ইলা মিত্র : ইতিহাসের নারী
মোসতাফা সতেজ || রাইজিংবিডি.কম
অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার
মোসতাফা সতেজ : তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের আজ ১২তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর তার জীবনাবসান ঘটে। তার বাবা নগেন্দ্র নাথ সেন ছিলেন বেঙ্গল ডেপুটি অ্যাকাউন্টেন্ট জেনারেল। অনেকেই হয়তো তার ক্রীড়াজীবনের কথা জানেন না। সাঁতারে তিনি দক্ষ ছিলেন। অ্যাথলেটিক্স ছাড়াও বাস্কেট বল ও ব্যাডমিন্টন খেলাতেও তার সুনাম ছিল। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। এখানে স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে ১৯৪০ সালে অলিম্পিকের জন্য ভারতীয় দলে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে দ্বাদশ অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়নি।
ছাত্রজীবন থেকেইে ইলা মিত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কলেজে ছাত্রী সংগঠন গড়ে তোলেন। এ সময় তিনি মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্য হন। নারী আন্দোলনের এই কাজের মধ্য দিয়েই ১৯৪৭ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। যদিও এর দুই বছর আগে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। স্বামী তদানীন্তন মালদহ জেলার নবাবগঞ্জ থানার রামচন্দ্রপুরের জমিদার বংশের সন্তান রমেন্দ্র নাথ মিত্র। তিনিও কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
ইলা মিত্র বিয়ের পর দুই বছর গৃহবধূ হয়ে কাটিয়েছেন। কিন্তু সংসারে তিনি আবদ্ধ থাকতে চাননি। তাই জমিদার বাড়ির প্রথা ভেঙে বাড়ির কাছেই তিনি তিনটি মেয়েকে নিয়ে একটি স্কুল খোলেন। সে সময় মাত্র পাঁচ মিনিটের পথও তাকে গরুর গাড়িতে যেতে হতো। এরপর স্বামীর উৎসাহেই ধীরে ধীরে তিনি কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। আন্দোলন দানা বাঁধছে দেখে পূর্ব পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তারা আত্মগোপন করেন। ১৯৪৮ সালে আত্মগোপন অবস্থায় ইলা মিত্রের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়। ১৬ দিনের শিশুকে শ্বাশুড়ির কাছে রেখে ইলা মিত্র তেভাগা আন্দোলনকে সক্রিয় করতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে সচেতন করতে থাকেন। সদ্য মা হওয়া ইলা মিত্র এ সময় যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা অনেক মায়ের জন্যই আদর্শস্বরূপ।
এলাকার জোতদারেরা ছিলেন হাজার হাজার বিঘার জমির মালিক। কৃষকেরা বেশির ভাগই ভাগচাষী। আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিল নাচোল থানার চণ্ডীপুর গ্রামের সাঁওতাল নেতা মাতলা সরদারের বাড়ি। তারা ইলা মিত্রকে পেয়ে নতুন শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠেন। তারা ভালোবেসে ইলা মিত্রের নাম দেন ‘রানী মা’। ফসল কাটার সময় সর্বপ্রথম রমেন মিত্র এবং তাদের অন্যান্য হিস্যার মালিকদের জমির ওপন তেভাগার লাল ঝাণ্ডা ওড়ানো হয়। যাদের নূন্যতম পাঁচশ বিঘা জমি ছিল তাদের জমিতেই এ কাজ করা হয়। এরপর অন্যান্য জোতদারদের জমিতেও তা করা হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কারণ বিপ্লবীরা পাঁচ জন পুলিশ আর এক জন দারোগাকে হত্যা করে। এ খবরে সরকারের টনক নড়ে। তখন নাচোলের সন্নিকটে আমনুরা স্টেশনে অসংখ্য সশস্ত্র সৈন্য জমায়েত করা হয়। তারা প্রচণ্ড আক্রোশে গ্রামের পর গ্রাম ভস্মীভূত করতে থাকে। এ সময় হত্য করা হয় অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে। যারা বর্শা, বল্লম, তীর ও ধনুক দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল তারা যথেষ্ট মূল্য দিয়েছিল এ দিন। এ অবস্থায় কয়েকশ বিপ্লবী সাঁওতাল রমেন আর মাতলা সরদারকে নিয়ে সীমান্তের দিকে চলে যায়। কিন্তু ইলা মিত্র সীমান্ত পাড়ি দিতে পারেন নি।
