দেশে প্রথমবার উন্নত ব্রয়লারের জাত উদ্ভাবন
শেখ মহিউদ্দিন আহাম্মদ || রাইজিংবিডি.কম
বাউ-ব্রো-হোয়াইট ও বাউ-ব্রো-কালার নামে উন্নত জাতের ব্রয়লার
শেখ মহিউদ্দিন আহাম্মদ
ময়মনসিংহ, ২০ জানুয়ারি : বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের একদল গবেষক বাউ-ব্রো-হোয়াইট ও বাউ-ব্রো-কালার নামে উন্নত জাতের ব্রয়লারের দুইটি জাত উদ্ভাবন করেছেন।
বাংলাদেশে প্রথম দেশি মুরগির স্বাদ পাওয়া যাবে ব্রয়লার (মাংস উৎপাদনকারী) এই জাতের মুরগিতে। এবং ব্রয়লারের মাংস হবে দেশি মুরগির মতো শক্ত ও সুস্বাদু এমনই গুণাগুণ সম্পন্ন।
নতুন উদ্ভাবিত ব্রয়লার মুরগির জাত দুটির উদ্ভাবক অধ্যাপক ড. আশরাফ আলী ও সহযোগী অধ্যাপক ড. বজলুর রহমান মোল্যা ১৬ জানুয়ারি এক সেমিনারে এসব তথ্য জানান।
গবেষণার ফলাফল তুলে ধরতে পশুপালন অনুষদীয় গ্যালারিতে এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেমিনারে পশুপালন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল ওয়াদুদের সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাকৃবির ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. রফিকুল হক।
জাত দুটির উদ্ভাবক অধ্যাপক ড. আশরাফ আলী ও সহযোগী অধ্যাপক ড. বজলুর রহমান মোল্যা সেমিনারে জানান, এর ফলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্রয়লার উৎপাদনে খরচ কমবে এবং উৎপাদন বাড়বে।
গবেষকগণ আরো জানান, ব্রয়লারের বাচ্চা উৎপাদনে আমাদের নিজস্ব কোন প্যারেন্ট স্টক না থাকায় বাইরের দেশ থেকে প্যারেন্ট স্টক আমদানিতে প্রতিবছর ব্যয় হয় প্রায় ৯০ কোটি টাকা। দেশিয় মুরগির জার্মপ্লাজম ও প্রচলিত উন্নত জাতের সিনথেটিক ব্রয়লারের সমন্বয়ে উদ্ভাবিত নতুন ব্রয়লার দুইটি দেশে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করলে ওই আমদানি খরচ সাশ্রয় হবে।
এছাড়াও নতুন জাতগুলোর রোগবালাই ও মৃত্যুহার কম হওয়ায় দেশিয় লালন-পালন ব্যববস্থাপনায় কম খরচে বিদেশে সিনথেটিক ব্রয়লারের মতোই উৎপাদন পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন উদ্ভাবক অধ্যাপক ড. আশরাফ আলী ও ড. বজলুর রহমান মোল্যা।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বিএআরসি) এসপিজিআর প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৬৫ লাখ টাকা ব্যয়ে পরিচালিত ‘দেশে প্রাপ্ত মুরগির জার্মপ্লাজম ব্যবহার করে ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক উদ্ভাবন’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে চার বছর গবেষণা শেষে বাউ-ব্রো হোয়াইট ও বাউ-ব্রো কালার নামে ব্রয়লারের জাত দুইটি উদ্ভাবনে সফলতা পান গবেষকবৃন্দ।
নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলোর একদিনের বাচ্চার ওজন, খাদ্য রুপান্তর দক্ষতা, ৩৫ দিনে ওজন (১.৫ কেজি) বাজারে প্রচলিত ব্রয়লারের মতোই।
অপরদিকে মৃত্যু হার কম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি এবং লালন-পালন ব্যবস্থাপনা প্রচলিত ব্রয়লারের চেয়ে সহজ ও সাশ্রয়ী। ফলে উৎপাদনে লাভজনক।
গবেষণা কাজে সহযোগিতা করেন পিএইচডি শিক্ষার্থী উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা গোলাম আজম।
