ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০২ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৯ ১৪৩১

ছোটগল্প || ডান হাতটার থাকা না-থাকা

খালেদ চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২৬ নভেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || ডান হাতটার থাকা না-থাকা

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

খালেদ চৌধুরী : হিন্দি ফিল্মে ‘বাল` শব্দটা নারীদের অন্যতম সৌন্দর্য প্রকাশ করলেও, সকালে আনিসের বাবা তাকে উদ্দেশ্য করে যেভাবে শব্দটি উচ্চারণ করছে তা নিঃসন্দেহে অশ্লীল। তার বাবার কথা অনুযায়ী সে, বাল ফালাইতে তেঁতুলতলা যাবে। সেখানে তার যাবার কথা ছিল। যদি সার্টিফিকেট তুলতে যেত। তাহলে হয়তো করিম বক্স ৫০টাকা বেশি দিয়ে ‘বাল’ ফালানোর পরিবর্তে সাতকরা আনতে বলত। কারণ গোস্তের কারিতে সাতকরা যোগ করলে মাংসের স্বাদ অলৌকিক হয়ে যায়!

 

এ বছর আনিস উচ্চ-মাধ্যমিকে ফেল মারে। সে ফেল মারবে আগেই জানত। কারণ ফিজিক্স-এ বিশ মার্কস আনসার করে, আর যা-ই আশা করুক; পাসের সম্ভাবনা নেই। এটা সে আগেই জানত। পরের চার সাবজেক্ট পরীক্ষায় সে নিটোল অভিনয় করেছে। তার মা-বাবা কিছুই বুঝতে পারেনি। আনিসের মা-বাবাও স্বপ্ন দেখত তাদের ছেলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে। সেই স্বপ্ন একবার কাগজের নৌকার মতো বৃষ্টিতে ভেজার পর আর শুকায়নি। হয়তো আনিসের দাদাও করিম বক্সকে নিয়ে এ জাতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য স্বপ্ন দেখত। তার বাবা বাল ফালানোর কথা বললেও তার মা নরম সুরেই কথা বলে। যদিও পড়াশোনার ব্যাপারে আনিসের চাইতে তার মা’র আগ্রহ অনেক বেশি। ধারণা করা যায়, মা ও ছেলে একসঙ্গে পরীক্ষা দিলে বোধহয় আনিসের মা-ই পাস করত। আনিস পড়াশোনায় ত্যানাইয়া গেল কেন? একবার ডাক্তারের অশোভন আচরণ দেখে প্রতিজ্ঞা করেছিল− ডাক্তার হবে। তার সেই জিদ ইঁদুরের গর্তে ডুব দিয়েছে। ইন্টারে ফেল করে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যখন খুশির ছড়াছড়ি, তখন তার অবশ অবস্থা। নিজেকে যদি বস্তায় পুরে আছাড় মারা যেত তাহলে সে তা-ই করত। আনিসের আত্মীয়-স্বজন ফোনে জানতে চেয়েছে, রেজাল্টের কী খবর? তার মা কারো সঙ্গে সত্য বলেছে, কারো সঙ্গে মিথ্যা।

 

আনিস রেল স্টেশনে অপেক্ষা করে− ট্রেন আসে না। তার কাছে একটা অন্ধ মেয়ে ভিক্ষা চায়। আনিস ভিক্ষা দেবার পাত্র না। এ ব্যাপারে সে খুবই কৃপণ। অন্ধ মেয়েটা তাকে ছাড়ে না। মেয়েটা টানা আট মিনিট অথবা দশ মিনিট কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর করে। আনিস মেয়েটার অধ্যাবসায়ের কাছে হার মানে। সে মানিব্যাগ থেকে একটা ছেঁড়া দুই টাকার নোট বের করে মেয়েটিকে দেয়। ট্রেনে ভিক্ষার বিপরীত একটা দৃশ্য তাকে বেশ ভাবায়। ট্রেন তখন শ্রীমঙ্গল। চা-বাগান পাড়ি দিচ্ছে। আনিসের বয়সী অথবা তার থেকে বড় গোল চেহারার এক তরুণী ছোট একটা কাগজ হাতে দেয়। কাগজে লেখা: ‘আমার বাবা নেই। আমরা দুই ভাই, দুই বোন। আমার বড় ভাই নেই। চকলেট বিক্রি করে যা পাই। তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চলে। আপনি দুটি চকলেট কিনলে উপকৃত হই।’

 