রহনপুর স্টেশনে ইলা মিত্র ধরা পড়েন। ১৫ দিন ধরে তার শরীরের ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। এ বিষয়ে ইলা মিত্র পরে সেইসব দুঃসহ দিনের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন : ‘‘ওরা প্রথম থেকেই নির্দয়ভাবে মারতে শুরু করে। শুধু আমাকে নয়, আমাদের সবাইকে। ওরা মারতে মারতে একটা কথাই বার বার বলছিল, ‘আমরা তোদের মুখে একটা কথাই শুনতে চাই- বল, ইলা মিত্র তোদের পুলিশদের হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল। একথা বললেই তোদের ছেড়ে দেব।’ আমার সামনে সাঁওতাল কর্মীদের পিটিয়ে রক্ত বের করে দিচ্ছে। প্রতিটি কর্মী মুখ বুজে নিঃশব্দ হয়ে আছে। কিন্তু কেউ সেদিন মুখ খোলেনি।’’
নবাবগঞ্জ থানা থেকে ইলা মিত্রকে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। নির্যাতনের ফলে তখন তিনি শয্যাশায়ী। এসব খবর কিন্তু তখন পত্রিকায় প্রকাশিত হতে পারেনি। কিন্তু মামলা যখন আদালতে ওঠে তখন ধীরে ধীরে লোকজন জানতে শুরু করে। সে সময় পূর্ব বাংলায় নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ইলা মিত্রের বিবৃতি ছাপিয়ে হাজার হাজার জনতার মাঝে বিতরণ করা হয়। এর ফলে সরকারের বীভৎস্য অত্যাচারের কথা সকলে জানতে পারে। দীর্ঘ ১১ মাস তাকে অন্ধকার সেলে বন্দি করে রাখা হয়। এই সংকটময় কালে আসামির পক্ষে দাঁড়াবার জন্যে এগিয়ে আসেন কুমিল্লার কামিনী দত্ত। এই মামলায় প্রত্যেক আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়। পরে আপিলে দণ্ড কমে দশ বছর করা হয়। আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ইলা মিত্র সেদিন বিবৃতি দেন : ‘মামলার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। ১৯৫০ এর ৭ জানুয়ারি আমি রোহনপুরে গ্রেপ্তার হই। … সেলের মধ্যে আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় বন্দি করে রাখা হতো। আমাকে নিয়মিত খাবার দেওয়া হয়নি। রাতে একটি কামরায় নিয়ে গিয়ে মর্মান্তিক নির্যাতন চালিয়ে পুনরায় তারা আমাকে সেলে রেখে যেত। … সেলের মধ্যে একজন এসআই এসে সেপাইদের চারটে গরম সিদ্ধ ডিম আনার হুকুম দেয়। চার-পাঁচজন সেপাই আমাকে জোর করে চিৎ করে শুইয়ে রাখে। একজন আমার যৌনাঙ্গের মধ্যে একটি ডিম ঢুকিয়ে দেয়। যন্ত্রণায় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। কয়েক দিন পরে ডান পায়ের গোড়ালিতে একটি পেরেক ফুটিয়ে দেয়া হয়।’
ইলা মিত্রের ওপর এই নির্যাতন চালানো হয়েছিল পুলিশ হত্যার স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য। এ জন্য তাকে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে কোনো বর্বরতাকে হার মানায়। তিনি এ সময় সিপাহী কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ইলা মিত্রকে নাচোল থেকে নবাবগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখন তিনি জ্বরে আক্রান্ত। সেপাইরা জোর করে একটা সাদা কাগজে তার স্বাক্ষর নেয়। এরপর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। এ ঘটনার প্রায় চার বছর পর তিনি মুক্তি পান। চলে যান ভারতে। অনেক চেষ্টায় ভারতীয় নাগরিকত্ব লাভ করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানেই থেকে যান।
কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পর ইলা মিত্র ১৯৫৭ সালে এমএ পাস করে অধ্যাপনা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত হন। ভারতেও তিনি মোট চারবার কারারুদ্ধ হন। ১৯৯০ সালে তিনি অধ্যাপনা পেশা থেকে অবসর নেন। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে তাকে সম্মানিত করা হয়। ১৯৭১ সালে তিনি কলকাতায় শরণার্থীদের সেবা এবং স্বাধীনতার পক্ষে গৌরবজনক ভূমিকা রাখেন।
সাধারণ মানুষের সমস্যা নিয়ে তিনি নিরন্তর ভেবেছেন। আর এ কারণেই জমিদার বধূ হওয়া সত্ত্বেও তিনি গরিব, দুঃখী সাঁওতালদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। তার চরিত্রে পদ্মার পলি মাটির নরম আস্তর পড়েছিল। হয়ে উঠেছিলেন নরম মনের মাটির মানুষ। সবার কাছেই তিনি ছিলেন ‘রানী মা’। আজ তার মৃত্যুদিনে তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ অক্টোবর ২০১৪/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম