চতুর্থ পর্ব
দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান
ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম
ঘুম থেকে উঠে দেখি নিশু আপুর মেসেজ। তিনি লিখেছেন, ‘শাকিল আমি থামেলের হোটেল মালবেরিতে আছি। সকাল এগারোটার দিকে এসো।’
আজ চার অক্টোবর। সকালের নাস্তা করে থামেলে চলে এলাম। আমি আগে কখনো হোটেল মালবেরিতে যাইনি। তবে ঠিকানা অনুযায়ী আমি জায়গাটা আগে থেকেই জানি। ২০১৭ সালে যখন হিমলুং পর্বত অভিযানে এসেছিলাম তখন হোটেল হলি হিমালয়াতে ছিলাম। মালবেরি হলি হিমালয়া হোটেলের পাশেই।
থামেল চক থেকে হেঁটেই যাচ্ছি। হোটেল মালবেরির আগের গলি দিয়ে যাচ্ছি। গলিতে তেমন মানুষজন নেই। একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে এগিয়ে এলো। থামেলের গলিতে গলিতে এ রকম কুকুর দেখাটা অস্বাভাবিক নয়। নিয়মিতই কুকুর দেখা যায়। আমি পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে কুকুরটি দৌড়ে এসে আমার ডান পায়ের হাঁটুর নিচে কামড়ে ধরলো। আমি ভয় পেয়ে পা ঝাকি দিয়ে সড়িয়ে নিলাম। কাঁধে ব্যাগ ছিল। ব্যাগ দেখিয়ে কুকুরটিকে তাড়িয়ে দিলাম। পরে ভালো করে খুঁজে দেখলাম কোথাও কুকুরের দাঁতে ক্ষত হয়েছে কিনা? তেমনটা হয়নি। এমনকি প্যান্টও ফুটো হয়নি। ভয় পেয়ে গেলাম- ভ্যাকসিন নিতে হবে কিনা কে জানে!
পড়ুন তৃতীয় পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান
হোটেল রিসিপশনে ভদ্রমহিলাকে গিয়ে বললাম, নিশাত মজুমদার নামে বাংলাদেশী এক গেস্ট আছে আপনাদের এখানে। আমি তার সাথে দেখা করতে এসেছি। ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, আপনি বসুন। আমি ম্যামকে জানাচ্ছি। তিনি রুম চেক-ইন লিস্ট দেখে নিশু আপুর সাথে কথা বলে আমাকে জানালো, আমাকে বসতে বলেছেন। আমি বসে চারপাশটা দেখছিলাম। নিশু আপু অল্প সময়ের মধ্যেই চলে এলেন। আমি সোফা থেকে উঠে আপুর দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই এক গাল হাসি দিয়ে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেন। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতোটা ধকল গেছে ভয়ঙ্কর এই অভিযানে। মানাসলু কী পরিমাণ পরখ করেছে পর্বতারোহীদের। সানবার্নে মুখটা পুড়ে একদম কালো হয়ে গেছে। ঠোঁট ঠান্ডায় ফেটে চৌচির। চোখে এক সমুদ্র ক্লান্তি। মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে ফিরে আসার ভয়টাও স্পষ্ট।
লবিতে বসে আপু আমার অভিযানের বিষয়ে জানতে চাইলেন। আমিও দারুণ উৎসাহ নিয়ে অভিযানের গল্প বলছি। এমন সময় আপুর বন্ধু এলো। তার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তার নাম সোহাইল সাকি। তিনি পাকিস্তানের অভিজ্ঞ পর্বতারোহী। তিনি এভারেস্ট ও কে-টুসহ একাধিক আট হাজার মিটারের পর্বত আরোহণ করেছেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় আমাদের গল্প হলো। তাদেরকে হোটেলে রেখেই আমি চলে এলাম আমার কাজ থাকায়।
