ন পর্যায়ে এতো এতো কমিশনে পাঠক বিভ্রান্তিতে পড়ে- বই ব্যবসায় না জানি কত মুনাফা!

আমরা চাইলেও দ্রুত গায়ের দামে খুচরা পর্যায়ে এখনই বই বিক্রি করতে পারবো না। তবে এই আন্দোলনটা বলবৎ রাখা জরুরি। যাতে সহসাই গায়ের মূল্যে বই বিক্রির প্রচলন করা যায়। এ ক্ষেত্রে ঐতিহ্যগত বিষয়ে দৃষ্টিপাতও আবশ্যক। 

বই বিপণনের সূচনা লগ্নে হাতে লেখা পুঁথির মূল্য নেহাত কম ছিল না। ১৭২৮ সালে লিপিকার দর্প নারায়ণ দাশ এক কপি ‘রামায়ণ’ বিক্রি করে পেয়েছিলেন নগদ সাত টাকা ও সাথে নতুন জামাকাপড়। বাঙালি হিসেবে মান্য করা প্রথম প্রকাশক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ১৮২০ সালে নিজস্ব ছাপাখানা ও বই বিক্রয় করেই ক্ষান্ত হননি, কলকাতার বাইরে বই বিপণনের জন্য এজেন্ট নিয়োগ করেছিলেন। গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের এজেন্টদের বইয়ের ঝুলিতে ‘সখের জলপান’ নামীয় বই থেকে ‘ভারতচন্দ্রের কাব্য’ থাকতো। সেই সময় নির্দিষ্ট কমিশনে নয়, পাঠকের সঙ্গে দরদাম করে বই বিক্রি হতো। পাঠকের কাছে নির্দিষ্ট কমিশনের অফার থাকতো না। 

৪৭’-এর দেশভাগ পর্বে বইয়ের বাজারে কমিশন অফারে সয়লাব ছিল। চিত্ররঞ্জন সাহা পুথিঘরের মাধ্যমে নোট বই বাজারে চালাতে ৬০%-৭০% কমিশন পর্যন্ত দিতেন। এ কারণে ৫-৬ টাকায় বিক্রি হওয়া বইতে দাম মুদ্রিত থাকতো ২৫-৩০ টাকা। এই যে কমিশনের প্রাপ্তিতে বিভোর হলো জাতি! মূলত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই চালাতে এই কমিশনের দৌরাত্ম্য চলমান বাজারে। মানুষের মনোজমিনে অধিক কমিশন প্রাপ্তি একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর এনে দেয়। ফলকথা যৌক্তিক মূল্য বইয়ের সময়ে মুদ্রণের বিষয়টি যোজন যোজন দূরে চলে যায়।

কমিশনের ভূত চাপার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট হলো জাতীয় জনপ্রিয় লেখকদের বই পূর্ববঙ্গ থেকে পাইরেসি মুদ্রণ ও লোভনীয় কমিশনে ক্রেতা আকর্ষণ। পাকিস্তানি জামানায় সমরেশ, নিহার রঞ্জনের বই গ্রাহক পর্যায়ে ৪০%-৫০% কমিশনে বিক্রয়ের নজির মেলে। 

বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাইকারি পর্যায়ে সৃজনশীল বইয়ের ক্ষেত্রে ৩০%-৩৫% বেশি কমিশন সাধারণত দেওয়া হতো না। বইঘর, সন্ধানীর মতো প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠান পাইকারি পর্যায়ে ৩০% কমিশন দিত। এক সময় অমর একুশে বইমেলায় বই বিক্রির কমিশন ছিলো ২০% যা এখন ২৫%। অন্যদিকে বোর্ডের নির্ধারিত বইতে ১৫%-২০% কমিশন প্রদান করতো এজেন্টের, তাই খুচরা পর্যায়ে কমিশন দেওয়া হতো না। কলকাতার বইয়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় স্বাধীনতার পর সাধারণত পাঠক পর্যায়ে বাংলাদেশী আমদানিকারকদের ২৫% কমিশন প্রদান করা হতো। রুপির মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে বাংলাদেশে ভারতীয় বইয়ের গায়ের মূল্যে ১০০ টাকা লেখা থাকলে পাঠকদের কাছে দর নির্ধারণ করা হতো ১২৫ টাকা।

বই বিপণন নিয়ে কাজ করা অনেকের অভিমত কাগজের মূল্য, ফর্মা কভার বাঁধাই সব মিলিয়ে বইতে পাঠক পর্যায়ে কমিশন না দিয়ে মিনিমাম ও ম্যাক্সিমাম দর নির্ধারণ করা যেতে পারে। লন্ডন পাবলিশার্স এসোসিয়েশনের এক জরিপে দেখা যায় প্রকাশনা শিল্পে ৯৭% বই নন ফিকশন, ৩% ফিকশন। ৯৭% এর মধ্যে এডুকেশনাল ও একাডেমি বই প্রধান। ফলে বইয়ের কমিশন, মূল্য নির্ধারণে নতুন চিন্তার যোজনা প্রয়োজন।

পরিবর্তিত বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমরা এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মাঝে জীবনযাপন করছি। মুদ্রণের ক্ষেত্রে এসেছে ত্রি-মাত্রিকতা। বিপণনে ডিরেক্ট ও ডিজিটাল মার্কেটিং এখন নতুন সংযোজন। মুদ্রিত বইয়ের বাইরেও আছে ই-বুক, অডিও-ভিডিও ফরমেট, পিডিএফ ইত্যাদি। এখন বই বিপণনে সনাতনী চিন্তার নবায়ণ প্রয়োজন। যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য বিষয়কে সামনে আনতে হবে বিপণন কৌশলে। 

বই বিপণনে পাঠককে কমিশন না দিয়ে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন প্রকাশনী বেশি ছাড়ে বিক্রির ব্যবস্থা করলে ভালো হবে। এখনও বাংলা একাডেমিসহ কিছু প্রকাশনা অধিক বিক্রি ও ... ক্লিয়ারেন্সের জন্য এই ব্যবস্থা করে। করোনার মাঝেও কলকাতার সুনামধন্য প্রতিষ্ঠান ‘দেজ’ ২০২১ সালের ১১ আগস্ট থেকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ৫ দিনের বিশেষ ছাড়ে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে ভালো ফল পেয়েছে। দেজ এর কর্তা শুভঙ্কর জানান- ‘... এখন বাজার খুলে দিয়েছে। কোথাও ৩০ কোথাও ৫০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। সেখানে যদি ছাড় দিতে পারে তাহলে বইয়ের ক্ষেতে নয় কেন?’

সব বিনিময়ে প্রতিদান নির্ধারণ গুরুত্ববহ বিষয়। বইয়ের বিপণনে পাঠকদের জন্য বিষয়টি তাৎপর্যবহ। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে কমিশনের পাল্লা বইয়ের সময়ের মূল্যকে গুরুত্বহীন করে অনেকাংশে। তাই সার্বিক বিচারে আমাদের গায়ের মূল্যে বই বিক্রির পথেই হাঁটতে হবে ব্যবসায়িক সাম্য, স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘ মেয়াদী টিকে থাকার স্বার্থে।

লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক
 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়