উজাড় হচ্ছে বনাঞ্চল বিলুপ্ত হচ্ছে বন্যপ্রাণী
আলম শামস || রাইজিংবিডি.কম
এভাবে বৃক্ষ নিধনের কারণে পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে
আলম শামস : এক সময় দেশের সবুজ বন-বনানী পশু-পাখির হাঁক-ডাকে মুখরিত ছিল। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙতো পল্লীগ্রামের মানুষের। আজ সেদিনগুলো হারিয়ে গেছে। ভারসাম্য হারাচ্ছে দেশের প্রকৃতি। দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ। পরিবেশবিদরা এ জন্য নির্বিচারে বনজ সম্পদ উজাড়, অব্যাহতভাবে পাহাড় কাটা এবং জুম চাষের নামে পাহাড়ে অগ্নিসংযোগকে দায়ি করেছেন।
দেশের বিভিন্ন অরণ্যে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে এক সময় হাতি, হরিণ, ছোট বাঘ, ভাল্লুক, উল্লুক, বানর, হনুমান, গয়াল, বনবিড়াল, শিয়াল, বনমোরগ, ধনেশ, শকুন, ঘুঘু, শালিক, চড়াই, ময়না, টিয়া, বুলবুলি, চিল, খঞ্জনাসহ নানান ধরনের পশু-পাখি দেখা যেত। এসব অনেক প্রণীর অস্তিত্ব এখন আর নেই।
বর্তমানে যেভাবে বন উজাড় হচ্ছে, তা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এসব বন আর বন্য পশু-পাখি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নেবে। এখনো সুন্দরবন ও বান্দরবান-রাঙামাটি জেলার বরকল, জুরাছড়ি ও লংগদু উপজেলার কিছু কিছু এলাকায় বানর, অজগর সাপ, বনরুই, হরিণের দেখা মিললেও এর সংখ্যা অনেক কম। হাতির নিরাপদ চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে জনবসতি স্থাপন ও পাহাড়ে জুম চাষের মাধ্যমে গাছপালা ধ্বংস করায় সংশ্লিষ্ট এলাকার হাতি প্রতিনিয়তই চলে আসছে লোকালয়ে।
সেখানে তারা চালাচ্ছে ধ্বংসলীলা। এমনকী এতে অনেক সময় জীবনহানিও ঘটছে। প্রশাসনিকভাবে জনসাধারণকে সচেতন না করার কারণে এখানে প্রতি বছরই হরিণ শিকারের ঘটনা ঘটে। ফলে সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী দেশের গভীর অরণ্যে পাড়ি জমিয়েছে হরিণ, বানরসহ অন্যান্য বন্য পশু-পাখি।
সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল হচ্ছে টেংরাগিরি বা ফাতরার বন। এ বনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ এখন বিলুপ্তির পথে। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অন্যদিকে শ্বাসমূলীয় গাছের গোড়ায় বালি জমা হওয়া এর প্রধান কারণ। অধিক মাত্রায় মাটি ক্ষয়ের ফলে উপকূলীয় বনাঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ মরে যাচ্ছে। বরগুনার তালতলী থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত চোখজুড়ানো এ বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর।
প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা টেংরাগিরি অতীতে সুন্দরবনের অংশ ছিল। পরে নির্দিষ্ট অংশকে আলাদা করে ১৯৬৭ সালে ‘টেংরাগিরি বনাঞ্চল’ নামকরণ করা হয়। ১৯২৭ সালের বন আইনের জরিপ অনুযায়ী ১৯৬০ সালের ১২ জুলাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এটিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ঘোষণা করে। বন ঘেঁষে প্রায় ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ও ৩ কিলোমিটার প্রস্থের সোনাকাটা সৈকত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আরেক লীলাভূমি। এ ছাড়াও বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বিষখালী নদীর মোহনায় বঙ্গোপসাগরের তীরে গড়ে ওঠা আরেক দৃষ্টিনন্দন বনাঞ্চল লালদিয়ারচর।
এ বনেও সাগরের ঢেউয়ে তীরের মাটি ক্ষয় হয়ে হাজার হাজার গাছ উপড়ে গেছে। এভাবে ঢেউয়ের সঙ্গে বালি এসে শ্বাসমূলে সেই বালি জমে অনেক গাছ মরে যাচ্ছে। সাগর তীরবর্তী এ বন দুটিতে লবণাক্ত ও মিষ্টি মাটির অপূর্ব মিশ্রণের কারণে সারি সারি গেওয়া, জাম, ধুন্দল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, কেওয়া, তাল, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি, হেতাল, তাম্বুলকাটা ও গরান গাছ দেখা যায়।
