ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানোর এখনই সময়

গোপাল অধিকারী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৭, ২১ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজানোর এখনই সময়

চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য নতুন নয়। এর বিরুদ্ধে অনেক অভিযান হয়েছে, কিন্তু এই অপরাধ চিরতরে বন্ধ করা যায়নি। চিকিৎসক ছাড়াই চিকিৎসা, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়াই রিপোর্ট দেওয়া- এ ধরনের প্রতারণা এদেশে নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। এর সর্বশেষ প্রমাণ করোনাকালে চিকিৎসা বাণিজ্য।

মানুষ কতটা অমানবিক হলে এই সংকটময় পরিস্থিতিতে চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করতে চায় আমার বোধগম্য নয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনার রিপোর্ট জালিয়াতির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। এই আলোচনার শুরু জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী এবং রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদের প্রতারণার খবর ফাঁস হওয়ার পর। জেকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিশদ তদন্ত করতে গিয়ে উঠে আসে তাদের নাম।

জেকেজির বিরুদ্ধে তদন্ত করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে করোনার নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে টেস্টের রিপোর্ট সরবরাহ করেছে। প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় থেকে জব্দ ল্যাপটপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর করোনা টেস্ট জালিয়াতির এমন চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে। দেখা গেছে, টেস্টের জন্য জনপ্রতি নেওয়া হয়েছে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। বিদেশি নাগরিকদের কাছে জনপ্রতি একশ ডলার। হিসাব অনুযায়ী করোনার টেস্ট বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজ নেয় জেকেজি।

যাই হোক, পাঠকের এই তথ্যগুলো এখন আর অজানা নয়। সন্দেহভাজন করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি ছিল জেকেজির। পরে ওই চুক্তি বাতিল করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো- স্বাস্থ্য খাতে এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী কে?

সাহেদের ঘটনা আরো চমকপ্রদ! গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর দেশজুড়ে তুমুল আলোচিত হন সাহেদ। প্রতীক্ষা তখন একটাই- কখন গ্রেফতার হবেন সাহেদ। ১৫ জুলাই বুধবার ভোরে সাতক্ষীরা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। একে একে সাহেদের সব অপকর্ম সামনে চলে আসে। সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছে র‌্যাব। বেশিরভাগই প্রতারণা মামলা। কারণ প্রতারণা করে অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলাই ছিল তার মূলকাজ। এ জন্য করোনা মহামারির এই সময়ে স্পর্শকাতর একটি বিষয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেও তার বিবেকে বাধেনি। ২০১১ সালে প্রতারণা মামলায় সাহেদ একবার গ্রেফতারও হয়েছিলেন। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুত তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর প্রতারণার অর্থ দিয়েই তিনি রিজেন্ট গ্রুপ তৈরি করে নতুন ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। এর পরের ইতিহাসও পাঠকের জানা। কিন্তু যে বিষয়টি বোধগম্য নয়, তা হলো, সাহেদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ নতুন নয়- এ কথা জেনেও তার হাসপাতালকেই কেন করোনা বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরির সুযোগ করে দেওয়া হলো। রিজেন্টের লাইসেন্সের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে এই তথ্যও কি সংশ্লিষ্টরা জানতেন না? বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়! 

পত্রিকা পড়ে জেনেছি, এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, রিজেন্ট হাসপাতালের অনুমোদন মন্ত্রণালয় থেকে বলার কারণেই দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির আগে অধিদপ্তর তাদের কাছে কোনো নথি পাঠায়নি, কোনো প্রস্তাবও পাঠায়নি। তবে ওই হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে মন্ত্রীকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সেই দাওয়াতেই মন্ত্রী উপস্থিত হয়েছিলেন।

তথ্যের এই গড়মিল বা পরস্পর নিজেকে বাঁচানোর প্রবণতা থেকে কিন্তু সহজেই অনুমান করা যায় কালো বিড়ালের ইতিহাস। চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা বা জনগুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরের অব্যবস্থাপনা কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। আমরা জানি, আমাদের সম্পদ সীমিত, দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে। এখন আমরা আরো জানলাম, আমাদের দক্ষ ব্যবস্থাপনারও চরম অভাব। যার মূলে রয়েছে দুর্নীতি। সরকার যখন মহামারি মোকাবিলায় সব ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন একটি মহলের এ ধরনের অপচেষ্টা পুরো প্রক্রিয়াকেই নস্যাৎ করে দেয়। সরকারের সদিচ্ছাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়।

শুধু বেসরকারি সেক্টরেই নয়, গলদ রয়েছে সরকারি সেক্টরেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, একটি দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে যে ক’জন ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, অ্যানেস্থেটিস্ট থাকা আদর্শ সেটি বাংলাদেশে নেই৷ করোনার কারণে সেই সংকট প্রবলভাবে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলেছেন, একজন ডাক্তারের বিপরীতে নার্স থাকতে হয় তিনজন৷ কিন্তু বাংলাদেশে একজনও নেই; আছে আধা জন৷ এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব তো আছেই৷ একটার পর একটা দুর্নীতি অনিয়মের কেলেঙ্কারি ধরা পড়ছে বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতেও। এসব ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তারা সবাই অপকর্ম করছে রাজনৈতিক পরিচয়ে। দলগুলো তাদের পরিচয় অস্বীকার করলেও দায় কি এড়াতে পারে?

আমি মনে করি, চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য রাষ্ট্রদ্রোহী আচরণ। কারণ চিকিৎসার অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার। অন্যান্য মৌলিক অধিকার খর্ব হলে মানবেতরভাবে হলেও মানুষ বাঁচতে পারে, কিন্তু চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি জীবন-মৃত্যু জড়িত।

বর্তমানে স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন অনিয়ম চোখে পড়ছে। হয়তো করোনার কারণেই সেগুলো সামনে চলে এসেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের তিনটি বিষয়ে আমার মনে হয় কঠোর নজরদারী প্রয়োজন। এক. কোনো প্রতিষ্ঠান সঠিক নিয়মে অনুমোদন নিচ্ছে বা লাইসেন্স নবায়ন করছে কিনা, দুই. কোনো প্রতিষ্ঠান অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করছে কিনা, তিন. কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকবিহীন চলছে কিনা। প্রয়োজনে এই তিনটি কাজ তদারকির জন্য আলাদা কমিটি গঠন করা যেতে পারে।

বর্তমানে করোনার টেস্ট বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এবং ফি বাদ দিয়ে রাষ্ট্র মালিকানায় বিনামূল্যে এগুলো করা উচিত। সংকট দ্রুততম সময়ে সমাধান করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সীমিত সময়ের মধ্যে করা উচিত। তবেই সংকট সহজে সমাধান হবে। সরকারের উপর দায়ভারও কমবে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের উন্নতি কামনা করি। এ জন্য সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখতে স্বাস্থ্য খাতের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে নাগরিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা। প্রয়োজনে দেশের স্বাস্থ্য খাত ঢেলে সাজান। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়