ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

একজন ‘আতর আলী’র গল্প

আবদুল মান্নান পলাশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৪৪, ২৬ এপ্রিল ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একজন ‘আতর আলী’র গল্প

পথে দুধওয়ালাকে আতর মাখিয়ে দিচ্ছেন আবুল কাশেম ওরফে আতর আলী (ছবি : আবদুল মান্নান পলাশ)

আবদুল মান্নান পলাশ, চাটমোহর (পাবনা) : আসল নামটি তার হারাতে বসেছে সুগন্ধী আতরের আড়ালে। কেউ বলে আতর আলী। অনেকেই বলে আবুল কাশেম আতরী। আসলে তার পিতৃপ্রদত্ত নামটি আবুল কাশেম। হালে আলহাজ আবুল কাশেম। ৪১ বছর ধরে তিনি মানুষের মাঝে আতর বিলিয়ে যাচ্ছেন নিঃস্বার্থভাবে।

পথে-ঘাটে-মাঠে যেখানেই মানুষ তাকে দেখে এগিয়ে যায়, একটু আতর মাখিয়ে নিতে। তিনিও যখন যার সঙ্গে যেখানে দেখা মেলে না চাইতেই আতরের শিশি বের করে হাতে-মুখে-বুকে মাখিয়ে দেন আতর। তার আতরময় জীবনের গল্প শুনতে শনিবার বিকেলে পাবনার চাটমোহর উপজেলা সদর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে মথুরাপুর ইউনিয়নের ছোট গুয়াখড়া গ্রামে যাই। তখন বিকেল সোয়া ৪টা। বাড়ির বৈঠকখানায় বৃহত্তর চাটমোহর সদর ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ৭২ বছর বয়সী আবুল কাশেম আতরী বসে একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

সালাম দিয়ে জানাই, ‘আপনার সঙ্গে একটু হাঁটব।’ পাঞ্জাবির পকেট থেকে সৌদির আতর মাখিয়ে দেন। নেমে আসেন বাড়ির সামনের কাঁচা পথে। হাঁটা পথে কথা পাড়ি। হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয় দুধওয়ালা, অটোভ্যানওয়াল, চায়ের দোকানদারের সঙ্গে। সবাই তাকে দেখে এগিয়ে আসেন আতর মাখতে। নিয়ে যান তার গ্রামের এতিম খানায়। হুড়মুড় করে হেফজোখানার শিক্ষার্থীরা ছুটে আসে তার কাছে, ‘আতর চাচা, আতর দেন।’ আবদার নিয়ে বলে তারা।

আতর আলীর সত্যিকার অবস্থা বুঝে নিয়ে আবারও যাই তার বাড়িতে। এরপর অনেক কথা।

 

 

বলেন, ‘আমি নিজে আতর পছন্দ করি। মাখতাম নিজে। শখের বশে ১৯৭৪ সাল থেকে আতর বিলাতে শুরু করি। তখন সদর ইউনিয়নের ভাইস চেয়ারম্যান। ১৯৮৩ সালে হলাম চেয়ারম্যান। আতর বিলানো তখন বেড়ে গেল। অনেক মানুষের সঙ্গে চলি-ফিরি।’

 

জানতে চাই, ‘সেই ১৯৭৪ থেকে ২০১৫ অবধি তো আতর চালুই আছে। বলুন তো, কি পরিমাণ ও কত টাকার আতর বিলিয়েছেন?’ বলেন, ‘সে হিসাব তো কোনোদিন করিনি। মনের আনন্দে কাজটা করে আসছি।’ অনুরোধের পর হাতের মুঠোফোনের ক্যালকুলেটরে ঢুকে হিসাব কষেন।

 

আতর আলী বলেন, ‘গড়ে দিনে ৪ ড্রাম (শিশি)। যার দাম প্রায়  ৫০ টাকা। সে হিসাবে মাসে ১,৫০০ টাকা। বছরে ১৮ হাজার টাকা। আর ৪১ বছরে ৭ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।’ নিজেই অবাক হয়ে বলেন, ‘এতো টাকা! হিসাব তো আগে করা হয়নি।’ বলি ‘এবার আতরের পরিমাণটা কত হবে বের করুন তো।’ আবার ক্যালকুলেটরে হিসাব করে বলেন, ‘৫ লাখ ৯০৪০ ড্রাম (শিশি)। এ টাকায় চাটমোহর শহরে তো একটা বাড়ি করা যেতো ভাই। জীবনে হিসাব করি নাই।’

 

তার গ্রামের দুধওয়ালা হাসান আলী (৪২)বলেন, ‘ছোটবেলা থ্যাকেই আতর দেওয়া দেখতিচি। ৮৩ সালে তিনি ভোটে জিতলি পরে আমরা স্লোগান বানাইচিলেম- টেকায়ালা হারে গেল, আতর আলী জিতে গেল।’ প্রভাকরপাড়া গ্রামের ইয়াছিন আলী (৫৫) বলেন, ‘মানুষটা আতরের মতোই ভালো। ইলাকার সবাই সুম্মান করে তাক। মথুরাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সরদার আজিজুল হক (৫০)বলেন, ‘আতরই তার এখন বড় পরিচিতি। সেই যুবককাল থেকে তাকে আতর দিতে দেখছি। তিনি ব্যতিক্রমী একজন মানুষ।’

 

 

ওই গ্রামের মৃত আব্দুল কাদের এর ছেলে আবুল কাশেম প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাড়ির পাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। ছাত্রবেলা থেকেই ছিলেন রাজনীতিতে সক্রিয়। এখন পড়ন্ত বেলায় হয়েছেন নিষ্ক্রীয়, যাপন করছেন ধর্মীয় জীবন। ২০১৩ সালে ৩ ভাই একসঙ্গে হজ পালন করে এসেছেন। শিক্ষিত ৪ ছেলে, ২ মেয়ের বাবা আবুল কাশেম বলেন, ‘পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ছেলেটির বিয়ে হলে দায়িত্ব শেষ হয়।’

 

তখন বেলা পশ্চিমে লাল কেটেছে। ভূমিকম্প নিয়ে কথা চলছে গ্রামের এখানে-সেখানে-উঠোনে। ফিরতে হবে ছয় কিলোমিটার দূরে শহরে। অটোভ্যানে (ব্যাটারি-চালিত ভ্যান)। সেই ভ্যানে ওঠার আগে প্রশ্ন করি, ‘কাশেম ভাই, কী পেলেন বলুন তো আতর বিলিয়ে।’ থমকে যান একটু। মেহেদী রাঙানো দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বলেন, ‘অনেক কিছু পেয়েছি জীবনে। কী পাইনি তুমিই বল তো ভাই। মানুষের ভালোবাসা আর (উপরে হাত তুলে) তার দয়ায় অনেক পেয়েছি এ জীবনে।

 

হালকা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আরো বলেন, ‘আমি মানুষের মাঝে সুগন্ধী আতর বিলিয়ে, তাদের মনের সুগন্ধ-সৌন্দর্য দেখতে চেয়েছি। সেটা আমি দেখতে পেয়েছি। এখনো পাচ্ছি। যতদিন বাঁচি সেটা পেয়ে যাব। পিক করে হর্ন দিয়ে অটোভ্যান ছুটে চলে। আমি আবুল কাশেম আতরীর শেষের কথা লো মুখস্থ করতে করতে শহরে ফিরি।





রাইজিংবিডি/পাবনা/২৬ এপ্রিল ২০১৫/পলাশ/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়