উদ্ভাবিত ব্রয়লার সম্পর্কে গবেষণার প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. আশরাফ আলী বলেন, ‘আমাদের দেশে বাণিজ্যিক হ্যাচারিগুলো প্রতিবছর কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক বাইরের দেশ থেকে আমদানি করে বাচ্চা উৎপাদন করে ব্রয়লার উৎপাদনের জন্য। অন্যদিকে বাইরে থেকে আমদানিকৃত প্যারেন্ট ব্রয়লার শীতপ্রধান দেশের উপযোগী করে তৈরি হওয়ায় দেশিয় আবহাওয়ার সাথে খাপ খায়িয়ে নিতে সমস্যা হয়। ফলে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের মধ্যে বিশেষ লালন-পালন ব্যবস্থাপনায় ওইসব প্যারেন্ট স্টককে লালন-পালন করায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পায়। ফলে বাচ্চার দাম তুলনামূলক বেশি। অপরদিকে ওই সকল স্টকের রোগবালাই বেশি এবং বাইরে থেকে আনার সাথে সাথে বিভিন্ন নতুন নতুন রোগের জীবাণু দেশে বহন করে নিয়ে আসে। যার উৎকৃষ্ট উদাহারণ এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জ (বার্ড ফ্লু)।
অন্যদিকে বাজারে প্রচলিত ওইসব ব্রয়লারের মাংস অত্যধিক নরম ও দেশীয় মুরগির মতো সুস্বাদু না হওয়ায় অনেকে পছন্দ করেনা। এ সকল বিষয় বিবেচনা করে আমাদের নিজস্ব ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক তৈরি করার লক্ষ্য নিয়ে চার বছর দেশিয় মুরগির জার্মপ্লাজম ও প্রচলিত উন্নত জাতের সিনথেটিক ব্রয়লারের মোরগ-মুরগি থেকে ক্রমানয়ে গুণগত বাছাই ও প্রজননের মাধ্যমে নতুন দুইটি ব্রয়লারের প্যারেন্ট স্টক অথ্যাৎ জাত উদ্ভাবনে সফল হয়েছি। যার উৎপাদন ক্ষমতা দেশের বাইরে থেকে আমদানিকৃত অন্যান্য উন্নতমানের ব্রয়লার প্যারেন্টের সমকক্ষ।’
তিনি আরও বলেন, ‘মজার বিষয় হল-উদ্ভাবিত প্যারেন্ট স্টকগুলো দেশে প্রচলিত মুরগির ঘরেই লালন-পালন করে কাঙ্খিত উৎপাদন পাওয়া যাবে। কোন শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণ ঘরের প্রয়োজন নেই। সেই সাথে প্রয়োজন নেই কোন ব্যয়বহুল টিকাদান কর্মসূচির। অন্যদিকে প্রচলিত ব্রয়লারের মতোই আমাদের উদ্ভাবিত ব্রয়লার ৫ সপ্তাহে দেড় কেজি ওজনের হয়ে থাকে। তবে নতুন ব্রয়লার গুলোর মৃত্যু হার কম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও ড্রেসিং (জীবন্ত ওজন হতে মাংসের শতাংশ) শতাংশ বেশি প্রচলিত ব্রয়লার হতে।’
গবেষণার সহযোগী গবেষক ড. বজলুর রহমান মোল্যা বলেন, ‘আমাদের দেশে অধিকাংশ ভোক্তাই বাজারে গিয়ে রঙিন মুরগি অথ্যাৎ দেশি মুরগি খুঁজে থাকেন। এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা দুই ধরনের মাংস উৎপাদনকারী (ব্রয়লার) মুরগির জাত উদ্ভাবন করেছি। দেশিয় মুরগি ও বাজারে প্রচলিত উন্নত মানের সিনথেটিক ব্রয়লারের সাথে মিল রেখেই জাত দুটি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বাউ-ব্রো-কালার মুরগির মাংস অনেকটা দেশি মুরগির মতো শক্ত প্রকৃতির এবং স্বাদের। অন্যদিকে বাউ-ব্রো-হোয়াইটেরও মাংস প্রচলিত ব্রয়লারের মাংস থেকে তুলনামুলক শক্ত এবং সুস্বাদু। তবে নতুন উদ্ভাবিত ব্রয়লার ও প্রচলিত ব্রয়লারের মাংসের পুষ্টিমানের কোন পাথর্ক্য নেই। বর্তমানে ব্রয়লারের জাত দুইটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত। বাজারে প্রচলিত ব্রয়লারের বাচ্চার চেয়ে কম দামে উদ্ভাবিত ব্রয়লারের বাচ্চা খামারিদের হাতে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।’
ড. মোল্ল্যা আরো বলেন, ‘বর্তমানে জাত দুইটির আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতির লক্ষে জেনেটিক্সের মলিকুলার পর্যায়ে কিছু কাজ করা হচ্ছে। উদ্ভাবিত ব্রয়লার জাতগুলো দ্বারা দেশের আমদানি নির্ভর ব্রয়লার শিল্পকে রপ্তানি শিল্পে রুপান্তর করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। সেই সাথে দেশের প্রাণিজ আমিষের ঘাটতিও অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব।’
রাইজিংবিডি / সোহাগ
রাইজিংবিডি.কম