ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

স্বপ্নভঙ্গে এক শিল্পসত্ত্বার মৃত্যু!

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫০, ২৭ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্বপ্নভঙ্গে এক শিল্পসত্ত্বার মৃত্যু!

স্টুডিও কক্ষে টুকু- ছবি: আরিফ সাওন

আরিফ সাওন, বাগেরহাট থেকে ফিরে: বাইরে থেকে বোঝাই যায় না যে, ভাঙা ঘরের মধ্যে এতো সম্পদ, এতো ধন, এতো রত্ন। তবে সবই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। খেয়ে যাচ্ছে উই পোকায়, পড়ে যাচ্ছে ধুলার আবরণ। যেমন সাজানো গোছানো ছিলো, এখন আর তেমন নেই! ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মেঝেতে আর কানায় কোনায়!

একসময়ের প্রাণচঞ্চল সেই ঘরের মধ্যে এখন আর প্রাণ নেই! এখন আর নেই সেই কোলাহল! এখন আর এলাকার ছেলেমেয়েরা আসে না আঁকা দেখতে। কারণ, এখন আর টুকু আঁকেন না। টাকার অভাবে টুকুর ছবি আঁকা বন্ধ। হঠাৎ করে নয়, ধীরে ধীরেই হয়ে গেছে এক শিল্পসত্ত্বার মৃত্যু!

তারিকুল ইসলাম টুকুর স্বপ্ন ছিলো অনেক বড় চিত্রশিল্পী হবেন! কিন্তু এখন তার রং কেনারই টাকা নেই। এখন তিনি এক প্রকার দিনমজুরের মত কাজ করেন; শুধু দু বেলা দু মুঠো খেয়ে বাঁচার জন্য।

বড় ইচ্ছে ছিলো, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি অয়েল পিইন্টিং করবেন। ২২ ফুট আকারে ফ্রেম করে কাজও শুরু করেছিলেন। রং তুলির আঁচড়ে অর্ধেক কাজ প্রায় সেরেও ফেলেছিলেন। কিন্ত বেশি আর এগোতে পারেননি। আর্থিক অসচ্ছলতাই বিশাল প্রাচীর গড়ে তুলেছে। তিনি আর পারছেন না সেই প্রাচীর পেরোতে।

 

 

খুব আশা নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তা আর হলো কই! কল্পনাই রয়ে গেলো সেই ২২ ফুটে ফুটিয়ে তুলতে চাওয়া নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ। মনের ক্যানভাসে রয়ে গেলো সবই, বাস্তবে আর হলো না। যতটুকু এঁকেছিলেন তাও প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।

বেশিদূর লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি টুকুর। এসএসসির গণ্ডিও পেরোতে পারেন নি। খুব ছোট বেলা থেকেই তাকে ছবি আঁকার নেশায় পেয়ে বসে। প্রথমে পেন্সিল দিয়ে স্কেচ করতেন। পরে অয়েল পেইন্টিং শুরু করেন।

টুকুর বাবা আমজাদ হোসেন। বাগেরহাটের কুচয়া উপজেলার সাংদিয়া গ্রামের এই আমজাদ হোসেন একসময় যাত্রাগানের জনপ্রিয় অভিনেতা ছিলেন। তার সামনের ফোলানো চুল আর দরাজ গলার প্রশংসা ছিলো মানুষের মুখে মুখে। শুধু অভিনয় নয়, লিখতেনও, পালা লিখতেন। এখন বয়স অনেক হয়েছে। সারাদিন বইয়ের মাঝে ডুবে থাকেন। বইই তার মনের খোরাক যোগায়। চোখের সামনে হাতে ধরে রাখা বই পেটের ক্ষুধাও কখনো কখনো ভুলিয়ে দেয়।

তিনিই টুকুকে উপন্যাস, কবিতা, নাটকের বই কিনে এনে দিতেন। সে সব বই অবলম্বনে চিত্রকর্ম করতেন টুকু। মনের মাধুরী দিয়ে ফুটিয়ে তুলতেন সেই বইয়ের বর্ণনায় ফুটে ওঠা জীবন চিত্র আর প্রাকৃতিক দৃশ্য।

 

 

