ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

সহিহ হাদিসের আলোকে শবে বরাত

মাওলানা মো. জহিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৪, ১২ জুন ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সহিহ হাদিসের আলোকে শবে বরাত

মাওলানা মো. জহিরুল ইসলাম

মাওলানা মো. জহিরুল ইসলাম : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যাকে ইচ্ছা, যখন ইচ্ছা, মর্তবা ও মাহাত্ম দান করেন, ফজিলত-শ্রেষ্ঠত্ব তারই হাতে। এ চিরন্তন বিধান অনুযায়ী এক ব্যক্তিকে অন্য ব্যক্তির ওপর, এক জনপদকে আরেক জনপদের ওপর, এক মাসকে অপর মাসের ওপর, এক দিবসকে অপর দিবসের ওপর, এক রজনীকে অন্য রজনীর ওপর তিনি শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।

শবে বরাত : শবে বরাত বা ভাগ্য রজনী অত্যন্ত বরকতপূর্ণ। শাবান মাসের ১৪ তারিখ সূর্যাস্তের পর এ রজনী শুরু হয় এবং সুবেহ সাদিক পর্যন্ত তা বিদ্যমান থাকে।

শবে বরাতের নামকরণ : হাদিস শরীফে এ রাতের বিশেষ কোন নাম বর্ণিত হয়নি। বরং ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’ অর্থাৎ ‘শাবানের ১৫তম রজনী’- শব্দে উল্লেখিত হয়ে এ রাতের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। শবে বরাত ফারসি শব্দ, যা ‘শব’ এবং ‘বারাআত’ দুটি শব্দে মিলে গঠিত হয়েছে। শব শব্দের অর্থ হলো রাত এবং বারাআত শব্দের অর্থ হলো নাজাত, মুক্তি, রক্ষা, রেহাই ইত্যাদি। এ রাতে যেহেতু গোনাহ মাফ হয় এবং অসংখ্য অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করা হয়, সেহেতু এ রাত মুসলমানদের মাঝে ‘শবে বরাত’ বলে প্রসিদ্ধ হয়েছে।

শবে বরাতের ফজিলত : হাদিস শরীফে এ রাতের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। এর কিছু অংশ সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হলো।

হাদিস শরিফে আছে, হযরত মুআয ইবনে জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী হযরত মুহম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, এই রাতে মহান আল্লাহ তার সকল সৃষ্টির প্রতি বিশেষভাবে মুতাওয়াজুহ হন এবং সমস্ত মাখলুককে ক্ষমা করে দেন কিন্তু মুশরিক এবং বিদ্বেষীদেরকে মাফ করেন না। (সহীহ ইবনে হিব্বান ১৩/৩৮১ হাদীস নং ৫৬৬৫, শুআবুল ঈমান ৩/৩৮২ হাদীস নং ৩৮৩৩, কিতাবুল সুন্নাহ, মাওয়ারেদুয্ যম্য়ান,  মু’জামূল কাবীর, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৮/৬৫, আত তারগীব ওয়াত তারহীব ২/১১৮  ইত্যাদি)।

অন্য এক হাদিসে আছে, হযরত আবু ছা’লাবাহ (রা.) বর্ণনা করেন, মহানবী (স.) ইরশাদ করেন- শাবান মাসের এই রাতে আল্লাহ পাক স্বীয় বান্দাদের দিকে মুতাওয়াজ্জুহ হয়ে মুমিনদেরকে মাফ করে দেন এবং বিদ্বেষীদেরকে স্বীয় বিদ্বেষের মধ্যে ছেড়ে দেন। অর্থাৎ তাদেরকে মাফ করেন না। যতক্ষণ না তারা স্বীয় বিদ্বেষ ত্যাগ করে দোয়া করে। (কিতাবুস সুন্নাহ, বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, দুররুল মানছুর)।

উপরে বর্ণীত হাদিসে উল্লেখিত দুটি গোনাহসহ কোন কবিরা গোনাহ মাফ হওয়ার জন্য তওবা শর্ত। শবে বরাত যেহেতু ক্ষমার রাত তাই বেশি থেকে বেশি তওবা, এস্তেগফার, কোরআন তেলাওয়াত, দরুদ শরিফ পাঠ ও নিম্নে উল্লেখিত আমল একাগ্রতার সঙ্গে করা প্রয়োজন।

