ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

মহামারিতে ঘূর্ণিঝড়: মরার উপর খাঁড়ার ঘা 

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০০, ২১ মে ২০২১   আপডেট: ১৩:১৭, ২১ মে ২০২১
মহামারিতে ঘূর্ণিঝড়: মরার উপর খাঁড়ার ঘা 

চিংড়ির খামার ভেসে গেছে আম্ফানে। শূন্য পড়ে আছে খামার 

ঘূর্ণিঝড় আঘাতের সেই সন্ধ্যার কথা উষা রানীর ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে দেয়াল ঘড়িটায় শেষবারের মতো চোখ রেখেছিলেন তিনি। বড় ঝড় আসছে, জোয়ারের পানি বাড়ছে দ্রুত গতিতে। আর অপেক্ষার সুযোগ নেই। তাদের দ্রুত কোথাও গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে। দূরের সাইক্লোন শেলটারে যাওয়ার সুযোগও নেই। কোভিড-১৯ মহামারির ভয়ে সেখানে যেতে আগ্রহী নয় কেউ। কিন্তু সাইক্লোনের ভয় তো আরও বড়! কোথায় যাবেন, স্থির করতে পারছেন না। বাড়ির নিকটে একটি একতলা স্কুল ভবন আছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে সেই ভবনের নিচতলা পানিতে ডুবে যায়। অবশেষে উষা রানী এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা কপোতাক্ষ নদীর তীরে বেড়িবাঁধের উপরে আশ্রয় নেন। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের সেই রাত থেকে এখন পর্যন্ত উষা রানী এবং তার পরিবার সেখানেই বাস করছেন। 

উষা রানীর বাড়ি বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার হাজতখালী গ্রামে। গ্রামের নিকটে বেড়িবাঁধ ভেঙে গোটা গ্রাম পানিতে ভেসে যায়। হাজতখালী, কাটমারচর, উত্তর বেদকাশি এবং অন্যান্য গ্রামের বহু পরিবারের ঠাঁই হয় বেড়িবাঁধে।   

কোভিডসৃষ্ট মহামারির মধ্যে ঝড়ের সংকেত পেয়েও সাইক্লোন শেলটারে যেতে চাননি সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা গ্রামের মিজানুর রহমান। তবুও জীবন রক্ষা করতে যেতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু মহামারির ভয় তার পিছু ছাড়েনি। এমন অনেককেই বাধ্য হয়ে সাইক্লোন শেলটারে থাকতে হয়েছে মহামারির ভয় উপেক্ষা করে। কেননা সেখানে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের সুযোগ ছিল না। কিন্তু সেই জরুরি সময়ে এ ছাড়া তাদের আর কিছুই করার ছিল না।

এক বছর লবণ পানিতে ডুবে থাকার পরে মরা এই গ্রাম। খুলনার কয়রা উপজেলার কাচারিবাড়ি এলাকার ছবি

এর আগের সব সাইক্লোন থেকে ২০২০ সালের ২০ মে’র ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এখানেই ছিল আলাদা। তাদের নতুন ধরনের সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে। তারা মহামারির ভয়ও উপেক্ষা করতে পারেননি, আবার ঘূর্ণিঝড় থেকে বাঁচতে বাড়িতেও থাকতে পারেননি। মহামারি চলাকালীণ ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতির কথা আগে ভাবা হয়নি। এ ছাড়া অন্যান্য সমস্যা তো ছিলই। যেমন, অনেক স্থানে সাইক্লোন শেলটার নেই, রাস্তাঘাট কিংবা শক্ত বেড়িবাঁধও নেই। সব সমস্যা একত্রিত করলে সংকট অনেক বড়। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষকে এই বড় সংকটের মুখে ফেলেছে। এর আগে তারা এই সমস্যার মুখোমুখি হন নি।

মহামারিতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি বাধাগ্রস্ত

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের রেডক্রিসেন্ট ভলান্টিয়ার মো. আবদুল হালিম বলেন, ‘তখন বাংলাদেশে কোভিড-১৯ একেবারেই নতুন। মানুষের মধ্যে এই মহামারি নিয়ে আতঙ্ক ছিল। সিগন্যাল ঘোষণার পরে আমরা মানুষের বাড়ি গিয়ে তাদের সাইক্লোন শেলটারে নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তাদের আগ্রহ ছিল না। মহামারি তাদের আরও অনাগ্রহী করে তোলে। তবুও অনেক মানুষকে আমরা সাইক্লোন শেলটারে নিয়েছি। কিন্তু সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব হয়নি।’ 

বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডলেরও একই অভিমত। তিনি বলেন, এর আগে আমরা অনেকবার ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি নিয়েছি। মানুষদের সাইক্লোন শেলটারে নিয়েছি। কিন্তু গত বছরের ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রস্তুতি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের নতুন অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছে। সাইক্লোন শেলটারে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই কঠিন ছিল। মহামারির সময়ে ঘূর্ণিঝড়ের প্রস্তুতি নিতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। 

আম্ফানের ধাক্কায় বেড়িবাঁধ ভেঙে জলোচ্ছ্বাসের পানিতে ভেসে গেছে কৃষি খামার

আন্তর্জাতিক ফেডারেশন অফ রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস (আইএফআরসি), বাংলাদেশ-এর পর্যবেক্ষণ বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশ মহামারি, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এবং বন্যার মুখে পড়েছিল। ত্রিমূখী সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। মহামারি এই সংকটকে আরও জটিল করেছিল। আম্ফান আক্রান্ত সম্প্রদায়ের অভিবাসী শ্রমিকদের শহরে তাদের পুরনো চাকরিতে ফিরে আসা এবং পরিবারগুলোকে পুনর্নির্মাণে সহায়তা করা কঠিন করে তোলে। জলাবদ্ধতা উপকূলীয় সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। যদিও ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে, বাংলাদেশ প্রাথমিক সতর্কতা প্রসারণ, সরিয়ে নেওয়ার নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র চিহ্নিতকরণ, সাইক্লোন প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) মাধ্যমে আশ্রয়কেন্দ্রে বিভিন্ন সুবিধা (শুকনো খাবার, সঠিক আলো, টয়লেট, জল ইত্যাদি) নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একটি যৌথ প্রোগ্রাম। তবে মহামারিতে এই কাজগুলো বাধাগ্রস্ত হয়। যা অবকাঠামো এবং সম্প্রদায়গত সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও ক্ষতি রোধ করতে ব্যাপক হস্তক্ষেপে বিলম্বিত করে।

কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট

গত বছর এই সময়ে কোভিডসৃষ্ট মহামারির ভয়াবহ চাপ ছিল। লকডাউনের কারণে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলো থেকে কর্মহীন মানুষ গ্রামে ছুটে যান। কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ২০ মে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে বাংলাদেশের উপকূলে। ফলে পশ্চিম উপকূলের কয়েক লক্ষ মানুষের জীবনে চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। মহামারি এবং ঘূর্ণিঝড় মিলে তারা দ্বিমূখী চাপে পড়ে।  

প্রতাপনগর ইউনিয়নের আম্ফান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার যেদিকে চোখ যায়, শুধু ফাঁকা মাঠ। সবখানে ধ্বংসের চিহ্ন। এলাকার মানুষ বলেছেন, আইলার চেয়েও আম্ফানে বেশি ক্ষতি করেছে। বেড়িবাঁধ না থাকায় ঘূর্ণিঝড়ের ভোগান্তি স্থায়ী হয়েছে। দশ মাসের বেশি সময় অনেক এলাকা পানিতে ডুবেছিল। আরও কতদিন সংকটে থাকতে হবে, জানা নেই কারো। বাসিন্দারা বলেছেন, আম্ফানের আঘাতের সময় এই এলাকায় কিছু জমিতে ছিল বোরো ধান, আর কিছু জমিতে ছিল চিংড়ি ঘের। ফলে বোরো ধান যেমন কৃষকেরা ঘরে তুলতে পারেনি, তেমনি চিংড়িও ভেসে গেছে। উভয় ক্ষেত্রেই বড় ধরনের লোকসান গুনতে হয়েছে। অন্যদিকে এবার আমন মৌসুমে অনেক স্থানে ধান আবাদ করা সম্ভব হয়নি।

