পলাশীর প্রান্তরে
তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম
শিল্পীর তুলিতে পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র
তাপস রায় : পলাশীর যুদ্ধ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা অর্থাৎ এ অঞ্চলে ব্রিটিশ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলা তখন ছিল সম্পদশালী আর শস্যে পরিপূর্ণ। স্বাভাবিক কারণেই বাংলার দিকে ব্রিটিশদের লোলুপ দৃষ্টি ছিল। তারা বাংলা অধিকার করে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে চাইছিল। পলাশীর যুদ্ধ তাদের সেই সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে তারা এ অঞ্চলে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করে। শাসন না বলে একে দুঃশাসন বলাই শ্রেয়। কেননা স্বাধীনতাহীনতায় আর যাই হোক শোষকের কাছ থেকে সুশাসন আশা করা যায় না।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পলাশীর যুদ্ধ এক রকম অনিবার্য ছিল। একদিকে দেশপ্রেমিক, তেজী, স্বাধীনচেতা এক নবাব, অন্যদিকে চতুর ব্রিটিশদের এ দেশীয় দোসরদের সহায়তায় কৌশলে স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা। বিষয়টি একাত্তরকে মনে করিয়ে দেয়। যদিও সে অন্যপ্রসঙ্গ, অথচ কী অদ্ভূতভাবেই না প্রাসঙ্গিক। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাব সিরাজউদ্দৌলার দেশপ্রেম, বীরত্ব এবং ব্রিটিশবিরোধী মনোভাবের ব্যাপারে শুরু থেকেই উদ্বিগ্ন ছিল। এ কারণে নবাবকে পরাস্ত করতে ইংরেজরা বিভিন্ন কুটকৌশলের আশ্রয় নেয়।
সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন নবাব আলীবর্দী খাঁর দৌহিত্র। পুত্রসন্তান না থাকায় তিনি সিরাজকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। এর আরেকটি কারণ এই যে, তিনি প্রিয় এই দৌহিত্রকে সৌভাগ্যের প্রতীক বলে ভাবতেন। যখন তিনি সিরাজউদ্দৌলাকে বালক বয়সেই পাটনার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন তখন বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়। কিন্তু বয়স অল্প হওয়ায় রাজা জানকীরামকে তিনি রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত করেছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, দাদুর এ সিদ্ধান্ত সিরাজউদ্দৌলার মনঃপুত হয়নি। এ থেকেই তার স্বাধীনচেতা মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও জানকীরাম খুব বেশিদিন অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ফলে আলীবর্দী খাঁ স্নেহভাজন দৌহিত্রকেই বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে বসানোর ঘোষণা দেন বা দিতে বাধ্য হন। ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষণা কার্যকর হয়। অর্থাৎ সিরাজউদ্দৌলা সিংহাসনে আরোহণ করেন। সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ সিরাজউদ্দৌলার বয়স তখন মাত্র সতের।
সিরাজউদ্দৌলার দুর্ভাগ্য এই যে, তাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করার ঘটনা কাছের অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। স্বজনদের ভেতর থেকেই শুরু হয় বিরোধীতা। এদের অন্যতম ছিলেন আলীবর্দী খাঁর বড় মেয়ে ঘসেটি বেগম এবং তার স্বামী নোয়াজেশ মোহাম্মদ। নোয়াজেশ নিঃসন্তান ছিলেন। সিরাজের ছোটভাই মির্জা মেহেদীকে তিনি পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেছিলেন। মির্জা মেহেদী নোয়াজেশের জীবদ্দশাতেই মারা যান। কিন্তু তার অল্পবয়স্ক পুত্র সন্তান ছিল। রাজবল্লভ তাকে সিংহাসনে বসিয়ে ঘসেটি বেগমের নামে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় নবাবী করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সিরাজউদ্দৌলার কারণে তার সে স্বপ্ন অধরা থেকে যায়। সিরাজের বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বীজ এ ঘটনার মধ্যেই নিহিত। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আলীবর্দী খাঁ মৃত্যুবরণ করলে আরো সংকটজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারদিকে শুরু হয় প্রচণ্ড অরাজকতা এবং ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের পালে নতুন করে হাওয়া দিতে থাকেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় কর্তা ব্যক্তিরা।
