খুন হয়েছিলেন আবুল ফজল
শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম
শাহ মতিন টিপু : আবুল ফজল। পুরো নাম শেখ আবুল ফজল আল্লামি। বলা হয়, আবুল ফজল আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম চিন্তাবিদ। তার জীবনকাল ১৫৫১-১৬০২। তার খ্যাতি ও পরিচিতি বহুমুখী- একাধারে রাজনীতিবিদ, যোদ্ধা, ইতিহাসবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, লেখক, অনুবাদক ও কবি। আবুল ফজল ছিলেন সম্রাট আকবরের প্রধানমন্ত্রী। ওই রাজকার্যে তার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে স্বীকৃত হতো। তিনি সম্রাট আকবরের একজন গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুও ছিলেন।
আবুল ফজলের ধর্ম ছিল মানবতা। হিন্দু, মুসলমান, পারসি, খ্রিষ্টান সবাই তার কাছে সমান ছিল। তার উদার চিন্তাভাবনা, সমাজভাবনা ও ধর্মচিন্তা বিচার করে তাকে চিরায়ত আধুনিক সমাজবিজ্ঞানী বলা যায়। আবুল ফজল যদি কেবল নিজের লিখনী চালিয়েও যেতেন, তবু তিনি একজন অমর সাহিত্যিক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকতেন। ‘আকবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরি’ তার বিস্ময়কর অবিস্মরণীয় বই।
আবুল ফজল ছিলেন অসাধারণ সহজাত মেধার অধিকারী, অল্প বয়সেই তিনি বয়সের তুলনায় অধিক বোধশক্তির পরিচয় দেন। সে যুগের সবচেয়ে কৃতী বিদ্বানদের অন্যতম তার পিতার কাছে আবুল ফজল শিক্ষালাভ করেন। শেখ মোবারক ছিলেন শেখ আবুল ফজলের বাবা। সমকালে তিনি ছিলেন মহান প্রজ্ঞাবান পণ্ডিত।
১৫৫১ সালের ১৪ জানুয়ারি আগ্রায় আবুল ফজলের জন্ম । তার বড় ভাই ফৈজিরও জন্ম আগ্রায়। শৈশব ও কৈশোরে তার অসাধারণ পাণ্ডিত্যের খবর ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। স্বয়ং সম্রাট আকবর তার বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করেন আবুল ফজলের দিকে। ফলে ১৫৭৫ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে মোগল রাজদরবারে যোগদান করেন সরাসরি মন্ত্রী হিসেবে। আর তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। প্রথম থেকেই যুবরাজ জাহাঙ্গীর প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতেন তাকে। আনারকলিকে নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির কারণে তিনি আবুল ফজলের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেন। এ সময় তার বিশ্বস্ত সেনাপতি বীর সিংহ বুন্দেলার মাধ্যমে ১৬০২ সালের ২২ আগস্ট শাহজাদা সেলিম আবুল ফজলকে খুন করেন। তিনি তখন দাক্ষিণাত্য থেকে রাজধানীতে ফিরছিলেন। মৃত্যুর আগে আবুল ফজল বলেন যান যে, তিনি নির্দোষ। ইলিয়াস খানই আনারকলিকে সম্রাট আকবরের বাহিনীর হাতে তুলে দেন।
অন্যদিকে এস ওয়াজেদ আলী ‘ধর্ম ও সমাজ’ বইতে লিখেন, ‘আবুল ফজল ‘দীনে এলাহির’ মন্ত্র বাদশাকে শিখিয়ে ছিলেন বলে বাদশার জীবদ্দশাতেই শাহজাদা সেলিম তার শিরশ্ছেদ করেন এবং সেই মূল্যবান মস্তকটি পায়খানার গর্তে নিক্ষেপ করেন। আকবরের মৃত্যুর পর দীনে এলাহির নাম আর ভারতবর্ষে শোনা যায় না।’ (ধর্ম ও সমাজ-পৃঃ ৫৪, নবযুগ সংস্করণ-২০১২)
