ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পন্ডিচেরি: বঙ্গোপসাগরের তীরে ফরাসি কলোনি  

হোমায়েদ ইসহাক মুন  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৫, ৮ জুন ২০২৩  
পন্ডিচেরি: বঙ্গোপসাগরের তীরে ফরাসি কলোনি  

রক বীচ, পন্ডিচেরি শহরের প্রধান আকর্ষণ

ভোরবেলা কলকাতা নিউমার্কেট থেকে হেঁটে হেঁটে ফেয়ারলি হাউজে গিয়ে লাইন ধরলাম। ২০ জনের পরে শালিমার টু চেন্নাই করমন্ডল এক্সপ্রেসের কনফার্ম টিকিট পেয়ে গেলাম। তার আগে কল্যাণদার ভাগনে শিয়ালদা স্টেশনে এসে আমার ঢাউস সাইজের ব্যাগ নিয়ে গেলো বারাকপুরে। সেখান থেকেই বাকি পথের যাত্রা শুরু হবে। টিকিট কেটে জিপিও দিয়ে যাওয়ার সময় পোস্টাল স্ট্যাম্প আর কয়েন দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না। এখনো কলকাতায় লোকে স্ট্যাম্প খুব আগ্রহ নিয়ে কেনে, তবে পরিমাণে কমে গেছে অবশ্যই। 

পরদিন রবিবারের সকাল, দক্ষিণেশ্বরের আদ্যাপিঠ মন্দিরের কাছে বরুনদার বাড়িতে খুব সুন্দর একটা সময় কাটালাম পুরোটা দিন। এত সুন্দর বাড়ি, ফুলের সমারোহ, বই আর পেঁচার সংগ্রহ, আর পাহাড়ের বিস্তর অভিজ্ঞতা ভরা ঝুলি। খুব যত্ন করে দাদা মাংস রান্না করলো- দারুণ স্বাদ হয়েছিল! বেশ আড্ডা জমে উঠলো; দাদার কাছের দুই বন্ধু তাদের দুরন্তপনার সব গল্প বলছিলেন।

রক বীচের কিনারায় গান্ধী স্ট্যাচু 

করমন্ডল এক্সপ্রেস ছাড়ার সময় বিকেল ৩.২০। বেশ ঘুরে ফিরে শালিমার স্টেশনে যেতে হলো। পথে অনুপমের সাথে দেখা। দশ বছর আগে আমরা একসাথে সান্দাকফু পাহাড়ে হেঁটেছিলাম। গঙ্গা নদী পার হয়ে শ্রিরামপুর স্টেশন থেকে হাওড়া, তারপর ট্যাক্সি করে শালিমার। ট্রেনে ওঠার আগে দুপুরের খাবার খেতে স্টেশনের বাইরে যেতে হলো। তেমন ভালো কোনো হোটেল খুঁজে না পেয়ে ঢুকে গেলাম সামনে যা এলো। মাছ-ভাতের অর্ডার করে বসে বসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ গল্পের নায়কদের দেখছিলাম। বামুন একজন মেসিয়ার সবাইকে খাবার দিচ্ছিলেন- নাম নন্দকুমার। তার ছেলে অগ্নি সঙ্গে কাজ করে। আরো ছেলেমেয়ে আছে তার। এই হোটেলে সে বিশ বছর ধরে কাজ করছে। নতুন আর ভিন্ন মানুষদের জানতে আমার বরাবরই ভালো লাগে। তাই নিজেই কথা শুরু করে দিলাম। বাপ-ছেলের একটা ছবি তুলে রাখলাম। স্টেশনের পাশে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ এর গল্পের চরিত্র হাজিরি ঠাকুর আর গল্পের অন্যান্য চরিত্রের মতো এরাও কাজ করে যায় জীবনের গতিতে।  

বগিতে দেশের ৫ জনকে পেলাম। চোখের চিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাচ্ছে। করোনা মহামারীর পরে প্রায় সাড়ে তিন বছর পর লম্বা সফর শুরু করলাম। প্রথমবারের মতো সাউথের দিকে যাত্রা। ট্রেন এখন কোন স্টেশনে আছে, কত মিনিট লেট, সব কিছু দেখা যায় ‘হোয়ার ইজ মাই ট্রেন’ অ্যাপে। এই ট্রেন চেন্নাই পর্যন্ত পাড়ি দেবে ১৬৫৯ কিলোমিটার। প্রথম রাত গেলো, তারপর সারাদিন পার করে এক ঘণ্টা লেটে পরদিন সন্ধ্যা ৬টায় করমন্ডল এক্সপ্রেস নামিয়ে দিলো ডক্টর রাম চান্দ্রান সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনে। 

স্কুটি নিয়ে লেখক

নেমেই দিল্লির টিকিট করে নিলাম। স্টেশন থেকে বের হয়ে মেট্রোরেলে অশোক নগর যেতে হবে। রাজেন্দর আগেই সব বলে দিয়েছিল। সেখান থেকে দিনেস আমাকে বাইকে তুলে নিলো। খুব পরিপাটি শহর বলা যায় চেন্নাই। রাজেন্দর সঙ্গে পরিচয় আমার হিমাচলের পাহাড়ে। এখন সে পাহাড়েই আছে তাই তার রুমমেটদের সাথে ভাব জমালাম। সবাই চলচ্চিত্রকর্মী, সংস্কৃতিমনা। বেশ গল্প হলো সিনেমা নিয়ে, তারা নিজেরাই একটা ফিচার ফিল্ম তৈরি করছে, কাজ প্রায় শেষের পথে। পরদিন ভোরে পন্ডিচেরির বাস ধরলাম। 

