ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘সাজা কমায় কি খালেদার শারীরিক অবস্থা ভালো হয়েছে?’

মেহেদী হাসান ডালিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫৮, ১৮ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘সাজা কমায় কি খালেদার শারীরিক অবস্থা ভালো হয়েছে?’

নিজস্ব প্রতিবেদক : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিনের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিলের শুনানিতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছেন, খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ, এটা বিবেচনা করে তাকে নিম্ন আদালত ১০ বছরের স্থলে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ কারণে তিনি দুই বার সুবিধা পেতে পারেন না।

এর জবাবে আপিল বিভাগ বলেছেন, পাঁচ বছরের সাজা দেওয়ায় উনার (খালেদা জিয়ার) শারীরিক অবস্থা কি ভালো হয়ে গেছে?

রোববার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ প্রশ্ন রাখেন।

শুনানির শুরুতেই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, গত ১২ মার্চ চারটি যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। 

যে চারটি যুক্তিতে খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া হয়েছে, এর প্রথমটি হলো- হাইকোর্ট বলেছেন, খালেদা জিয়া জামিনের অপব্যবহার করেননি। এ প্রসঙ্গে দুদক আইনজীবী আদালতে বলেন, তিনি বিচারিক আদালতের অনুমতি না নিয়েই বিদেশে গেছেন। কাজেই হাইকোর্টের এ যুক্তি সঠিক নয়।

মেডিক্যাল গ্রাউন্ডস প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসকদের কোনো কাগজপত্র দেননি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া বয়স্ক মহিলা এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ। এ কারণে বিচারিক আদালত ১০ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া সমীচীন মনে করেছেন। তিনি একই সুবিধা দুই বার পেতে পারেন না।

এ সময় আদালত বলেন, এটা বিচারিক আদালত গ্রহণ করেছেন? খুরশীদ আলম খান বলেন, হ্যাঁ, গ্রহণ করেছেন। ১০ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে।

তখন আদালত প্রশ্ন রাখেন, পাঁচ বছরের সাজা দেওয়ায় উনার শারীরিক অবস্থা কি ভালো হয়ে গেছে? জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, এ মামলায় রায়ের আগে ও পরে দুই মাস ২৫ দিন যাবত কারাগারে আছেন তিনি। হাইকোর্ট উনাকে চার মাসের জামিন দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে পেপারবুক প্রস্তুতের নির্দেশ দিয়েছেন। পেপারবুক প্রস্তুত হলে শুনানি হোক, সে পর্যন্ত তিনি জেলে থাকুক। আপিল নিষ্পত্তি হলে তিনি আবার জামিন আবেদন করতে পারবেন।

তখন আদালত জানতে চান, এই উপমহাদেশে জয়ললিতা, লালু প্রসাদ যাদব কতদিন কারাগারে ছিলেন?

জবাবে খুরশীদ আলম খান বলেন, জয়ললিতার দুর্নীতি মামলায় বিচারিক আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। সুপ্রিম কোর্টেও এ রায় বহাল ছিল। তার সহযোগী শশীকলা এবং অন্য আরেকটি মামলায় লালু প্রসাদ যাদব এখনো কারাগারে আছেন। কাজেই দুই মাস ২৫ দিনের মধ্যে জামিন পাবেন এট ঠিক হবে না।

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি সারসংক্ষেপ বলতে চাই। তিনি মামলার বিস্তারিত পড়া শুরু করলে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী এতে আপত্তি করেন। এ জে মোহ্ম্মদ আলী বলেন, এখন তো আপিলের শুনানি হচ্ছে না। মামলার সারবত্তায় (মেরিট) যাওয়ার দরকার কি?

প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা মামলাটি একটু ভালো করে শুনি। আপনারাই বলেছেন, আমরা গত দিন শুনি নাই। আমরা আপনাদের কথা পরে শুনব। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা হলো একটা সারসংক্ষেপ। বিচারিক আদালতের রায়ে একজন সাক্ষীর মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছে, এতিমখানার টাকা উত্তোলনে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার অনুমোদন ছিল। এরমধ্যে তারেক রহমান ও  মুমিনুর রহমান ৪ লাখ টাকা তুলে নিয়েছে। তারা কীভাবে এ টাকা তুলে নিলো?

আদালত বলেন, এটা কি ব্যক্তি নামে ছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হ্যাঁ, ব্যক্তি নামে ছিল। এফডিআর করা নিয়ে একটা মামলাও হয়। কীভাবে বিদেশ থেকে টাকা এলো, কীভাবে এফডিআর হলো? তারা জমি কেনার জন্য টাকা দিয়েছিল। কিন্ত যখন জমি পাচ্ছিল না তখন তারা জমির জন্য চাপ না দিয়ে টাকা ফেরত চেয়েছেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল হাইকোর্টের চারটি যুক্তির পাল্টা যুক্তি উপস্থাপন করে বলেন, তাকে স্বল্প মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে। আর আপিল শুনানি হবে না এটা অযৌক্তিক। আমাদের এ কোর্টে বিডিআর মামলা ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। আমরা হাজার হাজার পৃষ্ঠার পেপারবুক তৈরি করেছি।