আবুল ফজল বাঙ্গাল ও বাঙ্গালাহ নামের উৎপত্তি সম্পর্কে তার আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘বাঙ্গালাহ’র আদি নাম ছিলো ‘বঙ্গ’। প্রাচীনকালে এখানকার রাজারা ১০ গজ উঁচু ও ২০ গজ বিস্তৃত প্রকান্ড ‘আল’ নির্মাণ করতেন। এ থেকেই ‘বাঙ্গাল’ এবং ‘বাঙ্গালাহ’ নামের উৎপত্তি।’
১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শাসক দাউদ খান কাররানির মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা সম্পূর্ণ রূপে সুবাহ হিসেবে মুঘল শাসনের অধীনস্থ হয়, দিল্লীর মসনদে তখন ক্ষমতায় সম্রাট আকবর। সে সময় প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষে কৃষি ও ভূমি কর বা খাজনা আদায় হতো ইসলামি হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাতেও তাই। অথচ কৃষিকাজ সম্পাদিত হয় সৌরবর্ষ তথা সৌরমাসের হিসেবে। কিন্তু হিজরী সন নির্ভরশীল হলো চাঁদের উপর, সঙ্গত কারণেই কর আদায় আর কৃষি ফলনের সময় সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছিল না। চন্দ্রবর্ষ সম্পূর্ণ হয় ৩৫৪ দিনে আর সৌরবর্ষ ৩৬৫ দিনে। সে কারণে ৩১ চন্দ্র বছর হলো ৩০ সৌর বছরের সমান।
আকবরের মন্ত্রী এবং বিজ্ঞ সভাসদ আবুল ফজল একদিন সম্রাটকে একান্তে এই বাস্তবতা বোঝালেন। সম্রাট আকবর বিষয়টি অনুধাবন করলেন এবং এই গরমিল থেকে সরে আসার জন্য প্রাচীন বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। সম্রাটের আদেশে নবরত্নসভার বিশিষ্ট একজন এবং তৎকালীন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজি চান্দ্রমাস নির্ভর হিজরী বর্ষপঞ্জি এবং সৌরমাস নির্ভর হিন্দু বর্ষপঞ্জি গবেষণা করে একটি নতুন বর্ষপঞ্জি প্রস্তাব করেন। সে মতে সম্রাট ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ (৯৯২ হিজরী সনে) একটি ফরমান জারি করেন এবং নতুন বর্ষপঞ্জি প্রতিষ্ঠা করেন, যার নাম দেয়া হয় তারিখ-ই-ইলাহী। তবে ঐ ফরমানে বলা হয় নতুন এই পদ্ধতি কার্যকর ধরা হবে পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধে হিমুকে পরাজিত করে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের ঐতিহাসিক দিনটি থেকে। দিনটি হলো ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ ( ১০ রবিউল আউয়াল ৯৬৩ হিজরি) ।
ঐ ফরমানে আরও উল্লেখ ছিলো ৯৬৩ হিজরীর প্রথম মাস অর্থাৎ মহররম মাসের সমসাময়িক সময়ই নতুন বর্ষ পঞ্জির ৯৬৩ তম বছরের প্রথম মাস ধরা হবে। সে সময় প্রচলিত ভারতীয় পুরাতন বর্ষপঞ্জি ‘শকাব্দ’ অনুসারে মহরম মাসের সমসাময়িক মাস ছিল বৈশাখ এবং ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ (বর্তমানে প্রচলিত ইংরেজী বর্ষপঞ্জি) অনুযায়ী মাস ছিল এপ্রিল। