ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

এখনও বাবার ভিডিও কলের অপেক্ষায় থাকে ইরাম

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৪, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২  
এখনও বাবার ভিডিও কলের অপেক্ষায় থাকে ইরাম

প্রতীকী ছবি

শিশু ইরামের চঞ্চল চোখ শুধুই বাবাকে খুঁজছে। বাকপ্রতিবন্ধী শিশুটি মায়ের কাছেও নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। সব সময় বাবার অপেক্ষায় আনমনে বসে থাকে ৯ বছরের মেয়েটি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবা কর্মস্থল থেকে মোবাইল ফোনে ভিডিও কলে তার সঙ্গে ইশারায় কথা বলত। কিন্তু এখন সন্ধ্যায় বাবার ভিডিও কল আর পায় না ইরাম। পাবে কী করে, বাসের কন্ডাক্টর যে তার বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মেরে ফেলেছে। অবুঝ ইরামের দিকে তাকিয়ে তার মা ডুকরে ডুকরে কাঁদেন। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় দিশেহারা মা।

গত ২০ জানুয়ারি ভাড়া নিয়ে তর্কের জেরে ইরফান নামের এক যাত্রীকে ফেলে দেয় গ্রীন বাংলা পরিবহন (প্রা.) লিমিটেডের বাসের কন্ডাক্টর মোজাম্মেল হক। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ইরফান। এ ঘটনায় তার স্ত্রী ইসমত আরা রাজধানীর ওয়ারী থানায় মামলা করেছেন। মামলা তদন্ত করছে ওয়ারী থানা পুলিশ। ঘটনার ১০ দিন পর গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের কোতয়ালী থানা এলাকা থেকে মোজাম্মেল হককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বর্তমানে সে কারাগারে আছে।

ইরফানের মা মোসা. মমতাজ বলেছেন, ‘৩২ বছর আগে আমার স্বামী মারা যান। তিন ছেলে আর এক মেয়েকে অনেক কষ্ট করে বড় করেছি। সেই ছেলেকে ওরা মেরে ফেললো। ওর ৯ বছরের একটা প্রতিবন্ধী মেয়ে আছে। স্ত্রী তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ওদের এখন কী হবে? কিভাবে চলবে ওরা?’

তিনি আরও বলেন, ‘ইরাম কথা বলতে পারে না। কিন্তু সন্ধ্যা হলে মোবাইল ফোন চায়। ওর বাবার সাথে কথা বলতে চায়। সন্ধ্যা হলে ফোন দেয় বাবাকে। ওর বাবা তো ফোন ধরে না। তখন আমাদের কাছে জানতে চায়, ওর বাবা কখন আসবে? তখন ওকে কী বলো সান্ত্বনা দেবো, বুঝতে পারি না।’

সেদিন কী ঘটেছিল, জানতে পেরেছেন কি না? এ প্রশ্নের জবাবে মমতাজ বলেন, ‘ওই বাসে আমাদের এক প্রতিবেশীও ছিল। সে তার বাসায় ফোন দিয়ে ঘটনা জানায়। পরে ওই বাসা থেকে লোকজন এসে খবরটি আমাদের জানায়। আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে ছেলেকে মৃত অবস্থায় পাই। পরে জানতে পারি, ইরফান বাসভাড়া দিয়েছিল। তারপরও কন্ডাক্টর এসে ভাড়া চায়। ইরফান কন্ডাক্টরকে একটা গালি দিয়ে বলে, তোকে না টাকা দিছি। সাথে সাথে কন্ডাক্টর তার সিনার ওপর ২-৩টা ঘুষি মারে। এতে ও দুর্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু বাসের অন্য যাত্রীরা কেউ কিছু বলেনি। পরে কন্ডাক্টর ওকে রাস্তায় ফেলে দেয়। ড্রাইভার দ্রুত গাড়ি নিয়ে চলে যায়। গাড়ি থেকে পড়ে আমার ছেলে পানি চাচ্ছিল। তখন একটি হোটেলের লোকজন সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ইরফানকে সালাউদ্দিন হাসপাতালে নিয়ে যায় তারা। সেখানে ওকে রাখেনি। পরে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যায়। ওইখানে ও মারা যায়।’

ইরফানের স্ত্রী ইসমত আরা বলেন, ‘আমার ৯ বছরের একটা প্রতিবন্ধী মেয়ে আছে। আমি অন্তঃসত্ত্বা। এ দুই বাচ্চাকে নিয়ে আমি কেমনে চলব? স্বামী কিছু রেখে যায়নি। শ্বশুরবাড়ির অবস্থাও ভালো না। বাবা-মা মারা গেছেন। আমি এতিম। আমি এখন কী করব? আমিও অসুস্থ। আমার এবং মেয়ের জন্য মাসে ৫-৬ হাজার টাকার ওষুধ লাগে।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেয়েটা ওর বাবার জন্য পাগল। প্রতিদিন ভিডিও কল করে। সবাইকে দেখতে পায়, কিন্তু ওর বাবাকে পায় না। তখন খুব কান্নাকাটি করে। মেয়েকে কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না যে, ওর বাবা আর নেই। বাবার শোকে মেয়ে কিছুই খাচ্ছে না। মেয়েকে যে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো, এমন সামর্থ্য আমার নেই।’

বাসের কন্ডাক্টর, ড্রাইভার, হেলপারের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চান ইসমত আরা। তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমার কী হবে? প্রধানমন্ত্রী যেন আমাদের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টি দিয়ে দেখেন।’

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়ারী থানার উপ-পরিদর্শক আব্দুল জলিল বলেন, ‘আসামিকে গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রামের কোতয়ালী থানাধীন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছি। পরদিন সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। বর্তমানে কারাগারে আছে। মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে দ্রুত আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করব।’

ইসমত আরার করা মামলায় বলা হয়, তার স্বামী রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন নবাবপুর আর রহমান মার্কেটে ফ্যানের দোকান তাহের অ্যান্ড সন্সে চাকরি করত। গত ২০ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে ইরফান ডেমরা থেকে গ্রীন বাংলা পরিবহনের বাসে করে নবাবপুরে যাওয়ার জন্য রওনা হন। ১১টা ১০ মিনিটের দিকে ইরফান ওয়ারী থানাধীন জয়কালী মন্দির রোডে পৌঁছালে বাসের কন্ডাক্টর মোজাম্মেল হকের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে মোজাম্মেল ইরফানকে কিল-ঘুষি ও লাথি মারে। একপর্যায়ে ইরফানকে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দেয় মোজাম্মেল। ইরফান রাস্তায় পড়ে মাথা, মুখ, বুক ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারায়। স্থানীয় লোকজন ইরফানকে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

মামুন/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়