সিরাজউদ্দৌলা যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন, তখন থেকেই কলকাতায় ইংরেজদের প্রতাপ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। তিনি তাদের দমন করার জন্য কাশিমবাজারের কুঠিয়াল ওয়াটসনকে কলকাতার দুর্গপ্রাচীর ভেঙে ফেলতে এবং ভবিষ্যতে নবাবের পূর্বানুমতি ছাড়া এ ধরনের কাজ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইংরেজরা নবাবের এই আদেশ অমান্য করেন। তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাছে ততদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে, গৃহবিবাদের সুযোগ নিয়ে ইংরেজরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করছে। সুতরাং প্রথমেই তিনি গৃহবিবাদ মিটিয়ে ফেলায় সচেষ্ট হন। তার স্বল্প সময়ের শাসনামলে এই পর্যায়ে তাকে আমরা কৌশলী হতে দেখি। একইভাবে তাকে কঠোর হতেও দেখা যায়। তিনি খালা ঘসেটি বেগমের চক্রান্ত চূর্ণ করে সৈন্য নিয়ে এগিয়ে যান কলকাতার উদ্দেশ্যে। ঔদ্ধত ইংরেজদের শায়েস্তা করাই ছিল তার সংকল্প।
১৭৫৬ সালের ২০ জুন ইংরেজদের শায়েস্তা করে নবাব সিরাজউদ্দৌলা কলকাতা পুনরুদ্ধার করেন। ইংরেজরা নবাবের আদেশ অমান্য করে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ, সরকারি তহবিল তসরুপকারী রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাসকে আশ্রয় দান, শুল্ক ফাঁকি দেয়াসহ বাদশাহী দস্তকের যথেচ্ছ ব্যবহার করছিল। অনেক ক্ষেত্রে তারা স্পষ্টতই নবাবের আদেশ অমান্য করছিল। ফলে ক্ষুব্ধ নবাব ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ আক্রমণ করেন।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে ইংরেজ গভর্নর ড্রেক ১৯ জুন সহযোদ্ধাদের নিয়ে দুর্গের পেছন দিয়ে নৌকাযোগে ফুলতা পালিয়ে যান। কলকাতা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ইংরেজ সেনাপতি জে হলওয়েল অন্যান্য ইউরোপীয় ও আর্মেনীয়সহ প্রায় ১৭০ জন সেনা নিয়ে দুর্গে থেকে যান। কিন্তু রাতের আঁধারে ৫৩ সেনা পালিয়ে গিয়ে নবাবের বাহিনীতে যোগ দেয়, যাদের অধিকাংশই ছিল ওলন্দাজ। ২০ জুন দুপুরের আগেই যুদ্ধে ২৫ জন ইংরেজ সেনা নিহত এবং ৭০ জন আহত হয়। সন্ধ্যার দিকে এক ওলন্দাজ সার্জেন্ট বিশ্বাসঘাতকতা করে দুর্গের নদীর দিকের তোরণ খুলে দিলে নবাবের সেনারা দুর্গে প্রবেশ করে। এক পর্যায়ে পরাস্ত হয়ে হলওয়েলসহ বাকি সবাই নবাবের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন।
ওই সময় আহত ইংরেজ সৈন্যদের দুর্গের একটি কক্ষে রাখা হয়। রাতে আহতদের মধ্যে কয়েকজন মারা গেলে হলওয়েল অন্ধকূপ হত্যার কল্পিত কাহিনি প্রচার করেন। বলা হয় যে, ৮ ফুট বাই ৪ ফুট ১০ ইঞ্চি আয়তনের একটি ঘরে ১৪৬ জন আহত ইংরেজ সৈন্যকে রাখার ফলে শ্বাসকষ্টে ১২৩ জন সৈন্যের মৃত্যু হয়। নবাবের কুৎসা প্রচারের জন্যই যে হলওয়েল এ কাহিনি প্রচার করেছিল এতে সন্দেহ নেই। কারণ ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে একমত হন যে, ঘটনার সময় ঘরের যে আয়তনের কথা হলওয়েল বলেছেন সেখানে কোনোভাবেই ১৪৬ জনের স্থান সঙ্কুলান হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া আহতদের মৃত্যুর সংখ্যাও হলওয়েল বাড়িয়ে বলেছিলেন।
সদ্য তরুণ নবাব সিরাজদ্দৌলাকে মসনদে আরোহণ করতে না করতেই দেশী- বিদেশী নানা চক্রান্তের শিকার হন। নবাব এসব চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনায় সচেষ্ট ছিলেন। তিনি বহু চেষ্টার পর অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকটা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন এ কথা বলা যায়। কিন্তু সেটা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। এর কারণও ছিল। নবাব জানতেন, প্রাসাদের কিছু কাছের মানুষই তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ফলে তিনি এক সময় তাদের অপকর্মের বিচার শুরু করেন। এর ধারাবাহিকতায় মানিকচন্দ্রকে কারাবন্দী করা হয়।
এ ঘটনায় রাজবল্লভ, জগৎশেঠ ও মীরজাফর ভীত হন। শুধু স্বার্থ নয়, পিঠ বাঁচাতে তারা ইংরেজদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করতে থাকেন। জগৎশেঠের মন্ত্রণায় তারা ইংরেজদের সাহায্যে নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে সিংহাসনে বসাবার নীলনকশা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেন। ১৭ মে কলকাতার ইংরেজ দরবারে এই গোপন সন্ধিপত্রের খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। মীরজাফরের স্বাক্ষরের জন্য গোপন এই সন্ধিপত্র ১০ জুন তার কাছে পাঠানো হয়।
পাশাপাশি ক্লাইভ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেন। এদিকে গোপন সন্ধিপত্রের সংবাদ জানতে পেরে সিরাজউদ্দৌলা মীরজাফরকে বন্দি করার ব্যবস্থা নেন। কিন্তু বিদ্রোহ হতে পারে ভেবে তিনি সিদ্ধান্ত বদল করেন। তারপরও শেষ রক্ষা হলো না। কারণ তিনি চেয়েছিলেন অতীত ভুলে সবাইকে নিয়ে ইংরেজদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ শঠতার জবাব দিতে। এ জন্য তিনি সকলকে পবিত্র শপথবাক্যও পাঠ করিয়েছিলেন। হায়! বিশ্বাসঘাতকেরা তার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি।
ওদিকে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। পলাশী কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ থেকে ১৫০ কি.মি. উত্তরে ভাগিরথী নদীর তীরে অবস্থিত। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল থেকেই পলাশীতে ইংরেজরা নবাবের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল। সকাল ৭টায় শুরু হলো যুদ্ধ। মীরজাফর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে সরে গিয়ে নিষ্ক্রিয় রইলেন। কারণ ইংরেজদের সঙ্গে তার এ রকমই গোপন চুক্তি হয়ে আছে। এই ঘটনা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতকতার নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
বেলা ১১টার দিকে নবাবের বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর মদনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে এলেন। দুপুরের দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যায়। তখনও কেউ কী বুঝতে পেরেছিল, এই ঝড় বাংলার ভাগ্যাকাশে কতটা দুর্যোগ বয়ে আনবে। ঝড়ের কারণে ব্রিটিশরা গোলা বারুদ দ্রুত সরিয়ে নেয়। ঝড় থেমে গেলে দুপুর ২ টার দিকে রবার্ট ক্লাইভের প্রধান সৈনিক কিলপ্যাট্রিক সৈন্যদল নিয়ে নবাব বাহিনীকে আক্রমণ করে। বিকেলে ব্রিটিশরা যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয় এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে জয়লাভ করে।
যে কোনো পরাজয়ই বেদনাদায়ক। কিন্তু এই পরাজয় তো সিরাজউদ্দৌলার প্রাপ্য ছিল না। কেন ছিল না বিষয়টি পরিস্কার করতে শুধু এটুকু বলি, যুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ। তার অধীনে প্রধান সৈনিক ছিলেন মেজর কিলপ্যাট্রিক, মেজর গ্রান্ট, ক্যাপ্টেন রিচার্ড নক্স। অন্যদিকে নবাব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হলেন মীরজাফর আলী খান, দেওয়ান মদন লাল এবং নেতৃত্বদানকারী সেনাপতি মীর মদন ও রায় দুর্লভ।
ক্লাইভের অধীনে ছিল ৬০০ পদাতিক গোরা সৈন্য, ৬০ নৌসৈন্যসহ ১৫০ গোলন্দাজ সৈন্য এবং ২ হাজার ১০০ সিপাহী। সব মিলিয়ে ক্লাইভের সঙ্গে ছিল তিন হাজারের সামান্য বেশি সৈন্য এবং ছয়টি কামান। অন্যদিকে নবাবের অধীনে ছিল ৫০ হাজার পদাতিক সৈন্য, ১৫ হাজার সুশিক্ষিত অশ্বারোহী সৈন্য ও ৫০টি কামান। কিন্তু ৪৫ হাজার সৈন্য মীরজাফরের আয়ত্বে থাকায় মাত্র পাঁচ হাজার সৈন্য সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়। মূলত মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকার কারণেই সিরাজউদ্দৌলা সেদিন পলাশীর যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের কাছে পরাজিত হন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে বাংলার আকাশে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্ত গিয়েছিল, পুনরায় তা উদয় হতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯০ বছর।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ জুন ২০১৪/এনএ
রাইজিংবিডি.কম