মেয়েটি দুটি চকলেট তিন টাকায় বিক্রি করে। আনিস চকলেট কেনে। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে ২-৩ জন ছাড়া কেউ চকলেট কেনে না। মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় অথচ কোনো প্রণোদনা নেই। আনিস চকলেট কেন কিনে? মেয়েটা সুন্দরী বলে! আনিস অস্বীকার করতে পারবে না। তার এক টাকা বেশি দিয়ে চকলেট কেনার জন্য মায়াবতীর গোল চেহারা অনেকাংশে দায়ী। আবার এমনও হতে পারে− মেয়েটার পাশে দাঁড়ানো। তাছাড়া সে তো ভিক্ষা করেনি। মেয়েটা তার রূপ রাতের আঁধারে বন্ধক রাখেনি। সে তো রূপজীবী হতে পারত। তার মুখ কি সেই সাক্ষ্য বহন করে? বরং মা ও ছোট ভাইবোনের দায়িত্ব নিয়েছে। ট্রেনের গতি শ্লথ হলে তরুণী নেমে যায়। আনিস জানালা দিয়ে তরুণীর ভাবলেশহীন চলে যাওয়া দেখে।

 

গন্তব্যের দিকে ট্রেন যতই ছুটেছে আনিস ততই ভাবে- কার বাসায় উঠবে? কোনো বন্ধুর বাসায় ওঠা যাবে না। যতটুকু সম্ভব অন্তর্ধানে থেকে কাজটা সারতে হবে। কার বাসায় উঠবে? আমিরুল না কাইয়ুম। দুজনই তার থেকে বয়সে বড়। ভাবতে ভাবতেই এক সময় ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছে। আনিস ট্রেন থেকে নামে। কাইয়ুমকে ফোন দেয়। তার মোবাইল বন্ধ পেয়ে বাধ্য হয়ে আমিরুলের কাছে যায়। আমিরুল খুব ব্যস্ত। আনিসকে বলে, ‘কিতাবা বাসার সবাই ভালানি?’ অনেক দিন পর আনিসকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে। পকেট থেকে একশ টাকার নোট বের করে বলে, ‘বাসায় কেউ নাই। তুমি কুছতা খাইয়া আও। এই ফাঁকে আমি কাম সারি লাই।’

 

আনিস টাকা নিতে চায় না। আমিরুল জোর করে তার পকেটে টাকা গুঁজে দেয়। প্রচণ্ড ক্ষুধায় আনিস দিনের বেলা আসমানের তারা দেখে। সে তার পূর্ব পরিচিত এশিয়া রেস্টুরেন্টে যায়। দশ মাসের মধ্যে রেস্টুরেন্টটা বদলে গেছে। খাবারের স্বাদ আগের মতো নেই। তার ওপর দাম চড়া। সে শিক কাবাব আর নান রুটি খায়। খেয়ে দেখে পেট ভরেনি। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা টং দোকান থেকে ডিম কিনে খায়। সেদিন আনিস পরপর চারটা অথবা সাতটা ডিম খায়।

 

আমিরুল আনিসকে তার অফিসে নিয়ে যায়। আনিস খুব ক্লান্ত। বিষয়টা আনিসের ভালো ঠেকে না। আমিরুল তাকে বাসায় না-নিয়ে অফিসে গেল কেন? আনিস তেঁতুলতলায় যখন ছিল আমিরুলের ব্যবসায়িক অবস্থা ভালো ছিল না। এই কয়েক মাসে কি এমন হয়েছে, আমিরুল দশ তালা বিল্ডিং-এ অফিস নিয়েছে। সাইনবোর্ড দেখে বুঝা যায় সে হাউজিং-এর ব্যবসা করে। হাউজিং ব্যবসায় কি এতই লাভ যে মাত্র দশ মাসের ব্যবধানে এত পরিবর্তন! আনিস ঘুরে-ঘুরে অফিস দেখে আর অবাক হয়। আমিরুল আনিসকে কাছে ডেকে বলে, ‘তুমি হুকাইয়া গ্যাছ! খাও ন্যানি?’ আনিস বলে, ‘ইন্টারে ফেল মাইরা বউ মরার মতন শোক খাইছি আর কি খামু?’