লাগাতার বাস যায় পন্ডিচেরির পথে। আমাদের কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ দিয়ে টেকনাফ যেতে যেমন সমুদ্রের কিনারা ঘেঁষে যেতে হয়, এখানেও আদিগন্ত সমুদ্রের তীর ধরে ছুটে চলেছে বাস। ঠিক জানালার কিনারে বসে আছি, গরম আর ঠান্ডার মিশেলে হাওয়া এসে চোখে মুখে লাগছে আর বারবার অই দিগন্তের রেখায় হারিয়ে যাচ্ছি। বঙ্গোপসাগরে সাঁতার কাটার রোমাঞ্চকর সেই মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ছে। চার ঘণ্টায়  নামিয়ে দিলো ফ্রেন্স কলোনির শহর আর বঙ্গোপসাগর ঘেরা পন্ডিচেরিতে। ভাড়া নিলো ১৮০ রুপি। 

ফ্রেন্স কলোনির নান্দনিক স্থাপত্যশৈলিতে তৈরি হোয়াইট টাউন 

মুকুন্দর সঙ্গে পরিচয় ১২ বছর আগে, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে বেসিক কোর্সের সময়ে। এখন আমেরিকা থাকে, কিন্তু আমি চেন্নাই আসবো শুনে সে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে তার বন্ধু মেথিউয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। পন্ডিচেরি নেমে কোথায় কি করতে হবে সব খোঁজখবর দিলো মেথিউ। বাসস্টপ থেকে ফ্রেন্স কলোনি বা সমুদ্রপাড়ে যাতায়াত করতে লোকাল ট্রন্সপোর্টে যা খরচ হবে স্কুটি ভাড়া নিলে তেমনই পড়বে। কেরালায় আয়ুর্বেদের ছাত্র  রাহাতও আমাকে বলল, এ অঞ্চলে লোকাল ট্রন্সপোর্টের ব্যয় একটু বেশি। স্কুটি নিয়ে নিলে সব দিকে সুবিধা হবে। এদিকে আমার স্কুটি চালানোর অভিজ্ঞতা হলো ঢাকা শহরে কেবলমাত্র ৩ দিন। এটুকু ভরসা নিয়ে এমন অচেনা শহরে অন্যের স্কুটি, কোথায় কি হবে ভাবতে শুরু করলাম। বাস স্টেশনের কাছেই রেন্ট এর দোকান পেলাম। মেথিউ তামিল ভাষায় তাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ভালো একটা বাইক দিতে বলল। ৮৫০ রুপি আর পাসপোর্ট কপি দিয়ে দুই দিনের জন্য স্কুটি নিয়ে নিলাম আধা লিটার তেল সমেত। ৫০০ রুপি জামানত হিসেবে রাখতে হলো। বাইকের ছবি তুলে ম্যাপ অন করে চলতে শুরু করলাম। তেল ভরতে একটু উল্টা দিক যেতে হলো। এরপর এনিস হোস্টেল খুঁজতে রক বিচের পথে রওনা হলাম। 

গুগল ভাইকে এনিস হোস্টেল খুঁজে দিতে বলে আমার পশ্চাতদেশ ব্যথা করে ফেললাম বাইকে চক্কর কাটতে কাটতে। অথচ হোস্টেলের সামনে দিয়েই বারকয়েক চালিয়ে গেলাম। ব্যাকপেকারদের জন্য এমন হোস্টেল খুবই আদর্শ। বাজেটের মধ্যে, সুন্দর পরিপাটি, এয়ারকন্ডিশন, রান্নাঘর আছে। চাইলে খাবার রান্না করেও খেতে পারবে। কাঠের বাংকার বেড সাথে এটাচড বাথরুম। বিকেল ৪টা বেজে গেছে কিছু খাওয়াও হয়নি। বিকেলের আলোটা না পেলে কিছু দেখতে আর ছবি তুলতেও পারবো না। কালকে সকালে অরুভেলির পথে রওনা হবো। 

স্থাপত্য, আলোছায়া আর প্রকৃতির মিশেলে হারিয়ে যাওয়া 

আমি রুমে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই তারুন আর গণেশ দুই বন্ধু এলো। অন্ধ্রপ্রদেশে তাদের বাড়ি। দুজনই গ্রাফিক্স ডিজাইনার। ৫মিনিটেই খাতির জমে গেলো। ওদের বলে দিলাম আমি বেরুচ্ছি, তোমরা ফ্রেশ হয়ে বিচের দিকে এসে আমায় কল করো। এখানে বেশ কয়েকটা বিচ আছে তার মধ্যে রকবিচ বেশি পপুলার। বিশাল বিশাল কালো পাথর দিয়ে ঘেরা এই বিচ। গান্ধী স্ট্যচু, লাইট হাউজ, বাহারি খাবারের দোকান, তালিকায় আরো অনেক কিছু আছে। (চলবে)

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়