এখানে বসত গড়েছে কাঠবিড়ালি, বানরসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির সাপ, শজারু, শূকর, কচ্ছপ, শেয়াল, ডোরাকাটা বাঘ, বনমোরগ, মধু কাঁকড়াসহ হাজার প্রজাতির প্রাণী। অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য হওয়ায় এখানে গড়ে উঠেছে সোনাকাটা ইকোপার্ক, লালদিয়ারচর ও হরিণঘাটা পর্যটন কেন্দ্র। তবে পরিতাপের বিষয়, যে হারে বনগুলোতে গাছ মরে যাচ্ছে, তাতে এই পর্যটন কেন্দ্রগুলো এক সময়ে দর্শনার্থীশূন্য হয়ে পড়বে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিশেষ করে বান্দরবান জেলার মাতামুহুরী ও সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট রয়েছে। এ দুটি রিজার্ভ ফরেস্ট ছাড়াও সরকারি বনাঞ্চল থাকলেও বন কর্মচারীদের মদদে এবং এক শ্রেণীর কাঠ চোরাকারবারির কারণে নির্বিচারে বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এতে পরিবেশে দেখা দিয়েছে মারাত্মক বিপর্যয়। বন উজাড় ও বন্যপ্রাণীর খাদ্য সঙ্কটের কারণে পাহাড় থেকে বিভিন্ন প্রাণী অনেকটা বিলুপ্ত হওয়ার পর্যায়ে। খাদ্যাভাবে ক্ষিপ্ত বন্যহাতি লোকালয়ে নেমে জানমালের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে চলেছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিগত সময়ে বান্দরবানে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য গড়ে তোলার দাবি জোরালো হয়। কিন্তু এ দবি আজও কার্যকর হয়নি।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় গত এক যুগে অন্তত এক হাজার মানুষ হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। হাতির আক্রমণের শিকার হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অনেকে। বন্য হাতির দল চাষীদের আবাদি ফসল নষ্ট করছে। ‘বান্দরবানের মাতামুহুরী ও সাঙ্গু রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকা থেকে বন্যপ্রাণী লোকালয়ে বা চাষাবাদের জমিতে যেন আসতে না পারে এবং এলে দ্রুত ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং নিরাপদ দূরত্বে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণসহ মানুষ যেন সংরক্ষিত বনে বা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলে গিয়ে তাদের খাবার ও আবাস নষ্ট করতে না পারে তার ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নিতে হবে’ এ মর্মে আদালতের আদেশ রয়েছে।
আদেশে আরও বলা হয়, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষা বর্তমানে সারা বিশ্বের প্রধান ইস্যু। এই ইস্যুতে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে। মানুষ, প্রাণী ও বৃক্ষ- এই তিন প্রাণের সম্মিলনে আমাদের পরিবেশ, আমাদের পৃথিবী। এদের খাবার ও চারণভূমি দরকার। এ লক্ষ্যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করতে অভয়ারণ্য গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়ায় জনস্বার্থে আদালত এ আদেশ জারি করে।
সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অবহেলা ও অসচেতনতায় তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়গুলো প্রতিনিয়ত বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে। নিরাপদ আবাস হারিয়ে হিংস্র হয়ে উঠছে বন্যপ্রাণীগুলো। ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বন উজাড় ও অবৈজ্ঞানিক পন্থায় পাহাড়ে জুম চাষের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। চাষাবাদের জমি ও বাড়িঘর তৈরির জন্য ক্রমাগতভাবে এসব বন ধ্বংস হচ্ছে। স্থানীয় দরিদ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জীবিকা নির্বাহের জন্য বাধ্য হয়ে পাহাড়ের কাঠ, বাঁশ নির্বিচারে কাটছে। ফলে পাহাড়গুলোর সবুজ অবয়ব বিনষ্ট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ফলে হাজার বছরের পরিচিত অনেক প্রজাতির পশু-পাখি চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসবেন- এমনটি আশা করে দেশবাসী।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মার্চ ২০১৫/তাপস রায়
রাইজিংবিডি.কম