ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

বারবার সিদ্ধান্ত বদল সমন্বয়হীনতাকেই স্পষ্ট করে 

নিজামুল হক বিপুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩০, ২৬ মে ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বারবার সিদ্ধান্ত বদল সমন্বয়হীনতাকেই স্পষ্ট করে 

আমরা যে একটা যুদ্ধকাল অতিক্রম করছি, দেশের মানুষের আচরণ, চলাফেরা দেখে বুঝতে পারার কোনো উপায় নেই। কারো মধ্যে করোনা নিয়ে কোনো ভয়ও নেই! থাকবেই বা কীভাবে, সরকারের সিদ্ধান্তগুলো এক জায়গায় স্থির নেই। একেক সময় একেক রকম সিদ্ধান্ত আসে। এতে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে আমরা করোনাভাইরাস নিয়ে ছেলেখেলা করছি। এর পরিণাম যে কত ভয়াবহ হতে পারে; হয় আমরা সেটা বুঝতে পারছি না অথবা বোঝার চেষ্টা করছি না কিংবা লাগাম ছেড়ে দিয়েছি। যা হয় হবে- আল্লাহ ভরসা!

এখন প্রতিদিনই দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত কয়েকদিন থেকেই ধারাবাহিকভাবে করোনা রোগী শনাক্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। এখন পর্যন্ত দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৩৬ হাজার ৭৫১ জন। মারা গেছেন ৫২২ জন। অর্থাৎ গত কয়েকদিনে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাতে এটা স্পষ্ট যে, আমরা ধীরে ধীরে পিক অর্থাৎ চূড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। যে সময়টুকু ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশে^র আরও অনেক দেশ অতিক্রম করেছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশ এবং পাশের রাষ্ট্র ভারতসহ আরও বেশ কিছু রাষ্ট্র সেই দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আর ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের সবকিছু চলছে এলোমেলো। ঈদ উপলক্ষে আমরা দোকানপাট, মার্কেট শপিং মল খোলার অনুমতি দিয়েছি।
গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হয়েছে। করোনাকে সামাল দিতেই সরকার এই ছুটি ঘোষণা করেছিল ২৩ মার্চ। এরপরই আমরা লক্ষ্য করলাম, মানুষ পাগলের মতো রাজধানী ছাড়ছেন। ট্রেন, বাস, লঞ্চ কোনো কিছুতেই তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। তারপরও এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত চলা সাধারণ ছুটিতে কার্যত লকডাউনই ছিল সারাদেশ। মধ্যে ৫ এপ্রিলে গার্মেন্টস শ্রমিকদের দল বেঁধে ঢাকায় চলে আসা আবার গার্মেন্টস বন্ধের সিদ্ধান্তের পর ফেরত যাওয়া ঘটনা বাদ দিলে ওই একমাস বেশ কড়াকড়ি ছিল মানুষের চলাফেরায়। রাস্তায় যানবাহনও ছিল একেবারে হাতে গোনা। প্রয়োজন ছাড়া খুব কম মানুষই ঘর থেকে বের হয়েছেন।

কিন্তু চিত্রটা পাল্টে গেল ২৩ এপ্রিল যখন সরকার সাধারণ ছুটির মেয়াদ ২৬ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে ছুটির আদেশ জারি করলো তখন থেকে। ধীরে ধীরে রাস্তায় গাড়ি নামতে শুরু করলো। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলা শহরে মানুষের চলাচলও বেড়ে গেলো। এ সময় রাজধানীতে পুলিশের কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হয়ে এলো। চেকপোস্টগুলো খালি হয়ে গেলো। সবকিছু শিথিল হতে শুরু করল। আর ১০ মে থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শপিং মল, দোকানপাট খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত আসার পর থেকে তো ঈদ উৎসব শুরু হয়ে গেলো। যদিও শেষ পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব মানতে না পারার ভয়ে রাজধানী তথা দেশের বেশিরভাগ বড় শহরে বড় বড় শপিং মল, দোকানপাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খোলেনি। আর যেসব শহরে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান খুলেছিলো সেগুলো এক-দুই-তিন দিনের মাথায় বন্ধ করে দেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সমিতিগুলো।

এই ধাক্কা মোটামুটি সামাল দিয়ে উঠতে পারলেও ঈদের আগে যে হারে মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করেছে তাতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেছে, যেসব এলাকায় করোনাভাইরাসের থাবা ব্যাপকভাবে পড়েনি সেসব এলাকায় এবার ভালোভাবেই এই ভাইরাস আঘাত হানবে। ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ১৪ মে জারি করা মন্ত্রী  পরিষদের আদেশে বলা হয়েছিল, ঈদের আগে-রে সব ধরনের গাড়ির চলাচল পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। এক জেলা থেকে আরেক জেলা বা এক উপজেলা থেকে আরেক উপজেলায় সব ধরনের যানবাহন বন্ধ থাকবে। ঘরমুখো মানুষের এই ঈদ যাত্রা ঠেকাতে নতুন পুলিশ প্রধান দার্য়িত্ব নিয়ে বললেন, এবার যে যেখানে আছেন তাকে সেখানেই ঈদ করতে হবে। অথচ দেখা গেলো মানুষের ঢল নেমেছে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া-কাঁঠালিয়া, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এবং কাঁচপুর সেতু, গাবতলীর আমিনবাজার সেতু, আব্দুল্লাপুরে। এসব পয়েন্টে পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে মানুষকে ফিরিয়েও দিতে শুরু করলো। এমনকি দিনের বেলা ফেরি চলাচলও বন্ধ করা হলো। 
কিন্তু এমন ঘোষণা কার্যকর হতে না হতেই এলো নতুন ঘোষণা। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে যে কোনো শহর থেকে বাড়ি যাওয়া যাবে। পুলিশ আটকাবে না। র‌্যাব প্রধানও একই বক্তব্য দিলেন। সঙ্গে যুক্ত করলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে বাড়ি যাওয়া যাবে। তবে গণপরিবহন চলবে না। তার মানে ব্যক্তিগত গাড়িতে করোনাভাইরাস উঠবে না। গণপরিবহন পেলে করোনা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আচ্ছা ব্যক্তিগত গাড়িতে যারা চড়বেন তারা যে করোনা বহন করছেন না, গ্রামে নিয়ে যাচ্ছেন না বা তারা করোনা মুক্ত- সেই নিশ্চয়তাটুকু কে দেবে? আসলে আমরা একটা অদ্ভূত জাতি। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি।

আর সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের ক্ষণে ক্ষণে সিদ্ধান্ত বদল। রীতিমত একটা তেলেসমাতি কারবার। এমন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে বোঝার উপায় নেই- করোনাভাইরাস সত্যিই কি এই বঙ্গে মহামারি!

আরেকটি কথা, এই যে ব্যক্তিগত গাড়িতে বাড়ি যাবার অনুমতি দেওয়া হলো, তাতে একটা বৈষম্য পরিষ্কার হয়ে উঠলো। ব্যক্তিগত গাড়িওয়ালাদের স্বজন আছেন, গ্রাম আছে, গ্রামে ঈদ করার অধিকার আছে তাদের। আর যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। জীবন জীবিকার জন্য ইট-পাথরের শহরে বসবাস করেন তাদের বোধ হয় বাড়ি-ঘর, গ্রাম নেই। মা-বাবা, স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করার অধিকারও নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়