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল নতুন বর্ষপঞ্জির (ধরে নেয়া যায়, বঙ্গাব্দের) ৯৬৩ বর্ষের ১লা বৈশাখ ধরা হলো। এভাবে আকবর একটি কেন্দ্রীয় ইলাহি সন তৈরি করিয়েছিলেন, অনুমান করা যায় এই ইলাহী সন বাস্তবায়নের ফরমান অনুসারেই একই কাঠামো বজায় রেখে বাংলা সন চালু হয়। আকবর তার তারিখ-ই-ইলাহী অনুসারে যেসব আঞ্চলিক সন প্রবর্তন করেন (উড়িষ্যার আমলি সন, বিলায়েতি সন, সুরাসানি সন ইত্যাদি) তাদেরকে বলা হয় ‘ফসলি সন’। বাংলা সনও তেমনি একটি ‘ফসলি সন’ যা পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করা হলেও এর গঠন-পদ্ধতি ভারতীয় শকাব্দের (ভারতীয় উপমহাদেশে বহুলপ্রচলিত এক প্রাচীন সৌর অব্দ) মতো, তবে শকাব্দের সমগোত্রীয় নয়। শকাব্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক এইটুকুই, এর মাস ও দিনের নাম শকাব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। শকাব্দ অনুযায়ী বছরের প্রথম মাস ছিল চৈত্র। আর বাংলা সনের প্রথম মাস বৈশাখ। বাংলা সন প্রকৃতপক্ষে একেবারেই স্বকীয়। আমাদের এ অঞ্চলে ২৪টির মতো সন ছিল। সেসব সন রাজা-বাদশাহ, ধর্ম বা সীমিত অঞ্চলের কিন্তু বাংলা সন বাংলাদেশ ও জাতির নামে।
হিজরি এবং বঙ্গাব্দ ৯৬৩ সনে একই বছর ধরলেও বর্তমানে সময়ে (১৪২১ বঙ্গাব্দ এবং ১৪৩৫ হিজরি) আরবী এবং বাংলা সনের পার্থক্য ১৪ বছরের মত। এর মূল কারণ চন্দ্র বর্ষ সৌর বর্ষ হতে ১১ দিন কম। কিন্তু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে বাংলা ক্যালেন্ডারের পার্থক্য এখনও একই (৫৯৩ বছর), কারণ দুটোই সৌরবর্ষ অনুসরণ করে থাকে।
সম্রাট আকবর ছিলেন একজন মহানুভব, দায়িত্বশীল শাসক। একটানা ৪৮ বছর তিনি মোঘল সাম্রাজ্য শাসন করেছেন। তার মধ্যে কোনো নিচতা ছিল না। সব ধর্মের সারবস্তু নিয়ে তিনি দীনে এলাহি ধর্মের প্রবর্তন করেছিলেন ভারত বর্ষে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে; কিন্তু তার এই কর্মকান্ড ইসলামের মূল স্তম্ভের ওপর আঘাত করেছিল বলে মুসলমান সমাজ আকবরের পদক্ষেপ মেনে নিতে পারেনি। এই একটি কারণে আকবর বিশাল মুসলমান সাম্রাজ্যে অপ্রিয় সম্রাট রূপে পরিগণ্য হয়ে আছেন। এই পদক্ষেপ আকবরের কাণ্ডজ্ঞানের বিচ্যুতি হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে।
আবুল ফজলের বড় ভাই মহাকবি ফৈজিও দরবারের প্রভাবশালী আমাত্য ছিলেন। সম্রাটের নবরত্নসভার প্রভাবশালী দুই সদস্য ছিলেন এই সহোদর। আবুল ফজলের মতো বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তি। অঙ্ক, জ্যামিতি; ভূগোল, ইতিহাস, ধর্মশাস্ত্র, রন্ধন প্রক্রিয়া, সামরিক আইন, মুসলিম আইন এবং কোরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যায় তিনি কেবল ভারতবর্ষেই শ্রেষ্ঠত্বের স্বাক্ষর রাখেননি, সমসায়মিক তাবৎ দুনিয়ায় তিনি বিখ্যাত ছিলেন তার কর্মের কারণে। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের রাজকীয় ইতিহাস আকবরনামা তিনি রচনা করেছেন। মোগলদের বংশ পরিচয়, রাজ্য শাসন, বিচার ব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়, বণ্টন, সামরিক বিষয়াদি, যুদ্ধযাত্রা, যুদ্ধ জয়, কূটনৈতিক বিষয়সমূহ কী নেই এতে? এত নিখুঁতভাবে সব কিছু বর্ণনা করেছেন যে, প্রতিটি অক্ষরের মধ্যে সম্রাট আকবর যেন জীবন্ত হয়ে আছেন।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ আগস্ট ২০১৫/টিপু
রাইজিংবিডি.কম