আম্ফানে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলা। এই উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের কুড়িকাহুনিয়া গ্রামের চিংড়ি চাষি নূর ইসলাম (৪৫) এখন নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। শেষ সম্বল গরু বিক্রি করে চিংড়ির খামারের জমির মালিককে লিজের টাকা ফেরত দিয়েছেন। চিংড়ি চাষ তার পক্ষে আর সম্ভব হবে না। নূর ইসলাম চিংড়ি চাষি থেকে এখন নৌকার মাঝি। 

একই গ্রামের মাফুয়ার রহমান (৩৫) চিংড়ি খামার করেছিলেন তিন বিঘা জমিতে। খামারের জমি এখনও পানির নিচে। আম্ফান তার ঘরও ভাসিয়ে নিয়েছে। গোটা প্রতাপনগর ইউনিয়নে এ বছর চিংড়ি চাষের প্রস্তুতি নিতে পারেনি কোনো চাষি। তারা কেউই জানেন না সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে!  

আম্ফান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যাতায়াতের প্রধান বাহন এখন নৌকা

কুড়িকাহুনিয়া থেকে ফেরার পথে দেখা শ্রীপুর গ্রামের আম্বিয়া খাতুন (৪০), লস্কর বাড়ির আবকর হোসেন লস্কর (৪৫), ইমান আলী লস্কর (৪৮), আবুল হোসেন লস্কর (৪৪)সহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে। এদের প্রত্যেকেরই এখন দৈনিক ২০-৩০ টাকা উপার্জনই যেন ভাগ্যের ব্যাপার! কেউ কাঁকড়া ধরে, কেউ মাছ ধরে, কেউবা অন্যের কাজ করে জীবন চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর্থিক সংকটে পড়ে আকবর হোসেন লস্কর তার ৪০ হাজার টাকা দামের মোটরভ্যান বিক্রি করেছেন মাত্র ১৫ হাজার টাকায়। সেই টাকায় সংসার চলেছে কয়েকদিন। 

প্রতাপনগর গ্রামের বয়সী ব্যক্তি আবদুস সামাদ এলাকার কৃষি এবং চিংড়ির খামারের ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরে বলেন, এই এলাকায় প্রতি একরে ইরিধান হয় অন্তত ৫০ মণ। এর মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ৭৫ হাজার টাকা। অন্যদিকে আমনের একরপ্রতি ফলন ৪৫ মণ। এর মূল্য ৬২ হাজার টাকা। এই এলাকার কৃষকেরা এই পরিমাণ লোকসান করেছে। ইরি ও আমনের আবাদ ঠিকঠাক তুলতে পারলে এলাকার মানুষের সংকট থাকতো না। অন্যদিকে চিংড়ির এই দুটো মৌসুম চলে যাচ্ছে। প্রত্যেক চিংড়ি চাষি অন্তত আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা লোকসান গুনবে। কৃষি এবং চিংড়ির খামারে কাজকর্ম থাকলে এলাকার বহু মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি হতো। এখন সে সুযোগও নেই। এলাকায় জোয়ারের পানি ওঠানামা করায় কৃষি ও চিংড়ি আবাদ করা সম্ভব হয়নি।

পড়ুন প্রথম পর্ব: এখনও স্পষ্ট ধ্বংসের চিহ্ন

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়