 

আমিরুল বলে, ‘এবার পরীক্ষা দিলে পাস করি লাইবা।’ আমিরুল আনিসকে আরো কাছে যেতে বলে। এবং হঠাৎ করেই প্রথমে গালে তারপর ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট রাখে। আনিস জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আনিসের মনে হঠাৎ কুমারী মেয়ের সতীত্ব হারানোর ভয়। কই এর আগে তো আমিরুল তার সঙ্গে এ রকম করেনি। সে বুঝতে পারছে না কী করবে? তখন এশার আজান তরঙ্গায়িত হয়। আনিস বলে, ‘আমি নামাজ পড়ব।’ আমিরুল নামাজে সরাসরি বাধা না-দিয়ে বলে, ‘এত কষ্ট করে আইছ কাল থাকি পইড়।’ আনিস সায় দেয় না। তখন আমিরুল বলে, ‘ঠিক আছে নামাজ পড়ি জলদি আও। আমি অফিসে থাকমু।’

 

আনিস যেহেতু আটচল্লিশ মাইলের বেশি পাড়ি দিয়েছে সুতরাং সে মুসাফির। কাজেই তার নামাজ অর্ধেক। সেদিন অনিয়মিত নামাজি আনিস আল্লার কাছে দোয়া চায়- আমার আল্লা তুমি আমার মনের কথা জানো। আমার ওই দিকে বিন্দুমাত্র সায় নাই। তুমি আমাকে রক্ষা কর। আনিসের কেন জানি মনে হয়, তার এই দোয়া কবুল হবে। সে নামাজ শেষ করে আমিরুলের অফিসে যায়। আমিরুল কাজ শেষে তাকে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে। তারা রিকশায় ওঠে। কিন্তু মেইন রোড থেকে গলির মুখে ঢুকতেই তাদের রিকশার দু’পাশে দুটি মটর সাইকেল সমান্তরাল গতিতে তাদের সঙ্গী হয়। হঠাৎ মোটর আরোহীদের একজন চাপা গলায় ধমকের সুরে বলে, ‘ব্যাগ দে?’ আনিস মুঠোর মধ্যে ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রাখে। সেকেন্ডের দশমাংশ সময়ে ছিনতাইকারী তার ডানহাতে এবং ডানপায়ে ধাতব আঘাত করে। আনিস মাগো বলে চিৎকার করে ওঠে। ইলেক্ট্রিক শক খেলে যেমন লাগে আনিসের মস্তিষ্কে অনেকটা সেরকম অনুভূতি হয়। রিকশাটা একটু আলোতে গেলে সে দেখে, তার রক্তাক্ত হাত গলাকাটা মুরগির মতো দেখাচ্ছে। রক্তে তার জুতা চপচপ করে। আমিরুল তার হাত চেপে ধরে এবং দ্রুত রিকশাওয়ালাকে একটা ডিসপেনসারির সামনে দাঁড়াতে বরে।

 

আনিস কোনোমতে বলে, ‘ভাই সেভলন আছে?’ উত্তর আসে, ‘কী হইছে?’ আমিরুল ডান হাত সরিয়ে দেখাতেই লোকটা ভয় পায় এবং উচ্চারণ করে ‘মাংস দেখা যায় রগ কাটি গেছে। আমি কুচতা করতে পারতাম না।’ সে গজ দিয়ে আনিসের হাতটা বেঁধে দেয় এবং বলে, ‘আপনে জলদি ওসমানিত যাওক্কা।’ আনিসের ভেতরটা কেঁপে ওঠে− একবার সে হিন্দি ফিল্মে দেখেছে, এক দরিদ্র ছেলে তার মতো অবস্থা হলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন পুলিশ কেইসের আগে কোনো ডাক্তার চিকিৎসা করতে রাজি হয় না। এই ফাঁকে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে ছেলেটি মারা যায়।

 