এছাড়া এঁকেছেন ১৯৭১ এর রক্তাক্ত বাংলা; স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়া লাশ, শকুনের ঝাঁক, মা-বোনের উপর হানাদারের তাণ্ডব আর মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। টুকু তুলির টান দিয়েছেন মৌলবাদ আর ফতোয়াবাজীর বিরুদ্ধেও।

প্রখ্যাত রুশ কথা সাহিত্যিক ম্যাক্সিম গোর্কির গল্প অনুসরণে শ্রাবনের বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় ভাঙা নৌকার নিচে যোনকর্মীর সাথে নায়কের অবস্থান, এক নারী ও ২৬ পুরুষ নিয়ে লেখা গল্পকেও টুকু তার কল্পনায় এঁকেছেন। মৎস্য কন্যাকেও কল্পনা করেছেন। পানিতে পড়ে যাওয়া পাখিকে তুলে এনে বাঁচানোর মানবিক চিত্রও তুলে ধরেছেন।

সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসা ফুটে উঠেছে ঝড়ের মধ্যে ছেলেকে পিঠে নিয়ে বাবার নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার মধ্যে। প্রেমিক মনে বিরহ প্রকাশ করেছেন নৌকায় বসা তরুণ তরুণীর চিত্রে। ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন রূপসী বাংলার রূপ, গ্রাম বাংলার চিরায়ত দৃশ্য। মনের মাধুরীতে অনেক চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেছেন তিনি।

টুকু জানান, তিনি একবার ঢাকায় এসেছিলেন। কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির কাছে গিয়েছিলেন। তার চিত্রকর্ম তাদের দেখিয়েছেন। তারা তাকে ঢাকায় এসে প্রদর্শনী করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু প্রদর্শনী করার টাকা কোথায় পাবেন! চিত্রকর্মগুলো বহন করে আনার যে খরচ সেটা মেটানোর সামর্থ তার নেই।  

আগে প্রতিবছর দেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী এসএম সুলতানের বাড়িতে যেতেন। কয়েক বছর ধরে টাকার অভাবে তার সেখানেও যাওয়া হয় না।

গত প্রায় একবছর হলো তিনি আর ছবি আঁকেন না। তৈলচিত্র শুরু করেছিলেন ২০১০ সালে। আরো অনেক আগেই তৈলচিত্র করা বন্ধ হয়ে যেতো। মাঝে কিছু দিন তার মামা রং আর প্রয়োজনীয় জিনিষ কেনার টাকা দিয়েছেন। এখন তিনিও আর দেন না। মাঝে কিছু ছবি এলাকার কয়েকজন তরুণের কাছে বিক্রি করেছেন। তাদের কাছ থেকে শুধু খরচের টাকা নিয়েছেন।

বাবার পেনশন আর টুকুর দিনমজুরির পারিশ্রমিকের টাকায় এখন সংসার চলে। টুকুর মা জাহানারা বেগম একসময় স্বপ্ন দেখতেন তার ছেলে অনেক বড় মাপের চিত্রশিল্পী হবে। কিন্তু এখন সেই মা সেই স্বপ্ন আর দেখেন না। খুব কষ্টেই দিন কাটে তাদের। বলতে গিয়ে অশ্রু মোছেন কাপড়ের আঁচলে। টুকুর বাবাও টুকুর চিত্রকর্ম নিয়ে তেমন কিছু বললেন না। শুধু দীর্ঘশ্বাস নিলেন।

টুকুর ছবি আকার স্টুডিও এক কক্ষের একটি টিনশেড ঘর। গত ২১ জুন সেখানেই বসে কথা হয় তার সাথে। মলিন হয়ে যাওয়া সেই স্টুডিও কক্ষের বাম পাশে একটা ক্যালেন্ডার ঝোলানো। ক্যালেন্ডারটি দেখিয়ে ৩৬ বছর বয়সী টুকু বলেন, ‘বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ভিনসেন্ট উইলিয়াম ভ্যান গগের চিত্রকর্ম দিয়ে করা হয়েছে এই ক্যালেন্ডার। এখন অনেক টাকায় বিক্রি হয় ভ্যান গগের ছবি।’ টুকু আশা করেন, তার ছবিও বিক্রি হবে, একদিন ...।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ জুন ২০১৯/সাওন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়