শবে বরাতে আমল বা করণীয় :
রাতে ইবাদত করা আর দিনে রোজা রাখা : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (স.) বলেছেন, ‘শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত যখন আসে তখন তোমরা এ রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটাও এবং দিনের বেলা রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে মহান আল্লাহ প্রথম আসমানে আসেন এবং বলেন, কোন ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিজিক প্রার্থী? আমি তাকে রিজিক দিব। আছে কোন অসুস্থ বা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি? যাকে আমি সুস্থতা দান করব ও বালা মুসিবত থেকে মুক্তি দেব। এভাবে সুবেহ সাদিক পর্যন্ত মহান আল্লাহ মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে তাদের ডাকতে থাকেন।’ (সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস ১৩৮৪)।

রাতে কবরস্থানে যাওয়া : হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন, এক রাতে আমি মহানবী (সা.)-কে কাছে না পেয়ে তাঁর খোঁজে বের হলাম এবং জান্নাতুল বাকীতে তাঁকে পেলাম। তিনি বললেন- হে আয়েশা! তুমি কি আশঙ্কা করছ যে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল তোমার প্রতি কোন অত্যাচার করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার এ ধারণা হয়েছিল যে, আপনি হয়তো অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গমন করেছেন। এরপর মহানবী (স.) ইরশাদ করেন- এই রাতে মহান আল্লাহ দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন এবং বনু কালব গোত্রের লোকদের ছাগল পালের পশমের সংখ্যার চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিযী, ইববে মাজাহ, জামেউল উসূল)।

রাতে খুব দোয়া করা : হাদিস শরিফে আছে, হযরত ওসমান ইবনে আবিল আস (রা.) বর্ণনা করেন- রাসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেন, এই রাতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা করেন- আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী? যাকে আমি ক্ষমা করে দেব। আছে কি কোন প্রার্থনাকারী ? যার মনোবাসনা আমি পূর্ণ করে দেব। (সুতরাং এই রাতে সকল প্রার্থনাকারীর মনোবাসনা পূর্ণ করা হয়। কিন্তু ব্যাভিচারি ও মুশরিকের দোয়া কবুল করা হয় না। (দূররুল মানছুর, শুআবুল ঈমান, লাতায়েফ, কুনুয)।

শবে বরাতে বর্জনীয় বিষয় : করণীয় আমলের সঙ্গে কিছু বর্জনীয় বিষয়ও জড়িত থাকে। সেই সব বিষয় বর্জন না করলে শবে বরাতের বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সফলতার পরিবর্তে ব্যর্থতা; রহমতের পরিবর্তে গজব, সওয়াবের পরিবর্তে আযাব নসীব হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে, আমরা ওইসব বিষয়ে উদাসীন থাকি। ওই কাজ বর্জনের প্রতি যতটুকু গুরুত্ব আরোপের প্রয়োজন, ততটুকু গুরুত্ব আরোপ করা হয় না। বর্জনীয় কাজগুলো হচ্ছে-
হালুয়া রুটির বিশেষ আয়োজন, আতশবাজি, পটকা ইত্যাদি ফুটানো; মসজিদ, কবরস্থান ও অন্যান্য ইমারতে আলোকসজ্জা, গোরস্থানে মেলা ও উৎসব, মসজিদ কমিটি বা মহল্লার যুবক ছেলেদের উদ্যোগে চাঁদা আদায় পূর্বক তবারক বিতরণ, ইবাদতে একাগ্রতার প্রতি নজর না দিয়ে বাহ্যিক জাঁকজমক।

উপসংহার : শবে বরাত হলো ইবাদত বন্দেগির রাত। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা একে উৎসবের রাত বানিয়ে ফেলেছি। অনেকে শবে বরাতে কমবেশি নামাজ পড়েন। কিন্তু ফজরের নামাজ জামায়াতে পড়েন না। এর চেয়ে কঠিন আত্মপ্রবঞ্চনা আর কিছুই হতে পারে না। সারা জীবনের সকল নফল এবাদতও একটি ফরজ এবাদতের সমান হতে পারে না। তাই ফরজ ও নফলের সীমারেখা অনুধাবন করা প্রত্যেকের জন্য অত্যন্ত জরুরী। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে শরীয়তের সীমারেখা মেনে চলার তওফিক দান করুন। ( আমীন )

লেখক: আরবি প্রভাষক, মেহেরপুর আলীয়া মাদ্রাসা।
            
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ জুন ২০১৪/মহাসিন আলী/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়