আনিসের পরিণতি কোন দিকে যাচ্ছে? এ সময় আনিসের আপন হচ্ছে আমিরুল। সে যদি তাকে ফেলে চলে যায় তাহলে তার কী হবে? আমিরুল পরিচিত এক পুলিশ কন্সটেবলকে মুঠোফোনে বলে, ‘আমি ওসমানিত আইরাম তুমি জলদি আও।’ তারা হাসপাতালে যখন পৌঁছে তখন চারপাশ অন্ধকার। ডিসেম্বর মাস হওয়ায় প্রচণ্ড ঠান্ডা। জোনাকি পোকা ছড়িয়ে থাকে চার পাশে। হয়তো জোনাকিরা মৃতের ভাষা বুঝে। সঙ্গে একজন পুলিশ সদস্য থাকায় ভালই হয়। আনিসের পায়ে সেলাই দেয়া হয়। কিন্তু ডান হাতটা জলদি অপারেশন করতে হবে। তারা লিফট চড়ে দোতলায় অথবা তিন তলায় অর্থপেডিক বিভাগে যায়। সেখানে আগে থেকেই অনেক রোগী। কেউ অ্যাকসিডেন্ট করে, কেউ মারামারি করে ভর্তি হয়ে সব সিট দখল করে আছে। ডাক্তার অপারেশনের যাবতীয় ওষুধের নাম লিখে দেয় এবং বলে, সাড়ে চার হাজার টাকার মতো লাগবে। টাকার কথা শুনে আনিসের মুখ শুকিয়ে যায়। আমিরুল আনিসকে বলে, ‘তুমি থাক আমি আইরাম।’ আনিস বুঝতে পারে না আমিরুল কোথায় যাচ্ছে? তার ভয় হয়, সে যদি না আসে। আনিস অনেক দেন-দরবারের পর একটা সিট পায়।

 

আনিস কয়েক মিনিট পর অপারেশন থিয়েটারে যাবে। তার মা-বাবা এর কিছুই জানে না।  তার মা কি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে? একটা ট্রলিতে করে তাকে অপারেশনের টেবিলে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার আনিসের ঘাড়ে ইনজেকশন পুশ করে। তার শরীরের অর্ধেক অংশ অবশ হয়ে যায়। দু’জন শিক্ষানবিশ ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আনিসের হাতে অপারেশন শুরু হয়। ডাক্তারদ্বয় একটু পরপর প্রফেসরকে ফোন করে। কোনো পুরুষ শখ করে রান্না করতে গেলে যা হয়। একটু পর পর রাঁধুনীকে ফোন- দুই ডাক্তার অনেকটা তাই করছে। রান্নায় কাটাকাটি আছে অপারেশনেও আছে। অপারেশনও এক ধরনের রান্না। বদ্ধ ঘরে আনিসের সময় শঙ্কার ভেতর কাটতে থাকে। ডান হাতটা থাকবে নাকি থাকবে না সে বুঝতে পারছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ মাছ হয়ে যায়। সে দেখতে পায় তার সামনে একটা মেয়ে বসে আছে। এই মাঝরাতে লিপস্টিক ঠোঁটে মেয়েটি অপারেশন রুমে বসে আছে কেন? তার কি কোনো কাজ নেই? মেয়েটা কারো সঙ্গে কথা বলে না। এই রূপসী ডাক্তার যদি আনিসকে চুমু খায় তাহলে তো হাতটা এমনিতেই ভালো হয়ে যাবার কথা। আনিসের অনেক ভাবনার ভেতর তরুণী ডাক্তারটা গাছের মতো চুপচাপ বসে থাকে। শুধু একবার শিক্ষানবিশ দ্বিতীয় ডাক্তারের প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ‘তার হাজব্যান্ড ভালো আছে।’

 

আনিস তখন গাছ থেকে পাখি উড়ে যাবার শব্দ শুনতে পায়। আনিস বুঝতে পারছে না তার ওই ডাক্তারের দিকে আবার তাকানো উচিত হবে কিনা? ছিনতাইকারী আনিসের হাতের চারটা টেন্ডন কেটে দিয়েছে, টেন্ডন লজ্জাবতী পাতা। সংকুচিত টেন্ডন খুঁজতে আনিসের হাত আরো সাত ইঞ্চি কাঁটতে হয়। তার হাতের কাঁটাছেঁড়া চলার সময় আনিস প্রথম শিক্ষানবিশ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমি ডান হাত দিয়ে লেখতে পারব তো?’ ডাক্তার বলে, ‘আল্লা আল্লা করেন। হাত থাকে কিনা চিন্তা করেন।’ অপারেশন থিয়েটারে ডাক্তার রোগীকে এ রকম কথা বললে রোগীর আর কি বলার থাকে!

