ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

আসন্ন রমজানে মানুষের উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি 

যিকরু হাবিবীল ওয়াহেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৩:৪৫, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
আসন্ন রমজানে মানুষের উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি 

করোনা মহামারির রেশ কাটতে-না-কাটতেই শুরু হলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তাছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া দেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতিসহ বিবিধ কারণে মানুষ এমনিতেই বহুবিধ কষ্টে আছে। এর ওপর যোগ হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। এ যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’।

তাছাড়া আর ১৫ দিন পরেই রহমত মাগফেরাত নাজাতের বার্তাবাহক মাস পবিত্র রমজান। বাংলাদেশের মুসলমানদের কাছে রমজানের বিশেষত্ব অসীম। বেশ কিছুদিন থেকে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের লাগামহীনতার কথা। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। বিভিন্ন সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়ানোর কথাও বারবার উঠে এসছে এসব প্রতিবেদনে। এত এত সংবাদের পরও সিন্ডিকেট ভাঙা দূরে থাক, বরং সিন্ডিকেট যেন দিন দিন বটগাছে রূপ নিচ্ছে!

একদিকে সাধারণ মানুষের হা-হুতাশ বাড়ছে, অন্যদিকে সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষও বাড়ছে। মাঝখানে লাভবান হচ্ছে শুধুই অসাধু সিন্ডিকেটগুলো। আওয়ামী লীগের সরকার যখন ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসে তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কিছুটা হলেও সাধারণ মানুষের নাগালে রাখতে পেরেছিল। তাতে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্টও ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে সরকার গঠনের পর থেকে আজ অবধি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেভাবে বাড়ছে তার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। তাছাড়া বাজার মনিটরিং-এ  ঢিলেঢালা ভাবের কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না।

বিগত কয়েক বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চাল ডাল পেঁয়াজ রসুন তেলসহ ইত্যাদি নিত্যপণ্যের দাম আগের দাম থেকে বেড়ে দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ পর্যন্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে একটি অসাধু চক্র বারবার সরকারকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই কাজে অসাধু চক্রটিকে অধিকাংশে সফলও বলা চলে। তাই সরকারের উচিত আইন প্রয়োগের মাধ্যমে এই চক্রটির মূলোৎপাটন করে শিকড় উপড়ে ফেলা। 

বিভিন্ন বাজার ঘুরে এবং সংবাদমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, চিকন চালের দাম ২০০৯ সালে প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা ছিল, সে চালের দাম বর্তমানে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫-৯০ টাকা। মোটা চালের দাম ছিল ২২-২৩ টাকা, বর্তমানে দাম বেড়ে ৫৫-৬৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ডালের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০০৯ সালে এক কেজি দেশি মোটা মসুর ডালের দাম ছিল ৫০-৬০ টাকা, বর্তমানে দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি ১০০-১১০ টাকা। ২০০৯ সালে এক কেজি আটার দাম ছিল ২৭-২৯ টাকা, বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫-৬০ টাকা। প্রায় সব কিছুর দামই বিভিন্ন সময় বেড়েছে। এরপরও মাঝেমধ্যে পেঁয়াজ, মরিচের বাজার অস্বাভাবিকভাবে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। সয়াবিন তেলের দাম বর্তমানে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ২০০৯ সালে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০-৭৩ টাকা, বর্তমানে সেই তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭৫-১৮০ টাকায়। যদিও সরকার বলছে কেজি ১৬৮ টাকার ওপরে যারা দাম নিবে সেসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। চিনি- ২০০৯ সালে আমদানিকৃত এক কেজি চিনির দাম ছিল ৫২-৫৪ টাকা, বর্তমানে সেই চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। এ ভাবে মাছ মাংস ডিম সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখি। 

গরুর মাংস অঘোষিতভাবে অনেকটা ওপরতলার মানুষদের খাবার হয়ে গেছে। মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ এখন মেজবান কিংবা অনুষ্ঠানে গরুর মাংস খেতে পান। মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষ সবার কমন সবজি হিসেবে যে খাবার বিবেচিত সেই আলুর দামও কয়েকগুণ বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩০-৪০ টাকায়। তবে কিছুদিন পরপর আলুর দামও বেড়ে যায় লাগামহীনভাবে। শীতের মৌসুমকে বলা হয় সবজির মৌসুম। অথচ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে শাক সবজিসহ উৎপাদনশীল প্রতিটি পণের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। অথচ উৎপাদনকারী কৃষক তাদের ন্যায্যমূল্য থেকে সর্বদা বঞ্চিত হয়ে আসছে। সেখানেও মধ্যস্বত্বভোগী অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বেশ তৎপর। এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা তেমন চোখে পড়ে না।

আরবসহ বিশ্বে পবিত্র রমজানকে কেন্দ্র করে রোজাদারদের সম্মানে ব্যবসায়ীরা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে ৫০-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেন। বিভিন্ন দেশে রোজাদারদের ইফতার-সাহরি খাওয়ানো হয় বিনামূল্যে নেকির উদ্দেশ্যে। আর তার ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় মাতৃভূমি বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। দেশে রমজান এলেই সবকিছুর দাম বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রমজানে যেসব ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে রোজাদারদের জিম্মি করে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় তারাও অধিকাংশ মুসলমান। মুসলমান হিসেবে হলেও এহেন গর্হিত অনৈসলামিক কাজ হতে বিরত থাকা উচিত এসব মুসলমান ব্যবসায়ীদের। 

সরকারের উচিত সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে অতি দ্রুত সিন্ডিকেটগুলো ভেঙে পণ্য সরবরাহ বাড়ানো, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা, রমজান রিলেটেড পণ্যের সরবরাহ বাড়ানো, মজুদদারী কঠোরভাবে দমন করা, বাজার মনিটরিং জোরদার করা, অসম প্রতিযোগিতা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, একক কোন ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিকট ব্যবসার বিশেষ সুবিধা না দেওয়া, কৃষক টু ভোক্তার একটি শক্তিশালী চেইন তৈরিতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। তাছাড়া অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ ভর্তুকি দেওয়াসহ সিন্ডিকেটে জড়িতদের লাইসেন্স বাতিল করে তাদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে জেল জরিমানার বিধান নিশ্চিত করতে পারলেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কিছুটা কমে জনমনে স্বস্তি আসতে পারে। অন্যথায় ‘যেই লাউ সেই কদুই’ থেকে যাবে। সাধারণ মানুষ নীরবে কান্না করেই যাবে।

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়