ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বঙ্গবন্ধু, তারেক রহমান ও কয়েকটি কৌতুক

সাইফুল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধু, তারেক রহমান ও কয়েকটি কৌতুক

তারেক রহমান

এক,

শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশের জাতির জনক। শেখ মুজিবুর রহমান শুধুই একটি নাম নয়। এর সঙ্গে মিশে আছে বাংলাদেশের জন্ম ও স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা বাংলাদেশ সৃষ্টির সমগ্র ইতিহাস। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৬ এর ছয়দফা, ’৬৮ এর আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংগঠিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পটভূমির প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি। তাকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের অস্তিত্ব চিন্তাও করা যায় না।

 

এমনকি আমাদের দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’ও শেখ মুজিবেরই দেওয়া। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর তিন জাতীয় নেতার একজন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় শেখ মুজিব ঘোষণা করেন যে, এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হবে। তিনি বলেন, “একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে ‘বাংলা’ শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। ‘বাংলা’ শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি যে, এখন থেকে এই দেশকে `পূর্ব পাকিস্তানের` বদলে `বাংলাদেশ` ডাকা হবে।”

 

এসব আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে অনেক নির্যাতন-নিপীড়ণ সইতে হয়েছে শেখ মুজিবকে। যৌবনের বহু মূল্যবান সময় কাটাতে হয়েছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। স্বীয় কীর্তিতেই তিনি ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘বাংলাদেশের জাতির জনক’-এ ভূষিত হয়েছেন।

 

২০০৪ সালে বিবিসি`র বাংলা রেডিও সার্ভিসের পক্ষ থেকে সারা বিশ্বে যে জরিপ চালানো হয়, তাতে শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বিবেচিত হন।

 

দুই,

তারেক রহমান। বিএনপির সিনিয়ার ভাইস চেয়ারম্যান। ২০০১-০৬ পর্যন্ত বিএনপির শাসনামলে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বর্তমানে যু্ক্তরাজ্যে অনেকটা নির্বাসিত জীবনযাপন করছে। দেশে তার বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির নানা মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা। আজ বিএনপির যে এমন রাজনৈতিক দীনতা, তার জন্য দলের ভিতর-বাহিরে প্রায় সবাই প্রকাশে বা আড়ালে একবাক্যে তারেককে দায়ী করছেন।

 

সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিযে নানা কটূক্তি করে আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছেন তারেক রহমান। সবশেষ গত ১৪ ডিসেম্বর দেশের ৪৪তম বিজয় দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্যের ইস্ট লন্ডনের দ্য অট্রিয়াম অডিটরিয়ামে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য তারেক রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ মুজিব এখন আওয়ামী লীগের লালসালু। এই লালসালুকে ঘিরে থাকা ভণ্ডরাই নিজেদের স্বার্থে যাকে-তাকে রাজাকার আখ্যা দেয়। আওয়ামী লীগ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের দল দাবি করে, অথচ চোরের দল, পা-চাটার দল আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিব নিজেই আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এমন একটি কাজ করার জন্য তাহলে তো শেখ মুজিবই বড় রাজাকার।’

 

তিন,

ঢাকাইয়া পরিবার। এক মাকে তার ছোট ছেলে ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছে। এতে তার মন খারাপ। বড় ছেলে বাসায় আসতেই তার কাছে ছোট ছেলের বিরুদ্ধে বিচার দিলেন। বড় ছেলে রেগেমেগে আগুন। বাসার নিচে দাঁড়িয়েই দোতলায় অবস্থানরত ছোট ভাইকে ‍উদ্দেশ্য করে বকাঝকা করতে লাগলেন, ‘শু… বাচ্চা। মা হইলো মা জননী। তারে তুই গালি দিসছ। আজকে তোরে খাইয়া ফালামু। খা… পোলা, চু….. পোলা।’ এ রকম আরো নানা অশ্রাব্য গালি দিতে লাগলেন।

 

বড় ছেলের কথা শুনে মা তাকে বললেন, ‘থাক বাবা, আমার আর বিচার লাগবো না। তুই বিচার করতে গিয়া ও যে গালি দিছে, তার চেয়ে বড় গালি আমারে দিছস।’

 

চার,

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তারেক রহমানের কটূক্তির পরই তাকে নিয়ে সমালোচনা মুখর হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বাদ যাননি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।

 

গত ১৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ আয়োজিত মহান বিজয় দিবসের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি সব সময় ইতিহাস বিকৃত করে। সেই ধারাবাহিকতায় তারেক ইতিহাস বিকৃত করছে। লেখাপড়া না শিখলে, ইতিহাস না জানলে, এই ধরনের কথা তো বলবেই। সে জানোয়ারের মতো কথা বলছে।’

 

