ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৫ মে ২০২৫ ||  জ্যৈষ্ঠ ১ ১৪৩২

ন্যায্য মূল্য পান না পেঁয়াজচাষি, মজুতদারদের পোয়াবারো

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ১০ মে ২০২৫   আপডেট: ১৩:১১, ১০ মে ২০২৫
ন্যায্য মূল্য পান না পেঁয়াজচাষি, মজুতদারদের পোয়াবারো

ফাইল ফটো

বর্তমানে বাজারে দেশি পেঁয়াজের দাম কেজি প্রতি ৫৫ থেকে ৬৫ টাকা। কিন্তু, চাষিরা এমন উচ্চমূল্য পাননি। চাষির ঘরে এখন পেঁয়াজ নেই। মৌসুমের শুরুতেই ২০ থেকে ৩০ টাকায় তারা পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীদের কাছে। এখন সেই পেঁয়াজই দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। মুনাফা যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারদের পকেটে। 

শনিবার (১০ মে) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ফরিদপুরের পেঁয়াজ চাষি সফিউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন রাইজিংবিডি ডটকমের এ প্রতিবেদক। সফিউল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমার ক্ষেতে ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু, ২২ টাকার চেয়ে বেশি দাম পাইনি। হিমাগারে জায়গা সংকটের কারণে পেঁয়াজ সংরক্ষণ করতে পারিনি। আজ যখন পেঁয়াজের কেজি ৬০ টাকা, তখন আমার ঘর ফাঁকা।” 

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৩৬ লাখ টন। উৎপাদন হয়েছিল ৩৪ লাখ ১৭ হাজার টন। এ অর্থবছরে পেঁয়াজ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৮ লাখ টন। চলতি মৌসুমে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন প্রত্যাশিত মাত্রার কাছাকাছি হয়েছে। এবার উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৩৬ লাখ টন। কিন্তু, সমস্যা দেখা দিয়েছে সংরক্ষণে। হিমাগারে জায়গা সংকটের কারণে কৃষকরা দ্রুত পেঁয়াজ বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে, তারা ন্যায্য মূল্য পাননি। এখন বাজারে সেই পেঁয়াজই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে, পেঁয়াজের মজুতদারদের পোয়াবারো।

যাত্রাবাড়ীর পাইকারি ব্যবসায়ী জামাল হোসেন বলেছেন, “চাষিরা দ্রুত পেঁয়াজ বিক্রি করেন। তখন আমরা মজুত করি। এখন দাম বাড়ার পেছনে সরবরাহ কমে যাওয়া অন্যতম কারণ।”

এ বিষয়ে কৃষি উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “এ বৈষম্য আমাদের কৃষিব্যবস্থার বড় দুর্বলতা। কৃষক উৎপাদন করেন ঠিকই, কিন্তু ন্যায্য মূল্য পান না। অন্যদিকে, কিছু ব্যবসায়ী মজুতের মাধ্যমে ফায়দা লুটে নেন। এটা রোধ করতে হলে উৎপাদন থেকে বাজার পর্যন্ত একটি সুসংহত কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।”

তিনি জানান, সরকার কৃষক পর্যায়ে সংরক্ষণ-সুবিধা নিশ্চিত করতে চায়। পেঁয়াজের জন্য পৃথক হিমাগার স্থাপনের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে কৃষক এভাবে ঠকবেন না।

এই বাজার ব্যবস্থায় বিপাকে আছেন ভোক্তা ও উৎপাদক দু’পক্ষই। লাভ হচ্ছে কেবল মধ্যস্বত্বভোগী ও মজুতদারদের। 

রাজধানীর বাসিন্দা সানজিদা শ্যামা বলেছেন, চৈত্র মাসে শুনেছি, কৃষকরা পেঁয়াজ ফেলেও দিয়েছেন দাম না পেয়ে। এখন কিনতে হচ্ছে ৬০ টাকা দিয়ে! তাহলে কার লাভ, কার ক্ষতি?

তিনি বলেন, বাংলাদেশের কৃষকরা প্রতি মৌসুমেই একই রকম ভুক্তভোগী হন—উৎপাদন করে লোকসান, আর বাজারে সেই পণ্য বিক্রি হয় চড়া দামে। পেঁয়াজের বর্তমান পরিস্থিতি আবারও প্রমাণ করল, উৎপাদন বাড়লেই কৃষকের লাভ বাড়ে না। বাজার ব্যবস্থাপনা সুসংহত না হলে কোনো লাভই কৃষকের ঘরে পৌঁছায় না। সময় এসেছে, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের কথা নয়, কাজ দেখানোর।

ভোক্তাদের সংগঠন সচেতন নাগরিক মঞ্চের আহ্বায়ক শামীমা হক বলেন, পেঁয়াজের বাজার একটি চক্রের হাতে। এখানে স্বচ্ছতা নেই। কৃষককে রক্ষা করতে হলে উৎপাদন-পরবর্তী ন্যায্য বিপণন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতেই হবে।

বাংলাদেশে উৎপাদিত পেঁয়াজের বড় অংশ মৌসুম শেষে সংরক্ষণ করা যায় না। দেশে বিদ্যমান হিমাগারগুলো মূলত আলু সংরক্ষণের জন্য নির্মিত, যা পেঁয়াজ সংরক্ষণের উপযুক্ত নয়। কৃষকরা তাই কম দাম পেলেও বাধ্য হয়ে আগেই বিক্রি করেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. ফিরোজ কবির বলেছেন, কৃষক দাম না পেলে চাষে অনাগ্রহী হয়ে পড়েন। এতে ভবিষ্যতে উৎপাদন কমে যাবে। তখন বিদেশি পেঁয়াজ আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়বে। এই চক্র রোধ করতে হলে উৎপাদনকারীকে লাভ দিতে হবে। 

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ হিমাগার নির্মাণ করতে হবে। কৃষকদের জন্য ভর্তুকিসহ মজুত-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল কৃষি বিপণন চালু করে সরাসরি বিক্রির সুযোগ করে দিতে হবে। মজুদার ও বাজার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ সরবরাহ করতে হবে।

ঢাকা/রফিক


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়