ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘যারা দুর্নীতিতে মোড়া, জনগণ কেন তাদের ভোট দেবে’

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৩, ২৩ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘যারা দুর্নীতিতে মোড়া, জনগণ কেন তাদের ভোট দেবে’

নিজস্ব প্রতিবেদক, জাতীয় সংসদ থেকে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, যারা জ্যান্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করে, সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করে, জনগণের টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করে, যারা দুর্নীতিতে আগাগোড়া মোড়া, জনগণ কেন তাদের ভোট দেবে? তারা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে কীভাবে?

বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় সংসদের ১৮তম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে, যাদের বিবেক আছে তারা অন্তত ওদের (বিএনপি-জামায়াত) কোনোদিন ভোট দেবে না, ভোট দিতে পারে না। তাদের ভোট দিয়ে আর অশান্তি টেনে আনবে না। এই আপদকে ফিরিয়ে আনবে না। তাই ওদের স্বপ্ন দেখে কোনো লাভ নেই, বড় বড় কথা বলেও লাভ নেই।

মানুষ শান্তি ও উন্নতি চায়, এ কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে, মানুষ শান্তিতে আছে। তাই যারা (খালেদা জিয়া) এতিমের টাকা চুরি করে খায়, দেশকে পাঁচ বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন করে, জনগণ তাদের ভোট দেবে না। এটাই হলো বাস্তবতা। 

প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সমাপনী বক্তব্য রাখেন বিরোধী দলের নেতা বেগম রওশন এরশাদ। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শেষে স্পিকার সংসদ অধিবেশন সমাপ্তিসংক্রান্ত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আদেশ পাঠ করেন।

১৮তম অধিবেশনে মোট কার্যদিবস ছিল ১০টি। ঐতিহাসিক ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্থান পাওয়ায় এই অধিবেশনে ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে।

গুম-খুন প্রসঙ্গে বিরোধী দলের নেতার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গুম-খুন নানাভাবেই হচ্ছে। যারা নিখোঁজ হচ্ছে তাদের অনেকে আবার ফেরতও আসছে। এটা কি শুধু বাংলাদেশে হচ্ছে? যুক্তরাজ্যে ২ লাখ ৪৫ হাজার নাগরিক গুম হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা আরো ভয়াবহ।

তিনি বলেন, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে ১৬ কোটির ওপরে জনগণ বাস করে। আমরা এত মানুষের সেবা করে যাচ্ছি। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর জনসংখ্যা কত? উন্নতি প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরও তাদের দেশে এত গুম হচ্ছে। আমরা যখনই অভিযোগ পাচ্ছি তা খতিয়ে দেখছি। দেশে একজন স্বনামধন্য আঁতেল (ফরহাদ মাযহার) আছেন, তিনি গুম হয়ে গেলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তিনি খুলনায় নিউ মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ ধরণের ঘটনা তো অহরহই ঘটছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে দেশের অবস্থা কী ছিল?  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছিল অস্ত্রের ঝনঝনানি। আমরা সেই অবস্থার পরিবর্তন করেছি। প্রতি বছরই শিক্ষার্থীদের আমরা বিনামূল্যে বই বিতরণ করছি। শিক্ষার হার ৭২ ভাগে উন্নীত হয়েছে। পাসের হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আর সেশনজট নেই।

বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে আরেকটি দল আছে, তারা নির্বাচনে আসেনি। এখন রাস্তায় রাস্তায় চিৎকার করে বেড়াচ্ছে। বলছে, তারা সরকারকে নাকি টেনে নামাবেন। এটা এমন একজন লোক বললেন, তার চরিত্র কী? ছাত্রাবস্থায় অন্য একটি দল করত। ব্যারিস্টারি করে দেশে ফেরার পর দেখলাম আমাদের বাড়ি থেকে নড়েন না। আঠার মতো পড়ে থাকেন। তখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর পিএ মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন। তার পিএ হিসেবেও এই লোকটা কিছুদিন কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তিনি বিএনপিতে গেলেন। এরপর গেলেন জাতীয় পার্টিতে। তিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন। আবার জেনারেল এরশাদ চলে যাওয়ার পর আবারও গেলেন বিএনপিতে। তিনি বনানীতে চিটিং করে অবৈধভাবে একটি বাড়ি দখল করেছিলেন। আদালতের রায়ে সেই বাড়িটি হারিয়েছেন। এখন সেই ব্যক্তিটিই ঘোষণা দেন সরকারকে নাকি টেনে নামাবেন। যিনি নিজেই মাটিতে পড়ে আছেন, তিনি কীভাবে টেনে নামাবেন?