গত ১৯ ডিসেম্বর মাদারীপুর সার্কিট হাউসে প্রকৌশলীদের এক আলোচনাসভায় শাজাহান খান তারেক রহমানকে উন্মাদ, পাগল, কুলাঙ্গার, চরিত্রহীন, প্রতারক ও অর্বাচীন বলে মন্তব্য করেন।

 

গত ২২ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ‘একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি গণ্ডমুর্খ তারেক রহমান সাজার ভয়ে পাগলের প্রলাপ বকছেন।’

 

এমন করে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকর্মীরাও তারেকের সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন।

 

দুঃখের বিষয় হলো, এসব কথা বলতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা তারেক রহমান বঙ্গবন্ধুকে কীভাবে কটূক্তি করেছেন তা তুলে ধরেছেন। অর্থ্যাৎ, তারেকের সমালোচনা করতে গিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তার ব্যবহৃত শব্দগুলোর পুনরাবৃত্তি করেছেন।

 

পাঁচ,

এক গ্রামে এক পাগল ছিল। তার বদভ্যাস, নৌকায় উঠলেই অন্যান্য যাত্রীদের পানিতে ফেলে দেওয়ার জন্য সেটি ঝাঁকাতে শুরু করে।

 

ঘটনাক্রমে একবার সেই গ্রামের জমিদার নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য সেই পাগলের সঙ্গে নৌকায় উঠলেন। জমিদার পাগলের বদভ্যাস সম্পর্কে জানতেন। তাই নৌকায় উঠলেও তিনি বেশ আতঙ্কে ছিলেন, এই না পাগল নৌকা ঝাঁকাতে শুরু করে। কিন্তু নৌকা মাঝনদীতে চলে যাওয়ার পরও পাগল সেটি ঝাঁকালো না। এরপর জমিদার বলে উঠলেন, ‘এই পাগল। নৌকা মাঝনদী চলে আসছে। এতক্ষণ ঝাঁকাসনি। আর ঝাঁকাসনে যেন। আমি কিন্তু সাঁতার পারি না।’

 

ব্যস। এতক্ষণ ভুলে থাকলেও জমিদারের কথায় পাগলের নৌকা ঝাঁকানোর কথা মনে পড়ে গেল। সে এমনভাবে নৌকা ঝাঁকালো যে, সেটি ডুবেই গেল। প্রাণ গেল জমিদারের।

 

ছয়,

তারেক রহমান ২০০৬ সালের অক্টোবর থেকে রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে। পাঁচ/ছয় বছর ধরে দেশছাড়া। ‘ক্ষমতা চর্চা করিয়া ক্ষমতা ছাড়িয়া থাকার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।’ তখন নাকি মাথা এমনিতেই খারাপ হয়ে যায়! আর আওয়ামী লীগ নেতারা তো তারেককে ‘পাগল’ উপাধি দিয়েই দিয়েছেন।

 

‘নির্বাসিত’ তারেক যুক্তরাজ্য বসে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারবেন। দেশের জনগণ তারেক রহমানের নাম ভুলতে বসেছে। এখন তারেক রহমানের কাজ হলো, কয়েকদিন পরপর সেখান থেকে কটূক্তি করে দেশের রাজনৈতিক মাঠ গরম রাখা। স্রেফ জাল পাতা, যেন আওয়ামী লীগ নেতারা তার কটূক্তির বিপরীতে বক্তব্য দিয়ে দেশের জনগণকে জানিয়ে দেন যে, তারেক রহমান এখনো রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন এবং একজন ‘ফ্যাক্টর’।

 

আর আওয়ামী লীগ নেতারা সেই জালে পা দিয়ে তারেক রহমানের সমালোচনামুখর হয়ে উঠছেন। এটি করতে গিয়ে তারা সেই ঢাকাইয়া মায়ের বড় ছেলের মতো প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধুরই মানহানি করছেন। তারেক উচ্চারিত কটূক্তিগুলো চর্চা করছেন। একইসঙ্গে তারা সেই জমিদারের মতো ‘পাগল’ তারেককে মনে করিয়ে ‍দিচ্ছেন, নৌকা না ঝাঁকানোর জন্য।

 

সাবধান, আওয়ামী লীগ! এসব করতে গিয়ে না আপনাদের নৌকাই ডুবে যায়। শেখ মুজিবুর রহমান শেখ মুজিবুর রহমানই। একটি হীরকখণ্ড। এক টুকরো হীরাকে কেউ মাটির দলা মনে করে ছুঁড়ে ফেলে দিলে তাতে হীরার কিছু যায়-আসে না, কপাল পুড়ে উপেক্ষাকারীরই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হয়তো বঙ্গবন্ধুকে অনেকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চান, কিন্তু বাস্তব হলো, মনে মনে তারাও মানেন, শেখ মুজিবই বাংলাদেশের জাতির জনক। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত, অবিস্মরণীয় নেতা। তাকে কে গালি দিল, কে কটূক্তি করল, তাতে তার মান-কীর্তি একটুও কমবে না।

 

 

লেখক : সাইফুল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ ডিসেম্বর ২০১৪/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়