ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

হবিগঞ্জ-৪ আসনে ‘নৌকা ডুবির’ ব্যবচ্ছেদ

ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন আর চা-শ্রমিকদের ভোটই ব্যবধান গড়েছে 

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৭, ১২ জানুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৭:৩১, ১৩ জানুয়ারি ২০২৪
ত্যাগীদের অবমূল্যায়ন আর চা-শ্রমিকদের ভোটই ব্যবধান গড়েছে 

সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী ও নবনির্বাচিত এমপি সায়েদুল হক

হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর) আসনে আ.লীগের প্রার্থী টানা দুবারের সংসদ সদস্য মাহবুব আলীকে পেছনে ফেলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। নির্বাচনের এই জয়-পরাজয় নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে চলছে নানা আলোচনা। এবারের নির্বাচনে নৌকার হেভিওয়েট প্রার্থী মো. মাহবুব আলীর পরাজয়ের অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম- ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা এবং চা-বাগানের ভোটারদের এবার নৌকা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া।

স্থানীয় আ.লীগ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে একই ঘরানার দুজন প্রার্থী হওয়ার কারণে দলের নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি ব্যারিস্টার সুমন চা-শ্রমিকদের ভোটের পাশাপাশি এলাকার তরুণ সমাজ ও নতুন ভোটারদের সমর্থন পান। অন্যদিকে, সাবেক বিমান প্রতিমন্ত্রীর পাশে ছিলেন না স্থানীয় আ.লীগের নেতাকর্মীরা। এমনকি, নৌকার ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত সেই চা-বাগানের শ্রমিকেরাও এবার তাকে সে অর্থে ভোট দেননি। তার হারের পেছনে এগুলোই মূল কারণ ছিল বলে জানান স্থানীয়রা। 

আরো পড়ুন:

ছন্দ্রিছড়া চা-বাগানের বাসিন্দা নতুন ভোটার কিরণ সাঁওতাল বলেন, এলাকায় ফুটবল খেলাসহ নানা বিনোদনের আয়োজন করে ব্যারিস্টার সুমন তরুণদের কাছে টানেন। তিনি এখানকার তরুণদের আইডল।

চুনারুঘাট-মাধবপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ-৪ আসন। দুই উপজেলা মিলে মাহবুব আলীর নৌকা পেয়েছে ৬৯ হাজার ৮৪৩ ভোট। আর ব্যারিস্টার সুমন ঈগল পাখি প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১ লাখ ৬৯ হাজার ১০০ ভোট। ভোটের ব্যবধান প্রায় এক লাখ।

দলের সাধারণ কর্মীরা বলেন, চুনারুঘাট ও মাধবপুরের কয়েকজন উঠতি নেতার কারণে দলের প্রবীণরা কোণঠাসা ছিলেন। দল বা এলাকার প্রয়োজনে প্রবীণ নেতারা প্রতিমন্ত্রীর ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেননি। তারা মন খুলে কথা বলারও সুযোগ পাননি। অপরদিকে, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দলের পদধারীদের নানা বিষয় নিয়ে মতবিরোধ ছিল মাহবুব আলীর। এসব বিরোধ বা ব্যবধান মেটাতে নির্বাচন-পূর্ব কোনও ভূমিকা নেননি তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একাধিক নেতা বলেন, প্রতিমন্ত্রী আ.লীগ সমর্থিত ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও কয়েকজন সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে ১০ বছর কাটিয়েছেন। আর কারও সঙ্গে দেখা বা কথা বলার প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। মাধবপুর উপজেলা আ.লীগের সাবেক সভাপতি শাহ মুসলিম ও চুনারুঘাট উপজেলা সভাপতি অ্যাড. এম আকবর হোসেইন জিতু গত ১০ বছর ধরে প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি।

গত উপজেলা নির্বাচনে দলের টিকিট না পেয়ে চুনারুঘাট আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের স্বতন্ত্র নির্বাচন করে অল্প ভোটে হেরে যান। সেই সঙ্গে দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তিনি ছিলেন স্থানীয়ভাবে দলের গ্রহণযোগ্য নেতা। নির্বাচনে শাহ মুসলিম, আকবর হোসেইন জিতুসহ তাদের বিপুল সংখ্যক সমর্থক প্রতিমন্ত্রী থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। তবে, আবু তাহের নৌকার সঙ্গে ছিলেন ঠিকই। কিন্তু তেমন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়নি।

হবিগঞ্জ-৪ আসনে ভোটার ৫ লাখ ১২ হাজার ৩০৮ জন। এ আসনে বিগত সময়গুলোতে বরারবই নৌকা মনোনীত প্রার্থী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আসছেন। এবারের নির্বাচন কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছিলেন আকবর হোসেইন জিতু, শাহ মুসলিম, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী এনামুল হক মোস্তফা শহীদ-পুত্র নিজামুল হক রানা, সাবেক বিচারপতি আব্দুল হাইয়ের পুত্র ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল হাই রাজীব, মাধবপুরের সন্তান জাকির হোসেন চৌধুরী অসীমসহ ৫ থেকে ৬ জন নেতা। তবে, মনোনয়নবঞ্চিত কেউই মাহবুব আলীর পক্ষে ‘জোরালো’ ভূমিকা নেননি।

এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে দলমত নির্বিশেষে সকলকে কাছে টেনে নেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। বিশেষ করে তরুণরা ব্যারিস্টার সুমনকে সবচেয়ে বেশি ‘হাইলাইড’ করেন। এলাকায় পুল-কালভার্ট স্থাপনা করে আরও আগেই সাধারণ মানুষের কাছাকাছি চলে যান তিনি। তরুণ ভোটাররা ঝুঁকে পড়ে সুমনের দিকে।

মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান বলেন, প্রতিমন্ত্রী ১০ বছর ধরে এ আসনের সংসদ সদস্য। ২০১৮ সালে মন্ত্রী হওয়ার পর এলাকায় কম আসতেন। যে কারণে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এটাই তার পরাজয়ের মূল কারণ। পাশাপাশি তার প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যারিস্টার সুমন এলাকার তরুণ ভোটারদের কাছে টানতে পেরেছেন। তরুণরাই ছিলেন তার মূল শক্তি।

হবিগঞ্জ-৪ আসনকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বিবেচনা করা হয়। কারণ, স্বাধীনতার পর থেকে আসনটিতে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরাই বেশিরভাগ সময় জয় পেয়েছেন। চা-বাগান অধ্যুষিত দুটি উপজেলায় চা-শ্রমিকদের ভোট আছে লাখখানেক। অন্যদিকে বিবেচনা করলে, এই জয়-পরাজয়ের মূলে বড় অংশ চা-শ্রমিকদের ভোট। কিন্তু নৌকার প্রার্থী এবার সেই ভোট টানতে পারেননি।

মাধবপুর সুরমা চা-বাগানে চা-শ্রমিক ভোটার ৩ হাজার ৯০১ জন। নির্বাচনে ভোট দেন ২ হাজার ৪০৪ জন। এতে নৌকা পায় ১ হাজার ৩৬০ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল পায় ৯১১ ভোট। এখানে নৌকার বিপরীতে ঈগলের এ ভোট পাওয়াকে বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখছেন স্থানীয় রাজনীতিকরা। 

লস্করপুর ভ্যালির সভাপতি ও বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক রবীন্দ্র গৌর বলেন, এবার নৌকার পাশাপাশি ঈগলেও ভোট দিয়েছেন পাহাড়ি আদিবাসী ও চা-শ্রমিকরা। আদর্শের চিন্তা থেকে এ ভোট দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে ক্ষোভ থেকে। এ ক্ষোভ ছিল বিমান প্রতিমন্ত্রীকে চা-শ্রমিকদের পাশে না পাওয়ার। তিনি এলাকায় আসতেন কম। যে কারণে তার সঙ্গে সাধারণ চা-শ্রমিকদের দূরত্ব বাড়ে।

চুনারুঘাটের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানের ত্রিপুরা পল্লীর হেডম্যান চিত্তরঞ্জন দেববর্মা বলেন, মন্ত্রীকে আমরা পাশে পাইনি। পেয়েছি ব্যারিস্টার সুমনকে। তাই পাহাড়িরা তাকে ভোট দিয়েছেন।

এর আগে, সায়েদুল হক সুমন বিজয়ের পর তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, এলাকার তরুণ ও চা-শ্রমিকদের ভোট আমি পেয়েছি। এ বিজয় সত্যিই আনন্দের। এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে দুটি উপজেলার আট লাখ মানুষের দায়িত্ব নিয়েছি। এখন তাদের পরামর্শে এলাকার উন্নয়নে কাজ করাই মূল উদ্দেশ্য। 

এ বিষয়ে জানতে মো. মাহবুব আলীর সঙ্গে কথা বলতে যোগাযোগ করলেও সাড়া মেলেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাধবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি শাহ মোহাম্মদ মুসলিম, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বহরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন, জগদিশপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মাসুদ খান, একই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বাবুল হোসেন, শাহজাহানপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি লিয়াকত আলী, মাধবপুর উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক আতাউস সামাদ, চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি রজব আলীসহ অসংখ্য নেতাকর্মী সুমনের পক্ষে কাজ করেন।

চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট আকবর হোসেইন জিতু বলেন, এক মাস ধরে অসুস্থ ছিলাম। যে কারণে নির্বাচনি প্রচারে যেতে পারিনি। তবে আমি মনে করি, চুনারুঘাট আওয়ামী লীগে কোনও কোন্দল নেই। হয়তো মন্ত্রী তৃণমূলের সঙ্গে সঠিকভাবে যোগাযোগ করতে পারেননি। এ কারণে এবার নৌকায় ভোট দেয়নি লোকজন।

সায়েদুল হক ও মাহবুব আলী ছাড়াও এ আসনে অপর ছয় প্রার্থী ছিলেন- আবু ছালেহ (ইসলামী ঐক্যজোট), আহাদ উদ্দিন চৌধুরী (জাতীয় পার্টি), মোহাম্মদ আবদুল মমিন (ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ), মো. মোখলেছুর রহমান (বিএনএম), মো. রাশেদুল ইসলাম (বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট) এবং সৈয়দ মো. আল আমিন (বাংলাদেশ কংগ্রেস)।

মামুন/ফয়সাল/এনএইচ

সম্পর্কিত বিষয়:

ঘটনাপ্রবাহ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়