ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

রাজ্জাক ভাই স্মরণে || ছটকু আহমেদ

ছটকু আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩৬, ২১ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রাজ্জাক ভাই স্মরণে || ছটকু আহমেদ

রাজ্জাক ভাইকে নিয়ে এখন আর আমার লেখার কিছু নেই। রাজ্জাক ভাই জীবিতকালে জনগণের সম্পত্তি ছিলো। আমরা আমজনতা তাকে নিয়ে লিখেছি, তার গুণকীর্তন করেছি, তার দারুণ অভিনয় নৈপুণ্যে মুগ্ধ হয়ে ‘নায়করাজ’ উপাধিতে ভূষিত করেছি, তাকে শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি। কিন্তু রাজ্জাক ভাই পরলোকগমন করে তার পরিবারের সম্পত্তি হয়ে গেছেন। এবং তার পরিবারের ভাষ্য মতে এখন আর আমাদের তাকে নিয়ে লেখার কোনো আইনগত অধিকার নেই। সব অধিকার তার পরিবারের। তারা লিখবেন তাকে নিয়ে। বড় বড় লেখকের বোর্ড বসিয়ে রিসার্চ করে তার জীবনীগ্রন্থ লিখবেন, তার নামে আর্কাইভ করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও তার কোনোটাই এই এক বছরে তারা করেননি।

ইতিমধ্যে শাইখ সিরাজ ‘রাজাধিরাজ রাজ্জাক’ নামে একটা ডকুমেন্টারি করেছে, যার মধ্যে তার পরিবারের সরব উপস্থিতি দেখা গেছে। তাতে মনে হয়েছে এতে তাদের সায় ছিলো; আর থাকবেই না কেন- চ্যানেল আই বলে কথা! তাতে সায় না দেবার মতো সাহস দেখাবার প্রশ্নই ওঠে না। তদুপরি এর মধ্য দিয়ে তারা চ্যানেলের দর্শকের সামনে উপস্থিত থেকে আরেকবার বাবাকে নিয়ে বলতে পারবে, জনগণকে আশ্বাস দিতে পারবে, বাবাকে নিয়ে এটা করবো-ওটা করবো। যাক এটা আমার বলার বিষয় নয়, আমার বলার বিষয় হলো, এইসব খ্যাতিমান ব্যক্তি মারা যাবার পর কেন জনগণের সম্পত্তি থাকবেন না? রাজ্জাক ভাইয়ের বিশাল সম্পত্তি, বাড়ি, গাড়ি, গচ্ছিত ব্যাংকের টাকার মালিক তার পরিবার হবেন এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়, নেইও। কিন্তু  রাজ্জাক ভাইয়ের চলচ্চিত্র জীবন যার সৃষ্টিতে আমজনতার প্রচণ্ড সমর্থন ছিলো, তারা কেন সেই চলচ্চিত্র জীবনের অংশীদার হতে পারবেন না? শুধু রাজ্জাক সাহেব না, সব খ্যাতনামা ব্যক্তিদের বেলায় কপিরাইট বোর্ড এর মাননীয় সদস্যবর্গ ও সরকার এই বিষয়টি একটু ভেবে দেখবেন।

ইদানিং যারা উৎসাহ নিয়ে রাজ্জাক ভাইয়ের জীবনীগ্রন্থ কতদূর লেখা হয়েছে জানতে চান, তাদের জন্যে একটাই উত্তর- এটা এখন সুদূর পরাহত। সময় অসময়ে যখন ইচ্ছে হবে রাজ্জাক ভাইয়ের জীবনীগ্রন্থ পড়ে আপনারা তার সম্পর্কে জানবেন, তার কর্মে অনুপ্রাণীত হবেন, সেটা এখন আর সম্ভব নয়। রাজ্জাক ভাই এখন আমার শুধু প্রার্থনায় আছেন, স্বপ্নে এখন আর আসেন না। যখন লিখতাম, তখন তিনি স্বপ্নে মাঝে মাঝে আসতেন, দেখা দিতেন, এখন একদম দেখা দেন না। বুঝি না এর কারণ কি? মনে হয় তিনি মন খারাপ করেছেন। মন খারাপ করারই কথা। এতো যত্ন করে বাসায় ডেকে নিয়ে ভিডিও করে তার জীবনী লেখার জন্যে তার জীবন সম্পর্কে আমাকে বিশদ বলে গেলেন। বললেন, ‘আপনি চলচ্চিত্রের লোক, আপনি আমার চলচ্চিত্র জীবন নিয়ে ভালো লিখতে পারবেন, আপনি লিখুন।’ সেই লেখাটা আমি লিখতে পারলাম না। আমাকে বলা তার শেষ কথা আমি রাখতে পারলাম না।

