ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

সর্বজনীন পেনশন: মুহিতের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলেন কামাল

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩১, ১৯ আগস্ট ২০২৩   আপডেট: ০৮:৫৮, ১৯ আগস্ট ২০২৩
সর্বজনীন পেনশন: মুহিতের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলেন কামাল

আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং আ হ ম মুস্তফা কামাল

বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে, তিনি জীবদ্দশায় সর্বজনীন পেনশন বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি।

আবুল মাল আবদুল মুহিত অকপটে অনেক কথা বলে ফেলতেন। সেটা কারো পছন্দ হোক আর না হোক। সত্যটা বলতে তিনি দ্বিধা করতেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছিলেন, আমি সরকারি চাকরি শেষে যখন পেনশন তুলতে গিয়ে নানা ধরনের আইনি জটিলতার মুখে পড়েছিলাম। অবশ্য, পেনশন তোলা নিয়ে নানা ধরনের ভোগান্তির কথা আগে থেকেই জানতাম। তা প্রত্যক্ষ করলাম নিজের পেনশন তুলতে গিয়ে। সেই সময় থেকে আমার পরিকল্পনা ছিল, কোনোদিন সুযোগ পেলে পেনশন ব্যবস্থা ভোগান্তিহীন করব।

তিনি বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি এ বিষয়ে কাজ করার অনুমতি দিয়েছেন। আশা করছি, আগামী বাজেটে এ বিষয়ে কিছু একটা বলতে পারব। তবে, প্রক্রিয়টা অনেক দীর্ঘ। এটা বাস্তবায়ন করতে একটু সময় লাগবে। আমার সময়কালে সর্বজনীন পেনশন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেবো।

সাবেক অর্থমন্ত্রী ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ভবিষ্যতে প্রবীণদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। সেজন্য পেনশন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্রাচ্যুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধা নেই।

তিনি বলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমার পাশাপাশি গড় আয়ু বাড়ার কারণে জনমিতিক কাঠামো বদলে যাচ্ছে। এতে প্রবীণদের সংখ্যা এবং মোট জনগোষ্ঠীতে তাদের অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে, নগরায়নের কারণে একক পরিবারের সংখ্যাও বাড়ছে। এর ফলে ভবিষ্যতে প্রবীণদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন হওয়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, সরকারের একার পক্ষে এই ঝুঁকি মোকাবিলা সম্ভব নয়। সকল শ্রমজীবী মানুষসহ প্রবীণদের জন্য একটি সর্বজনীন ও টেকসই পেনশন পদ্ধতি প্রবর্তন এখন সময়ের দাবি। এ লক্ষ্যে আমরা পেনশন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনার কথা ভাবছি। এতে ভবিষ্যতে যোগদানকারী সকল সরকারি চাকরিজীবীর জন্য বিদ্যমান পেনশন পদ্ধতি পরিবর্তন করে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে পেনশন পদ্ধতি চালু করব। পর্যায়ক্রমে আধা-সরকারি ও ব্যক্তি খাতে আনুষ্ঠানিকভাবে এবং অনানুষ্ঠানিক বা স্বকর্মে নিযুক্ত মানুষসহ সকল স্তরের জনগোষ্ঠীর জন্য সরকার নিয়ন্ত্রিত একটি সমন্বিত কাঠামোর আওতায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা প্রণয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। বেসরকারি খাতের ডিপিএস (ডায়নামিক পেনশন সার্ভিস) ব্যবস্থার আদলে সর্বজনীন একটি পেনশন ব্যবস্থা কিভাবে করা যায়, সে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

আবুল মাল আবদুল মুহিতের সেই ঘোষণার পর থেকে নানা পর্যায় অতিক্রম করার পর গত ১৭ আগস্ট (বৃহস্পতিবার) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রত্যাশিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উদ্যোগ বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের হাত ধরে বাস্তবায়ন হলো।  

জাতীয় সংসদের বিগত অধিবেশনে আইনটি পাস হওয়ার পর গত ৩১ জানুয়ারি আইনটিতে সম্মতি দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। ১৩ আগস্ট আইনটির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা ২০২৩ জারি করেছে সরকার। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ১৮ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সী সব নাগরিক তাদের জন্য প্রযোজ্য পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তারা পাসপোর্টের ভিত্তিতে পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।