থামেলের কাজ শেষ করে বিকেলের মধ্যে বাসায় চলে এলাম। সন্ধ্যায় টেম্বা শেরি শেরপার বাড়িতে নিমন্ত্রণ আছে। অনেকদিন আগে থেকেই তার বাড়িতে তাদের সঙ্গে ডিনার করার কথা বলছিল। ব্যস্ততার কারণে আর যাওয়া হচ্ছে না। দু’দিন আগেই বলেছিলাম আজ তাদের সঙ্গে ডিনার করবো। দুপুরের পর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যার পরে টেম্বার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। হেঁটেই যাচ্ছি। তার বাড়ি কাছেই। বাংলাদেশ হাউজ থেকে একটু সামনে। বাংলামুখী টেম্পলের কাছে আসতেই গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টিতে ভিজেই যাচ্ছি। টেম্বা গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী নেপালের একজন বিখ্যাত পর্বতারোহী ছিলেন। তিনি সব থেকে কম বয়সে ২০০১ সালের ২৩ মে তিব্বত দিক দিয়ে এভারেস্ট আরোহণ করেন। তখন তার বয়স ছিল ১৬ বছর ১৪ দিন। তিনি নেপালের দিক দিয়ে ২০০০ সালেও এভারেস্ট অভিয়ান করেছিলেন। কিন্তু তখন তিনি সফল হতে পারেননি এবং তখন ফ্রস্টবাইটে তার দুই হাতের পাঁচটি আঙুল কেটে ফেলতে হয়।
২০০৩ সালের ২২ মে ১৫ বছর বয়সী নেপালী নারী মিঙ কিপা শেরপা সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে টেম্বার রেকর্ড ভাঙে। ২০১০ সালের ২২ মে ১৩ বছর ১০ মাস বয়সে আমেরিকান পর্বতারোহী জর্ডান রোমেরু সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। ভারতীয় পর্বতারোহী মালাভাথ পুর্না ২০১৪ সালের ২৫ মে ১৩ বছর ১১ মাস বয়সে সর্বকনিষ্ঠ নারী পর্বতারোহী হিসেবে এভারেস্ট আরোহণ করে। তবে এখন পর্যন্ত সর্বকনিষ্ঠ এভারেস্ট আরোহনকারী হিসেবে রেকর্ডটি জর্ডান রোমেরুর দখলেই রয়েছে।
টেম্বার বাড়ি খুঁজে বের করে আসতে প্রায় পনেরো মিনিট লেগে গেল। গেইটের কলিং বেল চাপতেই সে গেইট খুলে দিলো। আমি গেইটে ঢুকতে ঢুকতেই আমকে জড়িয়ে ধরে বললো, আরে শাকিল কেমন আছো? একদম ভিজে গেছ। আমিও তাকে বললাম, ভেজাতে সমস্যা নেই, তুমি কেমন আছো আগে সেটা বলো। ছোট্ট ছিমছাম পুরনো বাড়ি। ছোট একটি শেওলা পড়া উঠান আছে। উঠানে অনেক গাছপালাও চোখে পড়লো। ঘরের সামনে ছোট একটি বারান্দা। বারান্দায় শুয়ে আছে পোষা কুকুর। ঘেউ ঘেউ করে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো নাকি তাড়িয়ে দিতে চাইলো বুঝতে পারলাম না। ঘরে ঢুকেই সোফায় বসলাম। টেম্বা একটি তোয়ালে এনে দিলো গা মোছার জন্য।
