ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বছরে পঙ্গু হচ্ছেন ১৫ হাজার মানুষ

মেসবাহ য়াযাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৮, ১৫ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১৮:২০, ১৫ মার্চ ২০২৩
বিভিন্ন দুর্ঘটনায় বছরে পঙ্গু হচ্ছেন ১৫ হাজার মানুষ

ছবি: প্রতীকী

দেশে ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে সড়ক দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় আহত রোগীদের বেশিরভাগই পঙ্গুত্ব-বরণ করেন। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দুর্ঘটনা পরবর্তী ৬ ঘণ্টার মধ্যে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না পাওয়ার কারণে বছরে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব-বরণ করছেন। এ ছাড়া, শিশু-কিশোরদের একটা বড় অংশ ছাদ বা গাছ কিংবা অন্যান্য জায়গা থেকে পড়ে পঙ্গু হচ্ছে। যুবকদের একটা বড় অংশ বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল বা গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব-বরণ করছে। 

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বুধবার (১৫ মার্চ) বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব পঙ্গু দিবস’। পঙ্গু হাসপাতালের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ৩২৪ জন রোগী। জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৬২ হাজার ৭১০ জন। এদের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২ লাখ ৬৪ হাজার ৭৭১ জন। ভর্তির রোগীদের মধ্যে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে ৩৫ হাজার ৬৯৫ জনের। হাসপাতালে ভর্তির পর মারা গেছেন ৭ হাজার ৩৩৮ জন।

২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে পঙ্গু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ হাজার ১৯৭ জন। ভর্তি হয়েছেন ২ হাজার ৩৯৭ জন। গত মাসে (ফেব্রুয়ারিতে) জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ৬ হাজার ৩০৮ জন এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৭৫ জন।

পঙ্গু হাসপাতালের বহির্বিভাগের চিকিৎসক ডা. মাহবুব হোসেন জানান, হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চারটি অস্ত্রোপচার কক্ষ রয়েছে। দ্বিতীয় তলায় একটি ইনফেকশন-জনিত ডার্টি অপারেশন থিয়েটার (ওটি) ও দুটি রুটিন অস্ত্রোপচার কক্ষসহ মোট ৫টি ওটি কমপ্লেক্স রয়েছে। এসব ওটিতে দৈনিক গড়ে ২৮০ থেকে ৩১০টির মতো অস্ত্রোপচার করা হয়। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পঙ্গু হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, এখানকার বহির্বিভাগে ১২টি কক্ষে দৈনিক গড়ে ১৫০ রোগী আসে। যার মধ্যে ফলোআপ চিকিৎসা নিতে আসাদের মধ্যে গড়ে ৭-১০ জন একেবারেই পঙ্গুত্বের শিকার হওয়ার মত পরিস্থিতি নিয়ে আসেন।

মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ এলাকার বাসিন্দা শামীম বাইক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসেন। তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি রাইজিংবিডিকে জানান, গত ৮ মার্চ বছিলা এলাকায় ট্রাকের সঙ্গে তার বাইকের দুর্ঘটনা ঘটে। সেই দুর্ঘটনায় তিনি হাঁটু ও গোড়ালিতে চোট পান। এরপর চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে আসা হয় রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর)।

হাসপাতালে খরচ সম্পর্কে তিনি জানান, ভর্তির টিকিট ১৫ টাকা আর বিছানা ভাড়া ফ্রি। বাকি সব নিজেদের কিনতে হচ্ছে। প্রতিদিন চার বার ইনজেকশন, সঙ্গে ওষুধ কিনে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। চিকিৎসক বলেছেন, সার্জারি করতে হবে। 

পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসক এবং অর্থোপেডিক সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, যেকোনও দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসা দিতে হয়। রক্তনালী ছিঁড়ে যাওয়া, হাড় ভাঙা, ওপেন ফ্র্যাকচার ও ইনফেকশনের চিকিৎসায় ৬ ঘণ্টার মধ্যে সেবা দিতে পারলে রোগীর প্রাণ বাঁচানোসহ পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয়। কিন্তু ঢাকার বাইরে নিটোরের মতো প্রতিষ্ঠান না থাকায় অধিকাংশ আহতরা সঠিক হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসাটা পান না।

আগারগাঁও এবং শ্যামলী এলাকায় পঙ্গু হাসপাতালের আশপাশে অর্থোপেডিক চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রি করেন এমন কয়েকজন দোকান মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। বাইপোলার হিপ সার্জিক্যালের দাম আগে ছিল ৬ হাজার টাকা, বর্তমানে যার দাম ৭ হাজার। মডুলার বাইপোলারের দাম ৪০ হাজার থেকে বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৪৫ হাজার টাকায়। এছাড়াও পায়ের গোড়ালি, পায়ের পাতায় ব্যথা ব্যবহৃত ভারতীয় টাইনর কোম্পানির ফুট ড্রপ ৭০০ টাকার স্থলে এখন এক হাজার টাকা। সার্ভাইক্যাল কলার ২০০ টাকা থেকে বর্তমানে ৩০০ টাকা। নি-ক্যাপের দাম ছিল ২০০ টাকা, এখন হয়েছে ৩৫০। নি-ব্যাচের দাম ১৮০০ থেকে বেড়ে ২৬০০ টাকা হয়েছে। ওয়াকিং স্টিক তিন মাস আগে ৪০০ টাকায় বিক্রি হলেও এখন বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় আহত রোগীর চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে গড়ে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ। ব্যান্ডেজ, প্লাস্টার, ওষুধপত্র, চিকিৎসা সরঞ্জামসহ সব কিছুর দাম অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে, বড় রকমের সার্জারি করতে গেলে রোগী বা তার পরিবারের পক্ষে খরচ সামলাতে কঠিন হয়ে পড়ে। পায়ের গোড়ালি, হাঁটু বা হিপে প্রতিস্থাপন সরঞ্জামের দাম বেড়েছে অন্তত ২০ শতাংশ। ইচ্ছে থাকলেও টাকার অভাবে অনেকে এসব চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এভাবে চললে দেশে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের হার আরও বাড়বে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

অর্থোপেডিক সোসাইটির মহাসচিব অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম রাইজিংবিডিকে বলেন, মহাসড়কে দুর্ঘটনায় আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিতে ২০১০ সালে ৬টি ট্রমা সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। যেগুলো রয়েছে কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রামে। কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এসব সেন্টারে  প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক, ভাস্কুলার সার্জন, অ্যানেসথেসিস্ট, নার্স, যন্ত্রপাতি, অস্ত্রোপচার কক্ষ, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)-এর সংকট রয়েছে। এতে করে তাৎক্ষণিকভাবে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান মতে, বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জনের মৃত্যু ছাড়াও প্রায় ৮০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব-বরণ করছে। তাদের হিসাব মতে, কেবল ২০২২ সালে এক বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৮১ শতাংশ। অপরদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। আর বাংলাদেশে মারা যায় ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। 

২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ঢাকা শহরে পঙ্গু ভিক্ষুকদের মধ্যে ৮৩ শতাংশই বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনার শিকার। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান রাইজিংবিডিকে বলেন, সড়ক নিরাপদের বিষয়ে মুখে যেভাবে বলা হচ্ছে, কার্যত সেভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এসব দুর্ঘটনা কমিয়ে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য কী করণীয়, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। এ ব্যাপারে কেবল সদিচ্ছা এবং কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করলেই সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি দেশে পঙ্গুত্বের হার কমবে বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।

ঢাকা/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়