 

রাতে আনিস কখন ঘুমায় বলতে পারে না। সকালবেলা ঘুম ভাঙে কাচভাঙা জানালা গলে আসা ঠান্ডায়। গলায় তার হাত ঝুলছে। পাশের বেডের পা ভাঙা লোকটার পা ঝুলছে। লোকটা বিছানায় শুয়েই কাজ সারে। দুর্গন্ধে আনিসের বমির উদ্রেক হয়। সে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। বাম হাতে মুখ ধুয়ে নেয়। এবং কাজটি করতে গিয়ে অনুভব করে একটা হাতের জন্য সে কত অসহায়! এর মধ্যে বেডে নাস্তা চলে আসে। ২-৩ পিস পাউরুটি, ডিম, দুধ। হাসপাতালে এ রকম খাবার দেখে সে অভিভূত। আনিস যখন ডিমের খোসা ছাড়াচ্ছিল ঠিক তখন স্বজনের কান্না এবং রক্তাক্ত মাথা নিয়ে এক বৃদ্ধ আসে। কোনো রকম তার প্রাণে শ্বাস প্রবাহমান। সড়ক দুর্ঘটনা। প্রথম ১৫মিনিট বৃদ্ধ লোকটির পাশে কোনো ডাক্তার দেখা যায় না। যখন দেখা যায় ততক্ষণে ঘোষণা হয়ে যায়- আর ১৫ মিনিট আগে আসলে লোকটাকে বাঁচানো যেত। এ দৃশ্য দেখে আনিসের দুধ, ডিম বমিতে পরিণত হয়। সকাল ১১টার দিকে একজন মেডিকেলের ছাত্র আনিসের কাছে আসে। আনিসকে পরিচয় দেয়, সে এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আজ তাদের ওয়ার্ড ভিজিট। রোগীর কাছ থেকে হিস্টরি সংগ্রহ করবে। তাদের স্যার আসলে প্র্যাকটিকেল হবে।

 

আনিস পুনরায় তার ডান হাত গলায় ঝুলানোর বৃত্তান্ত বর্ণনা করে। আনিস ডাক্তারি পড়ুয়া ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘হাতের রগ কাটলে রগ কি জোড়া লাগে?’ ছেলেটি সায় দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, লাগে।’ ছয় ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন করলে ভালো। আনিস এ কথা শুনে দীর্ঘশ্বাসের ফানুস ওড়ায়। দশ মিনিটের মধ্যে এমবিবিএস পড়ুয়ার দল তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। ডাক্তার আনিসের ফাইল দেখে বলে, ‘ও আর কোনো দিন কিছু গ্রিপ করতে পারবে না।’ তারপর ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে, ‘কোন্ কোন্ টেন্ডন ছেঁড়ার জন্য পেশেন্ট গ্রিপ করতে পারে না?’ এ প্রশ্ন শুনে সবাই তাদের স্যারের কাছ থেকে মুখ লুকানোর চেষ্টা করে। কেউ বলতে পারে না। তারপর প্রফেসর উচ্চ কণ্ঠে বলে, ‘এই পেশেন্টের হিস্টরি সংগ্রহ করছে কে?’ আনিসকে অভয় দেয়া ছেলেটি বলে, ‘স্যার আমি।’ সে প্রশ্নের জবার দিতে না-পারায় প্রফেসরের হালুম সাইজের একটা ধমক তাকে সহ্য করতে হয়। তারপর প্রফেসর আনিসকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কিসে পড়?’ আনিস বলে, ‘ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।’ এ কথা শুনে দলের ৩-৪ তরুণীর চেহারার লাবণ্য সামান্য কুঁচকে যায়। তারা আনিসের জন্য মন খারাপের অভিনয় করে। তারা সিংহ হৃদয়ের নামতা মুখস্থ করলেও তারা মায়াবী।

 

মুহূর্তের মধ্যে আনিসের ভেতরটা অরণ্য হয়ে যায়। সে বনের ভেতর দ্রুত বেগে ছুটে চলে। ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নেয়। তারপর আবার ছুট দেয়। অরণ্য আর আগের মতো নেই। বনের যেখানে মানুষ গাছ পুড়িয়ে কয়লা বানায় সে সেখানে থামে। প্রাণের কয়লা-অতীত পড়তে চেষ্টা করে। গাছ মানেই পাখির কাছাকাছি থাকা। সে একটা গাছের খোলসের ভেতর ঢুকে। যদি কোনো সাপ তাকে ছোবল মারতে চায় মারতে পারে। যদি কোনো হিংস্র  পশু তাকে পেটের ভেতর নিতে চায়? তাহলে তা অবলীলায় করতে পারে। আনিস ঘুমিয়ে থাকলে তার বিছানাটা একটা পুকুর। শান্ত পুকুরে আমগাছের ডাল ভেঙে পড়লে সে জেগে ওঠে। তখন তার পুনরায় মনে হয়, ডান হাতটা থাকবে নাকি থাকবে না?

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ নভেম্বর ২০১৫/তারা

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়