দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
কী ভাবছেন তৃণমূলের ভোটাররা
জাহাঙ্গীর আলম বকুল || রাইজিংবিডি.কম
![কী ভাবছেন তৃণমূলের ভোটাররা কী ভাবছেন তৃণমূলের ভোটাররা](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2023December/8585-2401051246.jpg)
আগামী ৭ জানুয়ারি সারা দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে। এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৯টি দলের মধ্যে ২৭টি অংশ নিচ্ছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নিবার্চন নিরপেক্ষ হবে না— এমন অভিযোগ করে অন্যতম বড় দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলসহ (বিএনপি) বাকি দলগুলো অংশ নিচ্ছে না। এতে নিবার্চনে মাঠে উত্তেজনা অনেকটাই কম। যদিও সরকারে থাকা দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচন উৎসবমুখর এবং অংশগ্রহণমূলক করার চেষ্টা চলছে।
এবারের নির্বাচনে ২৯৯ আসনে ১ হাজার ৮৯৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, যার বড় অংশই স্বতন্ত্র প্রার্থী। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের নেতা। তাদের মধ্যে বর্তমান সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীও আছেন। নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি ২৮৩টি আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিলেও ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে অংশ নিচ্ছে।
ফলে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর; যারা মূলত আওয়ামী লীগের নেতা। তবে, এবারের নির্বাচনে ভোটারদের বড় অংশই নতুন, যারা সংখ্যায় দেড় কোটিরও বেশি। তারা ভোটের মাঠে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এবারের নির্বাচনে বিএনপিসহ ২২টি দল অংশ না নেওয়ায় ভোটারদের বড় অংশই ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন না বলে ধারণা করা হচ্ছে। সঙ্গে বিএনপি ভোট বর্জনের ডাক দিয়ে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। এতে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করা সরকার এবং আওয়ামী লীগের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ অথবা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আছে। এ সময়ে সরকার দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৃহৎ উন্নয়ন প্রকল্প যেমন বাস্তবায়ন করেছে, মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে; তেমনই বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ, বিরোধী পক্ষের ওপর দমন-পীড়ন, দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের লাগামহীন অপতৎপরতা জনগণের মনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। ভোটের মাধ্যমে জনগণ সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে বলেও শঙ্কা আছে।
আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের সরকারে রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে তাদের দুজন নেতা সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু, সেখানকার ভোটারদের অভিযোগ, তারা ১৫ বছরে সংসদ সদস্যকে চোখে দেখেননি। এ আসনের বর্তমান এমপি মনসুর রহমান এবার দলের মনোনয়ন পাননি। তিনি নির্বাচনও করছেন না। নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদ দারা। তিনি ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে এখানকার সংসদ সদস্য হন।
সম্প্রতি এই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগ নেতা ওবায়দুর রহমান ভোট চাইতে গেলে দুর্গাপুর উপজেলার যুগিশো গ্রামের বাসিন্দা রাশেদা বেগম বলেন, ‘ফুল ফোটে লতার মাঝে, সময় হলে মানুষ টেনে নেয় বুকের মাঝে। আপনি হলেন সেই ফুল। এখন আমরা আপনাকে বুকের মাঝে টেনে নেবো। কিন্তু, আপনার কাছে গেলে আমাদের বুকে টেনে না নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন না। ভোট কার কাছে আছে? ভোট আছে পা-ফাটা এই মানুষের কাছে। আমরা তুলতেও পারি, ফেলতেও পারি।’
এবারের নির্বাচনে প্রায় ১২ কোটি ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ কোটি নারী। নারী ভোটাররা ব্যাপক সংখ্যায় ভোট দিতে গেলেও তারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন না। নোয়াখালী পৌর বাজারে প্রতিদিন ভিক্ষা করেন নুরুন নেছা। ভোটদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। পছন্দ ও অপছন্দ বুঝি না। আমার ঘরের পুরুষ যাকে দিতে বলবে তাকেই দেবো।’
তবে, এর ব্যতিক্রমও আছে। নোয়াখালীর অবস্থাপন্ন ঘরের গৃহিণী রেহানা আক্তার জানালেন, তার ওপর পরিবার থেকে চাপ নেই। তিনি পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে তার কাছে গুরুত্ব পাবে প্রার্থীর কোয়ালিটি। তার শিক্ষা, যোগ্যতা, এলাকার জন্য কাজ করার স্পৃহা— এসব বিষয় বিবেচনায় নেবেন।
পঞ্চগড় শহরের বাসিন্দা মারজাহান বেগম নামের একজন স্কুল শিক্ষিকা বলেন, শিক্ষাকে যিনি গুরুত্ব দেবেন, তাকেই ভোট দেবেন। পরিবার থেকে কাউকে ভোট দেওয়ার জন্য চাপ নেই। আমার পছন্দে ভোট দেবো।
হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ, বাহুবল, চুনারুঘাট, মাধবপুর উপজেলার পাহাড়ি অঞ্চল। এ অঞ্চলে ৪১টি চা বাগান আছে। এসব বাগানে বাসিন্দা প্রায় ২ লাখ। দীর্ঘকাল থেকে চা শ্রমিকরা মূলত নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে থাকেন। যদিও সময়ের সঙ্গে এ ধারা পাল্টে যাচ্ছে।
কাদের ভোট দেবেন— এমন প্রশ্ন করা হলে তারা তাদের দাবির বিষয় সামনে আনেন। কয়েকজন ভোটার জানান, তাদের ভূমির অধিকার দিতে হবে। এছাড়া, তাদের অনেক দাবি আছে। যারা এসব দাবি পূরণ করতে পারবেন, তাদের ভোট দেবেন।
চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা বাগানের বাসিন্দা এক শ্রমিক জানান, তিনি এবার আর নৌকায় ভোট দেবেন না। তার চেয়ে ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমনকে ভোট দেবেন। কারণ, তাকেই এখানকার বাসিন্দারা কাছে পায়। ব্যারিস্টার সুমন নিজ উদ্যোগে এলাকার উন্নয়নে কাজ করছেন।
তবে, নির্বাচন নিয়ে অনেক শ্রমিকের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়নি। উপজেলার দেউন্দি চা বাগানের বাসিন্দা লক্ষ্মীচরণ মুন্ডা, মদন সাঁওতাল, মাগরী ভৌমিজ, জামিনী রিকিয়া চন, দ্বিবাকর উড়াং বলেন, ‘ভোট এসেছে। ভোট চলে যাবে। আমাদের ভাগ্যে তেমন পরিবর্তন আসেনি। ভোট দিয়ে আমাদের কী লাভ?’