বিএনপি-জামায়াতের সরকার উৎখাত ও নির্বাচন বানচালের নামে দেশজুড়ে ভয়াল নাশকতার চিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না ঘটিয়ে তিনি ঘরে ফিরে যাবে না। ৯২ দিন ধরে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছেন। নির্বাচন ঠেকানোর নামে ৫৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুড়িয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২৭ জন সদস্যকে হত্যা করেছেন। জনগণের বাধায় বাধ্য হয়ে শুধু ঘরেই ফিরে যাননি, আদালতে আত্মসমর্পণ করে ঘরে ফিরেছেন।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষ এটা বুঝতে পেরেছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের উন্নয়ন হয় এবং হবে। মানুষ সুন্দরভাবে বাঁচতে চায়, শান্তি চায়, উন্নতি চায়। এটা আওয়ামী লীগই যে করতে পারে তা প্রমাণ করেছি। আমরা দেশকে সম্মানজনক অবস্থায় নিয়ে গেছি। যতক্ষণ ক্ষমতায় আছি, দেশের মানুষকে উন্নতি দিয়ে যাব। যাতে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে উঠে। বাংলাদেশকে আমরা জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ হিসেবে গড়ে তুলব, তার আকাঙ্ক্ষা আমরা পূরণ করব।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার যে জনগণের সেবক সেটা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। গত ৮ বছরে বাংলাদেশকে আমরা আর্থ-সামাজিকভাবে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছি, বাংলাদেশকে আর ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে দেখে না। বরং সারা বিশ্বে বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি। জনগণের প্রতি আস্থা-বিশ্বাস থাকতে হবে। ক্ষমতাটা যদি ভোগের বস্তু হয় তারা কি জাতিকে কিছু দিতে পারে? আমাদের কাছে ক্ষমতা ভোগের নয়, বরং কল্যাণে কাজ করছি বলেই দেশের এমন অগ্রগতি হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, অনেকে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখনই আইপিইউ ও সিপিইউর মতো সারা বিশ্বের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা এই দুটি বৃহৎ সংস্থায় বাংলাদেশের দুজন সংসদ সদস্যকে সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। এটা একটা বিরল ঘটনা। আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি, সেটা বিশ্বের জনপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে দেখে গেছেন। অনেকে বলে নির্বাচন অবৈধ। এটা শুনে মনে হয়, যারা এ কথা বলে শুধু তাদেরই জ্ঞানের ভাণ্ডার আছে। আর বিশ্বের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যারা আমাদের দুজনকে নির্বাচিত করলেন, তাদের মনে হয় কোনো জ্ঞান নেই। তারা যেন না জেনেই বাংলাদেশকে ভোট দিয়ে গেলেন। দুটি সম্মেলনই অত্যন্ত সফলভাবে হয়েছে। সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছি, বাংলাদেশে কীভাবে গণতন্ত্রের চর্চা হয়। বিশ্বের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও তা দেখে গেছেন।

রোহিঙ্গা সমস্যা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার স্বীকার করেছে, তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে যৌক্তিকভাবে সমস্যার সমাধান করছি। মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। সারা প্রায় ১০ লাখ মানুষের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করতে পেরেছি। সারা বিশ্ব আমাদের পক্ষে এবং সমর্থন দিচ্ছে।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে, এ আশা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি মানুষ গৃহহীন থাকবে না, প্রত্যেকে পেটভরে খাবে, উন্নত জীবন পাবে- সেসব লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলব, ইনশাআল্লাহ।

সরকারের উন্নয়ন ও সফলতা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে। হতদরিদ্র্যের হারও কমে গেছে। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে দেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি বলেই সুফল জনগণ পাচ্ছে। ৮ বছরের মধ্যে ২৫ হাজার কিলোমিটার রাস্তা করেছি, পদ্মাসহ ৪৮টি বৃহৎ সেতু নির্মাণ করেছি। কর্ণফুলীর নিচে টানেল নির্মাণ করছি। রেলকে আমরা নতুনভাবে জীবন দিয়েছি। খাদ্য উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় এবং মিঠা মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে। আগে একজন শ্রমিক সারা দিন খেটে একবেলা খাবার চাল কিনতে পারত না। এখন একবেলা খেটে দিনমজুররা ১০ কেজি চাল পর্যন্ত কিনতে পারে। দেশে বেকারত্ব হ্রাস পেয়েছে। দেশে-বিদেশে দেড় কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছি। সমগ্র বাংলাদেশকে আমরা ইন্টারনেটের আওতায় নিয়ে এসেছি।

সংসদ নেতা বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের সরকার সেইভাবেই কাজ করে যাচ্ছে। পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন। বর্জ্যটা রাশিয়া নিয়ে যাবে। এটা নিয়ে দুঃচিন্তার কোনো কারণ নেই। জার্মানির শহরের ভেতরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে। পরিবেশের কোনো ক্ষতি হলে আমরা তা করতাম না।  আমাদের দেশে কিছু মানুষ আছে, তারা সবকিছুই বাঁকা চোখে দেখে, কোন কিছুই তাদের ভালো লাগে না। এরা কী বলল, তাদের কথা শুনে তো দেশের উন্নয়ন বন্ধ করে দিতে পারি না। দেশের মানুষকে আমাদের বিদ্যুত দিতে হবে। দেশের ৮০ ভাগ মানুষ এখন বিদ্যুত পাচ্ছে। শতভাগ মানুষের বিদ্যুত নিশ্চিত করতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ নভেম্বর ২০১৭/আসাদ/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়