কথাগুলো আজ আরো বেশি মনে পড়ছে এই কারণে যে, আজ নায়করাজ রাজ্জাক ভাইয়ের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। ১৯৪২ সালে ২৩ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার কলকাতার টালিগঞ্জের ৮ নাম্বার নাগতোলার বাসায় জন্ম নিয়েছিলেন নায়করাজ। তিনি যখন কলেজের ছাত্র তখন অজিত ব্যানার্জী পরিচালিত ‘রতন লাল বাঙালি’ নামে প্রথম চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। দ্বিতীয় ছবি মঙ্গল চক্রবর্তীর  ‘পংকতিলক’ ও তৃতীয় ছবি ‘শিলালিপি’। এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য কুড়ি টাকা সম্মানীও পান। ১৯৬৪ সালে উপ-মহাদেশে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা দেখা দেয়। নাট্যকার নিদের্শক পীযুষ বসুর একটি চিঠি নিয়ে রাজ্জাক ভাই স্ত্রী লক্ষ্মী ও পুত্র বাপ্পাকে সঙ্গে করে কলকাতা থেকে ঢাকা আসেন। উত্তমকুমার হবার স্বপ্ন চোখে নিয়ে বোম্বের রঙিন হাতছানি দূরে সরিয়ে রেখে রিফিউজির বেশে এই দেশে এসে ৬৫ টাকার ভাড়া বাড়িতে থেকে জীবন সংগ্রাম শুরু করেছিলেন কিংবদন্তীর এই নায়করাজ। ১৯৬৫ সালের শুরুতে বারাবাঙ্কভি পরিচালিত ‘আখেরী স্টেশন’ ছবিতে সহকারী স্টেশন মাস্টারের একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৬৬ সালে রাজ্জাক ভাইয়ের জীবনে স্মরণীয় ঘটনা। জহির রায়হান পরিচালিত পৌরাণিক কাহিনী ‘বেহুলা’ ছবিতে তিনি নায়ক হিসাবে নির্বাচিত হন। তার বিপরীতে নায়িকা হলেন সুচন্দা। সেই বছরেই ছবিটি মুক্তি পায় এবং প্রচুর দর্শক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘আনোয়ারা’ একের পর এক ব্যবসা সফল ছবি। সাফল্যের চূড়ান্তে পৌঁছে যান রাজ্জাক ভাই।

তিনি কবরীর সাথে প্রথম ছবি করেন ‘নিশি হলো ভোর’। এরপর ‘আর্বিভাব’, ‘এতোটুকু আশা’, ‘বাঁশরী’, ‘ময়নামতি’। রাজ্জাক- কবরীর রোমান্টিক জুটির জনপ্রিয়তা ছিলো সবার শীর্ষে। এ ছাড়া তিনি আরো জুটি বাঁধেন সুচন্দা, সুজাতা, শাবানা ও ববিতার সাথে। সব নায়িকার সাথেই তিনি সফল জুটি করতে সক্ষম হয়েছেন। রাজ্জাক ভাই চলচ্চিত্রে কখনো হয়েছেন রোমান্টিক প্রেমিক, কখনো রংবাজের রংবাজ, কখনো পাগলা রাজা, কখনো গুন্ডা, কখনো লাইলী মজনুর মজনু, কখনো বেঈমান। ১৯৭৬ সালে নির্মিত ‘রংবাজ’ বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের প্রথম আধুনিক এ্যাকশান ঘরানার ছবি। ‘অনন্ত প্রেম’ তার প্রথম পরিচালিত ছবি। ‘আকাঙ্খা’ দিয়ে তার প্রযোজনা জীবন শুরু। তিনি শুধুমাত্র এই দেশের দর্শকদের ভালোবাসাই পাননি, পেয়েছেন তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৭৬ সালে ‘কি যে করি’, ১৯৭৮ সালে ‘অশিক্ষিত’, ১৯৮২ সালে ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ১৯৮৪ সালে ‘চন্দ্রনাথ’ ও ১৯৮৮ সালে ‘যোগাযোগ’ ছবিতে অভিনয়ের জন্যে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান রাজ্জাক ভাই। এ ছাড়া বাচসাস ও বিভিন্ন সংগঠন থেকে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননা। ইউনিসেফ-এর ইউএনএফপিএ’র  শুভেচ্ছা দূত নির্বাচিত হওয়া প্রথম বাংলাদেশী চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তিনি। এবং সর্বশেষে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার ও লাইফ টাইম এ্যাচিভমেন্ট সম্মাননা লাভ করেন।

আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাস ৬০ বছর পেরিয়ে গেছে। দীর্ঘ ইতিহাসে সর্বপ্রথম যে নামটা চলচ্চিত্রাকাশে এখনো উজ্জ্বল চন্দ্রের মতো বিকশিত হয়ে শোভা পাচ্ছে সেই নাম নায়করাজ রাজ্জাক। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যিনি আত্মার সাথে মিশিয়ে রেখেছিলেন চলচ্চিত্র। যার ধ্যান-জ্ঞান, চিন্তা চেতনা সবই আবর্তীত হতো চলচ্চিত্র ঘিরে। যিনি বলেছিলেন, অভিনয় করতে করতে আমি মরে যেতে চাই। এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখায় অভিনয়ে, পরিচালনায়, প্রযোজনায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছেন। বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের কারণে ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি অগণিত ভক্তদের কাঁদিয়ে চির বিদায় নেন। শোকে স্থবীর হয়ে যায় চলচ্চিত্র অঙ্গনসহ সারা দেশ। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে চলচ্চিত্র পরিবার, সাধারণ মানুষ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েছিল সেদিন। আমরা সেদিন হারাই একজন চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী পুরুষকে। যার হৃদয়জুড়ে ছিলো চলচ্চিত্র ভাবনা ও চলচ্চিত্রের মঙ্গল কামনা। আজ এই দিনে মহান আল্লাহর কাছে আমাদের আকুল আবেদন তিনি যেন রাজ্জাক ভাইকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করেন। আমীন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়