বিএনপি ছাড়া এই নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। খুলনা শহরের বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মো. শাকির শেখ বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হলে ভোট দিতে যেতে পারি। আমরা সেটাই চাই। ভোট আমার নাগরিক অধিকার। ভোটের মাধ্যমে দেশে শান্তি আসুক।’
একই কথা বলেন সাতক্ষীরার পল্লী চিকিৎসক রাসেল গাজী। তিনি বলেন, ‘৭ জানুয়ারি ভোট দেবো, ইনশাআল্লাহ। ভোট নষ্ট করা যাবে না। ভোট দেওয়া আমার নাগরিক অধিকার। কেন্দ্রে সুষ্ঠু পরিবেশে বজায় না থাকলে ভোট দেওয়া সম্ভব না। আমি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন কামনা করি।’
এবারের নির্বাচনে দেড় কোটি নতুন ভোটারের সমর্থন যেকোনো রাজনৈতিক দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই নতুন ভোটাররা পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে ভোটের রাজনীতিতে ভূমিকার রাখবেন। এখানে আওয়ামী লীগ এগিয়ে আছে। গত দেড় যুগ বিএনপি ভোটের মাঠে না থাকায় নতুন ভোটাদের কাছে বিএনপি অনেকটা অচেনা। তবে সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন না হওয়ায় হতাশা আছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাসলিম সাবা বলেন, ‘এটা হতাশার—সব দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারছে না। এতে আমরাও যথাযথভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। গণতন্ত্রের জন্য এটা সুখকর নয়।’
নোয়াখালীর কলেজছাত্রী সামিহা সাঈদ বলেন, ‘কখনো ভোট দিইনি। এবার প্রথম ভোট দেবো। বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচরা করে যে যোগ্য তাকেই দেবো। তবে, প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা গুরুত্ব পাবে।’
আপনি কেন ভোট দেবেন— এ প্রশ্নের জবাবে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার ভোটার বাবুল মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা ভোট দিই। এবারও ভোট দিয়ে আমাদের প্রতিনিধি বানাব। দেশের উন্নয়নের জন্য যিনি যোগ্য লোক, সব সময় জনগণের পাশে থাকেন, গরিব-দুখী মানুষের উন্নয়নের কাজ করতে পারেন; ভোট দিয়ে তাকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করব।’
খুলনা শহরের পূর্ব রূপসা ঘাটের সাধারণ মাঝি মো. ফজলু মাতুব্বরও এমন কাউকে ভোট দিতে চান, যিনি সুখে-দুখে তাদের সঙ্গে থাকবেন, এলাকার উন্নয়নে কাজ করবেন। তবে, তিনি শান্তি চান। তিনি বলেন, ‘দেশটাকে ভালোবাসি এ কারণে ভোট দিতে যাব। তবে, সন্ত্রাস ও দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবো।’
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহীর প্রতিনিধি শিরীন সুলতানা কেয়া, খুলনার প্রতিনিধি নুরুজ্জামান ফকির, সুনামগঞ্জের প্রতিনিধি মনোয়ার চৌধুরী, নোয়াখালীর প্রতিনিধি সুজন মাওলা, হবিগঞ্জের প্রতিনিধি মো. মামুন চৌধুরী)
/রফিক/
- ৬ মাস আগে চক্রান্তকারীদের সুরে কথা বলছেন ওয়ার্কার্স পার্টির বাদশা
- ৬ মাস আগে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় পরাজয় রাঙ্গার
- ৬ মাস আগে মুন্সীগঞ্জে প্রতিপক্ষের বাড়িতে হামলা-ভাঙচুর, গরু-টাকা লুট
- ৬ মাস আগে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে : লতিফ সিদ্দিকী
- ৬ মাস আগে বরিশালে পুলিশি বাধায় পন্ড বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মিছিল
- ৬ মাস আগে নৌকার সমর্থকদের মারধর: বাকেরগঞ্জ স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি গ্রেপ্তার
- ৬ মাস আগে পঞ্চগড়ে যুবলীগ নেতাকে মারধর: গ্রেপ্তার ৩
- ৬ মাস আগে স্থগিত আসনে নৌকা প্রতীকের নিলুফার জয়ী
- ৬ মাস আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী ওলিও’র বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার মানহানি মামলা
- ৬ মাস আগে গৌরীপুরে স্থগিত কেন্দ্রে ভোট শনিবার
- ৬ মাস আগে ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন আর চা-শ্রমিকদের ভোটই ব্যবধান গড়েছে
- ৬ মাস আগে নেতাকর্মীদের বিভক্তি-দ্বন্দ্বে হেরেছেন মমতাজ
- ৬ মাস আগে যে কারণে হারলেন স্বপন ভট্টাচার্য
- ৬ মাস আগে মহিববুর হলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী
- ৬ মাস আগে ভোট পুনঃগণনার দাবি করলেন নৌকার প্রার্থী শহিদুল ইসলাম
আরো পড়ুন