আমি মাথা ভালো করে মুছে নিয়ে বসে পুরো রুমটা দেখছিলাম। চারপাশের দেয়ালে টেম্বার বিভিন্ন ছবি, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বাঁধাই করে ঝুলানো আছে। গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের সার্টিফিকেটও দেয়ালে ঝুলানো আছে। টেম্বা বললো, তুমি কি খাবে, না খাবে সেটা তো জানি না। তুমি কি শূকরের মাংস খাবে নাকি মুরগির মাংস খাবে? আমি তাকে বললাম, আমি শূকরের মাংস খাই না। সে বললো, তাহলে চলো বাজার সদাই করে নিয়ে আসি। তোমার পছন্দ মতোই বাজার করি।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাশের একটি সুপার শপে এলাম। বৃষ্টি তখনও থামেনি। মুরগি, সবজি, ফল, জুস, বিয়ার কিনে আবার বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি ফিরে দেখি টেম্বার স্ত্রীও বাড়িতে চলে এসেছে। কোনো এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল। আমি এসেছি শুনেই চলে এসেছে। টেম্বা তার স্ত্রীর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো। আমি তাকে দিদি ডাকলাম। দিদি বললেন, তোমরা গল্প করো আমি তোমাদের জন্য কিছু ফল কেটে আনছি। আমি, টেম্বা ও টেম্বার ভাই বসে গল্প করছি। দিদি বেরিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শাকিল তুমি বিয়ার খাও? আমি বললাম, না দিদি। আমি বিয়ার খাই না। তখন টেম্বা বললো, শাকিলের জন্য দেখো জুস এনেছি। তাকে জুস দাও আর আমাদের জন্য বিয়ারের বোতল নিয়ে এসো।
প্রথমে দিদি আমাকে বড় এক গ্লাসে জুস এনে দিলো। তারপর তাদের তিনজনের জন্য তিনটা খালি গ্লাস ও এক বোতল বিয়ার আনলো। বড় এক বাটিতে অনেকগুলো কাটা ফল আনলো। টেম্বা তাদের নিজেদের গ্লাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে আমাকে বললো, শাকিল বসে আছ কেনো? নিজের মতো খেতে থাকো। মুচকি হেসে দিদি বললেন, এক সাথে বসে বিয়ার খাচ্ছি বলে কী শাকিলের খেতে অসুবিধা হচ্ছে? না কি লজ্জা পাচ্ছো? আমি বললাম, আরে কি যে বলো তোমরা! এসবে আমার সমস্যা নেই। দিদি বললেন, তুমি মুসলিম বলে কি বিয়ার খাবে না? শুনেছি তোমাদের ধর্মে অ্যালকোহল নিষিদ্ধ। আমি বললাম, ঠিকই শুনেছেন। কিন্তু আমি সেজন্য খাই না এমনটা না। আমি এমনিতেই কোনো প্রকার অ্যালকোহল খাই না।
টেম্বা চলে গেল রান্না করতে আর আমরা বসে বসে গল্প করছি। রান্না শেষে আমরা খেতে বসলাম। খেতে খেতে টেম্বার বারো-তেরো বছর বয়সী ভাগ্নের কণ্ঠে বেশ কয়েকটি গান শোনা হলো। গিটার বাজিয়ে দারুণ গান করে সে। টেম্বা আর দিদির আতিথেয়তায় সন্ধ্যাটা দারুণ স্মৃতিময় হয়ে উঠলো। ডিনার শেষ রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরে আসি। আগামীকাল ঢাকা থেকে মুহিত ভাইরা কাঠমান্ডুতে আসছেন। তারা কাঠমান্ডুতে এসে পৌঁছাবেন দুপুর বারোটা নাগাদ। তাদের রিসিভ করতে আমি আর দাওয়া ফুটি শেরপা এয়ারপোর্টে যাব সকালে। রাতেই দাওয়ার সাথে কথা হয়েছে। আমরা ঠিক পৌনে বারোটায় এয়ারপোর্টে থাকবো। মিল্লাত ভাইকে রাতেই জানিয়ে রাখলাম সকালে মুহিত ভাইদের রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট যাব।
আজ সেপ্টেম্বরের সাত তারিখ। সকালে মিল্লাত ভাইয়ের সাথেই সকালের নাস্তা করি। পরে তিনি অফিসে চলে গেলেন। আমিও এয়ারপোর্টের উদ্দেশে রওনা হলাম। (চলবে)
তারা//