ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিশুদের স্কুলমুখী করতে হারুনের অভিনব উদ্যোগ

মো. আবু কাওছার আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৪৯, ২৯ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৬:২৬, ২৯ মার্চ ২০২১
শিশুদের স্কুলমুখী করতে হারুনের অভিনব উদ্যোগ

করোনাভাইরাসের কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও করোনার হাত থেকে শিক্ষার্থীদের রক্ষা করতে বিগত এইচএসসি পরীক্ষা হয়নি। শিক্ষার্থীদের অটোপাসের মাধ্যমে পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ করাও হয়েছে। 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের অনলাইনের মাধ্যমে পাঠদান করান শিক্ষকরা। সেক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় টাঙ্গাইলের নাগরপুরের বারাপুষা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরি কাম নৈশ প্রহরী হারুন অর রশিদ বসে না থেকে পেশাগত কাজের বাইরে নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়কে সাজিয়ে তুলেছেন আপন মহিমায়। বিদ্যালয় সেজেছে নতুন রূপে। 

আগে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে না চাইলে বিদ্যালয়ের নতুন রূপ দেখে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও শিক্ষার্থীরা স্কুলে এসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, করছে খেলাধুলা। এতে বিদ্যালয়ের প্রতি বেড়েছে শিক্ষার্থীদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। একইসঙ্গে আগ্রহ বাড়ছে পড়ালেখার প্রতি।

হারুন অর রশিদের পেশাগত দায়িত্ব বিদ্যালয়ের টুকিটাকি কাজ করা ও রাতে বিদ্যালয়টি পাহারা দেওয়া। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে স্কুল বন্ধ। হাতে কাজও অনেক কম। কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই হারুন অর রশিদ। তিনি নিজের চিন্তা-ভাবনা থেকে নিজের কর্মস্থল বিদ্যালয়কে দিয়েছেন নতুন রূপ। তার নেই কোনো হাতে-কলমে শিল্পকর্মের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, নেই কোনো চিত্রকর্ম কারুকাজের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ। তারপরেও তার রঙ-তুলিতে অপূর্ব সব ছবি এঁকে বিদ্যালয়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। বিদ্যালয়ের বাইরের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধের ছবি। ভেতরের পরিবেশটি আরও চমৎকার। হারুন বিদ্যালয়ে নিজ হাতে তৈরি করেছেন চমৎকার একটি বাগান। প্লে কর্নারের সাজসজ্জাটিও তিনিই করেছেন। বাংলাদেশের অপূর্ব একটি মানচিত্র, বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষ সজ্জিতকরণ, জাতীয় সংসদ ভবন, শহীদ মিনার, স্মৃতি সৌধ তৈরি করেছেন তার নিজের হাতের ছোঁয়ায়। বিদ্যালয়টির ছাদে রয়েছে একটি ছাদ বাগান। 

হারুন অর রশিদের হাতে তৈরি জাতীয় শহীদ মিনার

হারুন অর রশিদ বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও রাতে আমাকে পাহাড়া দিতে হয়। তাতেও আমার মন প্রশান্তি আসে না। চিন্তা করলাম এই অলস সময়কে কিভাবে কাজে লাগানো যায়। সেই থেকে আমি চিন্তা করলাম বিদ্যালয়কে নতুন রূপে সাজাতে হবে। শিক্ষার্থীদের স্কুলমুখী করতে এমন উদ্যোগ নেই। তখন থেকে আমি শিক্ষকদের অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করি।’ 

‘শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ বাড়াতে শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধসহ গুরত্বপূর্ণ আকর্ষণীয় বিষয়বস্তুর কাজ শুরু করি। অনেক কাজে সফলতাও পেয়েছি। আমি মনে করি, আমার বিদ্যালয়টি একদিন পড়ালেখা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও দৃষ্টিনন্দন বিদ্যালয় হিসেবে দেশের অন্যতম বিদ্যাপীঠে পরিণত হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যালয়ের পাশে একটি ডোবা আছে। সরকারের পক্ষ থেকে ডোবাটি ভরাট করা হলে সেখানে আকর্ষণীয় ইকোপার্ক করা যেতে পারে।’

দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলে, ‘স্কুল বন্ধ থাকার পর বিদ্যালয়ে সপ্তাহে ২/৩ দিন আসি। স্কুল এখন সুন্দর লাগে। স্কুলে এখন স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, সংসদ ভবন, বাগান আছে, বাগানে বাঘ, হাতি ভাস্কর্য আছে, এগুলো দেখে আমার খুব ভালো লাগে। বিদ্যালয়ে এসে খেলাধুলা করি। কখনো স্মৃতিসৌধ ও সংসদ ভবন দেখিনি। স্কুলে স্মৃতিসৌধ ও সংসদ ভবনের ছবি দেখে ভালো লাগে।’ 

প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোয়াদ হোসেন বলেন, ‘আমি এখনো ঢাকায় যাইনি। তাই অনেক কিছুই দেখতে পারি নাই। আমাদের স্কুলে আসলে অনেক কিছু দেখা যায়। বিদ্যালয়ে আমরা খুব আনন্দ নিয়ে খেলাধুলা করি।’

শিশুদের দৃষ্টি কাড়ছে জাতীয় সংসদ 

মো. শাহজাহান নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমরা এই বিদ্যালয় থেকেই পড়ালেখা করে বড় হয়েছি। আগে এই স্কুলটি এত উন্নত ছিল না। বর্তমানে স্কুলটি সার্বিকভাবে উন্নত হয়েছে। হারুনকে স্কুলে নিয়োগ দেওয়ার পর তিনি অত্যান্ত সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠানটি দেখাশোনা করছেন। নিজের ইচ্ছায়, নিজ শ্রমে বাংলাদেশের ম্যাপ, স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার ও সংসদ ভবনের প্রতিকৃতি তৈরি করেছেন। সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছুই শিখতে পারবে। এ ছাড়াও জাতীয় ফুল শাপলার মধ্যে পানির ফোয়ারা, দোলনাসহ শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ বাড়ানোর মতো ভাস্কর্য করেছেন।’

অপর অভিভাবক মিনা বেগম বলেন, ‘হারুনের হাতের ছোঁয়ায় বিদ্যালয়টি এখন অনেক সুন্দর হয়েছে। হারুনের পরিশ্রমে বিদ্যালয়টি অনেক উন্নত হয়েছে। আগে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা আসতে অনীহা প্রকাশ করতো। বিদ্যালয়ের সৌন্দার্য দেখার পর শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। স্কুলটি টাঙ্গাইল জেলায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’

নাগরপুর উপজেলার সহকারী শিক্ষা অফিসার জি এম ফুয়াদ মিয়া বলেন, ‘বিদ্যালয়ের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা না থাকলে কেউ এত সুন্দর করে বিদ্যালয় সাজাতে পারে না। হারুনের হাতে যে সব কাজ দৃশ্যমান হয়েছে, তার প্রতিটি পরতে পরতে রয়েছে সুগভীর প্রেম ও মমত্ববোধ। হারুন আমাদের সবার জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমরা সবাই তার এ কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করে যাবো।’

টাঙ্গাইল/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়