যেসব নাগরিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছেন, তারা এই পেনশনের আওতায় আসতে পারবেন না। তবে, তারা যদি এই সুবিধা ত্যাগ করেন, তাহলে পেনশন কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারবেন। উল্লেখ্য, সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বেশ কয়েকটি কর্মসূচি চালু আছে। এর মধ্যে আছে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রভৃতি।

এ কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাওয়া যাবে। চাঁদা পরিশোধের পর পেনশনার মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর হওয়া পর্যন্ত পেনশন পাবেন। ৫০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকরাও পেনশন স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। তবে, সে ক্ষেত্রে স্কিমে অংশগ্রহণের তারিখ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে। 

বিধিমালায় বলা হয়েছে, স্কিমের আওতায় চাঁদাদাতা স্কিমের স্বত্ব অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারবেন না। তবে, স্কিম চলাকালীন কেউ মারা গেলে মনোনীত নমিনির নামে হস্তান্তর করা যাবে। এছাড়া, চাঁদাদাতা তার মোট জমানো অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। এটি ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

চার ক্যাটাগরিতে পেনশন স্কিম বাস্তবায়ন করা হবে। মাসিক চাঁদা ধরা হয়েছে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা (এ ক্ষেত্রে সরকার দেবে আরও ৫০০ টাকা) থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। স্কিম পরিবর্তন এবং চাঁদার পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগ থাকছে। পেনশন ব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। সব কর্মকাণ্ড হবে অনলাইনে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করেও চাঁদা দেওয়া যাবে। 

চার ক্যাটাগরির পেনশন স্কিমের মধ্যে আছে—প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাস স্কিম’, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘গ্রগতি স্কিম’, অনানুষ্ঠানিক খাতে বা স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের (কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, রিকশাচালক ইত্যাদি পেশার) জন্য ‘সুরক্ষা স্কিম’ এবং স্বল্প আয়ের নাগরিকদের জন্য ‘সমতা স্কিম’।

সমতা স্কিমের বিষয়ে বিধিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক সময় সময় প্রকাশিত আয়সীমার ভিত্তিতে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের ব্যক্তি, যাদের বর্তমান বার্ষিক আয়সীমা অনূর্ধ্ব ৬০ হাজার টাকা, তারা এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন।

সমতা স্কিমে চাঁদাদাতার অনুকূলে সরকারি অর্থ জমা প্রদানের বিষয়ে বিধিমালায় বলা হয়েছে, সমতা স্কিমে সরকারি অংশ প্রদানের জন্য যথেষ্ট অর্থ আছে কি না বা যথেষ্ট অর্থ না থাকলে এ বাবদ কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে, পেনশন কর্তৃপক্ষ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে নির্ধারণ-পূর্বক প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদাপত্র অর্থ বিভাগে পাঠাবে এবং অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় অর্থ দেবে।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, ধারাবাহিক তিনটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাব স্থগিত হবে। পরবর্তী সময়ে পুরো বকেয়া কিস্তি পরিশোধ না করা পর্যন্ত হিসাবটি সচল হবে না। নির্দিষ্ট তারিখে চাঁদা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী এক মাস পর্যন্ত জরিমানা ছাড়াই পরিশোধ করা যাবে। এরপর প্রতিদিনের জন্য ১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে হিসাবটি সচল করা যাবে। আগাম কিস্তিও পরিশোধ করা যাবে। অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে ১২ মাস পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলেও পেনশন হিসাব স্থগিত হবে না।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো চাঁদাদাতা ৭৫ বছরের আগে নিখোঁজ হলে এবং নিখোঁজ হওয়ার পর ৭ বছর অতিবাহিত হলে তার হিসাব স্থগিত করে নমিনিকে টাকা ফেরত দেওয়া হবে। এছাড়া, কেউ চাঁদা প্রদানকালে শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে স্থায়ী বা সাময়িকভাবে অর্থ উপার্জন করতে না পারলে তাকে অসচ্ছল চাঁদাদাতা ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেবে।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু উপলক্ষে ইতোমধ্যেই পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট চালু হয়েছে। ওয়েবসাইটের ঠিকানা- https://upension.gov.bd। এতে বলা হয়েছে, ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করে আপনার ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন।’ ওয়েবসাইটের ঠিকানায় পেনশন স্কিমগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। আগ্রহী যে কেউ এই ওয়েবসাইটে বিস্তারিত জানতে পারবেন।

/রফিক/  

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