খালেদা জিয়া জামিনের অপব্যবহার করেননি, এ যুক্তিতে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এখন তিনি (খালেদা জিয়া) দণ্ডিত। এটা এখন বিচারাধীন বিষয়। একই যুক্তি এখানে প্রযোজ্য হবে না। খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ, এ যুক্তির জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান এবং বয়স্ক নারী। এ বিবেচনায় তাকে ১০ বছরের সাজা না দিয়ে পাঁচ বছরের সাজা দিয়েছেন বিচারিক আদালত। একজন আসামিকে কতবার এই সুবিধা দেওয়া হবে।

তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দয়া এবং বার বার অনুকম্পা দেখানো ঠিক হবে না। কোনো রাষ্ট্রেই এটা দেখানো হয়নি। এরপর তিনি পাকিস্তানে কী হয়েছে, এর নজির দেখান।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমাদের দেশে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের সাড়ে তিন বছর জনতা টাওয়ার মামলায় সাজা হয়েছিল। উনি জেলও খেটেছেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, লালু প্রসাদের সঙ্গে কি এ ঘটনার মিল আছে? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সুপ্রিম কোর্টেও তার জামিন খারিজ হয়েছিল।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে অসুস্থ বলা হচ্ছে কিন্ত তিনি মিটিং করছেন, সমাবেশ করছেন, বিদেশ যাচ্ছেন সবকিছু করছেন। আজকে যদি জামিন দেওয়া হয় তাহলে আপিলের শুনানি অনিশ্চিত হয়ে যাবে।

এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপিল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় হাইকোর্ট জামিন দিতে পারে, নাও দিতে পারে। তবে জামিন দেওয়াটাই স্বাভাবিক। লঘুদণ্ডের কারণে হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। জামিন না দেওয়ার নজির খুবই কম। সাধারণত দেখা যায়, আপিল বিভাগ হাইকোর্টের জামিনের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেনি। সীমিত ক্ষেত্রে আপিল বিভাগকে হস্তক্ষেপ করতে দেখা গেছে। যদি ন্যায়বিচার বিঘ্নিত হয়েছে সেক্ষেত্রে আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করতে পারেন। হাইকোর্ট হচ্ছে এ ধরণের মামলায় জামিন দেওয়া বা না দেওয়ার  স্বাভাবিক কর্তৃপক্ষ।

এর পরে আদালত বিরতিতে যান।

বেলা সাড়ে ১১টায় শুনানির শুরুতেই এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ৪২৬ ধারায় মামলার সারবত্তা যাচাই করা হাইকোর্টের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। হাইকোর্টে আবেদন আসবে তারা এটা পুরোটাই দেখবে। তারপর তারা জামিন দিবে কি দিবে না, সিদ্ধান্ত জানাবেন। আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করে না যদি না এখানে বিচারের বিচ্যুতি ঘটে।

এ সময় বিচারপতি ইমান আলী জানতে চান- বিচারিক আদালত দণ্ড ও হাইকোর্ট দণ্ড দিলে সেক্ষেত্রে হাইকোর্ট কি হস্তক্ষেপ করতে পারে না? জবাবে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, অনেক মামলায় হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন। শুধু আপিল বিভাগ এটাতে হস্তক্ষেপ করে নাই।

তিনি বলেন, মামলার কাগজপত্র তৈরি করা। রায়ের কোথাও বলা হয়নি খালেদা জিয়া অর্থ আত্মসাতে জড়িত। তার (খালেদা জিয়া) স্বাক্ষর ছিল কোথাও বলা হয়নি।  এটা পরিষ্কার যে এ ধরনের জামিনের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করে নাই।

এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, স্বল্পমেয়াদে সাজা একটি দিক, আপিল হচ্ছে আরেকটি দিক। সাজা যদি কমে তাহলে ভারসাম্যের ওপর জোর দিতে হবে। লাখ লাখ সাধারণ মামলা ছেড়ে দিয়ে এটাকে সামনে আনা হচ্ছে। এটাকেই আগে শুনতে হবে। উনি (অ্যাটর্নি জেনারেল) অনেক বড় গল্প বললেন। আমি এটার জবাব দেয়া সমীচীন মনে করি না। মামলাটি আদালতের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলুক। আমি মনে করি, হাইকোর্টের জামিনের সিদ্ধান্ত সঠিক।

এ পর্যায়ে খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এটা খালেদা জিয়ার মামলা তাই এ মামলার গুরুত্ব অনেক। তিনি না হলে আমরাও আসতাম না, সরকারও এত উৎসাহী হতো না। হাইকোর্টের ক্ষমতা আছে জামিন দেওয়ার।

এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ১০ বছরের সাজার দু-একটি মামলা আছে, যেগুলোতে জামিন মিলেছে, কিন্ত আপিল বিভাগ হস্তক্ষেপ করেনি।

আদালত আদেশের জন্য সোমবার দিন ধার্য করেন। এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, সম্প্রতি একটি রায়ে এতিমখানার জায়াগায় নির্মিত ১৮তলা একটি ভবন এতিমখানাকে বুঝিয়ে দিতে বলেছেন। অতএব এ মামলাতেও এতিমদের টাকা উধাও হয়েছে। জবাবে মাহবুব উদ্দিন খোকন অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে বলেন, শেখ হাসিনার মামলায় সরকার বা দুদককে এভাবে আসতে দেখিনি, যতটা এ মামলায় দেখেছি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ মার্চ ২০১৮/মেহেদী/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়