ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

তাইওয়ানের সাতকাহন : ৬ষ্ঠ পর্ব

মাসুদুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৪, ২৪ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তাইওয়ানের সাতকাহন : ৬ষ্ঠ পর্ব

চিয়াং কাইশেক আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর

মাসুদুজ্জামান : চ্যানের ইমেইল পড়ে বুঝতে পারলাম, ওরা সবাই তাইওয়ানে আমাকে স্বাগত জানাবার জন্যে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু এই ইমেইল পাওয়ার পরও সারারাত আমার নির্ঘুম কাটল।

 

বার বার একটা কথাই মনে হচ্ছিল, তীরে এসে তরী কি ডুবেই যাবে? কেননা, ওদের ইমেইল আমি পেলেও, সেটা তাইওয়ানের ভিসাকেন্দ্রে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমাকে তো ভিসা দেবে না। এই উৎকণ্ঠা নিয়ে সকালে উঠেই ছুটলাম সাইবার ক্যাফেতে।

 

ইমেইল খুলে দেখতে চাইছিলাম ফের কোনো মেইল আছে কিনা। কিন্তু না, কোনো খবর নেই, নেই কোনো আশা জাগানিয়া সংবাদ। তবু আমি অফিস খোলার মুহূর্তেই ভিসাকেন্দ্রে পৌঁছে গেলাম।

 

সেদিন উড়াল ট্রেনে যেতে যেতে কিছুই আমার চোখে পড়ল না। একটাই ভাবনা, ভিসা হবে তো? না, কোনো সুসংবাদ তাদের কাছেও নেই। আবার মন খারাপ করে ফিরে এলাম হোটেলে। মনে মনে ঠিক করলাম আগামী দুদিনের মধ্যে যদি ভিসা না পাই, তাহলে আমি ঢাকায় ফিরে যাব। নিষিদ্ধ দেশে প্রবেশের আমার কোনো দরকার নাই।

 

পরদিন একই উৎকণ্ঠা নিয়ে সাত সকালেই হাজির হলাম ভিসাকেন্দ্রে। ওদের অফিস খুলতে না খুলতেই মুখোমুখি হলাম সেই কর্মকর্তার। যিনি প্রথম দিন আমার ভিসার আবেদন করা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। হংকংয়ের এই নাগরিকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই তার মুখে একটু স্মিত হাসি দেখলাম। আমার মধ্যেও তা আলোড়ন তুলল। তাহলে কী কোনো সুখবর আছে? প্রথমেই তিনি ডাকলেন আমাকে। বললেন প্রফেসর চ্যানের একটা মেইল তারা পেয়েছেন। এতে বলা হয়েছে আমাকে যেন ভিসা দেওয়া হয়, আমি সত্যি সত্যি সেখানে পড়াতে যাচ্ছি। কিন্তু...আবার কিন্তু কেন? আমার কপাল কুচকে উঠল। ভিসা কর্মকর্তা জানালেন ছাড়পত্র না পাওয়া পর্যন্ত তারা আমাকে ভিসা দিতে পারবেন না। আমি এবার অনেকটা অধৈর্য হয়ে পড়লাম। তর্ক জুড়ে দিলাম ওই অফিসারের সঙ্গে। কেন প্রফেসর চ্যান ইমেইল করার পরও আমাকে ভিসা দেওয়া হবে না?

 

এয়ারপোর্টের পাশের হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি

 

আমাদের তর্ক-বিতর্ক শুনে সমস্যাটা জানতে এগিয়ে এলেন ভিসাকেন্দ্রের প্রধান কর্মকর্তা। তিনিই আমাকে উদ্ধার করলেন। অধস্তন ওই কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিলেন আমাকে একমাসের টুরিস্ট ভিসা দিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি এবার চমকে উঠলাম, আবার টুরিস্ট ভিসা! তাইওয়ানে ভ্রমণ করবার জন্য আমি যাচ্ছি নাকি? এত টাকা-পয়সা খরচ করে ভ্রমণ করতে হলে তাইওয়ান যাব কেন, আরো কত দেশ আছে না!

 

মনের কথা মনেই চেপে রেখে ভাবলাম, ঠিক আছে, যে-করেই হোক আমি তাইওয়ানে যাবই। শেষ দেখে ছাড়ব, কোথায় গিয়ে শেষ হয় এই অভিযান। ভিসা তো একরকম পেয়ে গেলাম। আর কিছু না হোক একমাসের তাইওয়ান ভ্রমণ তো হবে।

 

ক্যাথে প্যাসিফিকের রিটার্ন টিকিট তো আগেই কাটা ছিল। শুধু তারিখটা সুনিশ্চিত করে পরদিন সকালেই উড়াল দিলাম তাইওয়ানে। তারপর তো বিমানের মধ্যে ওই বিড়ম্বনা। শিক্ষক বলে রক্ষা। সুন্দরী স্যুর কাছ থেকে তাইওয়ান সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া গেল। আমাদের বহন করা বিমানটি তাইপের রানওয়ে স্পর্শ করতেই সে তার হাসি উপহার দিয়ে তাইওয়ানে আামকে স্বাগত জানাল। অভিপ্রায় ব্যক্ত করল, একদিন সে আমার ভাবি কর্মস্থলে বেড়াতে আসবে। বন্ধুবর ফু আর প্রফেসর চ্যান তাদের ফোন নম্বর আগেই দিয়ে রেখেছিলেন। স্যুকে সে কথা জানিয়ে বললাম বিমান বন্দরে ফুই আমাকে নিতে আসবেন। তারই জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।

 

ততক্ষণে আমরা বিমান থেকে নেমে এসেছি। স্যুর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বিমান বন্দরের নামটির দিকে হঠাৎ আমার চোখ পড়ল- চিয়াং কাইশেক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট। সংক্ষেপে সিকেএস। সঙ্গে সঙ্গে আমার কাছ থেকে ফুর সেল নম্বর নিয়ে স্যু তাকে ফোন করল। ফুই তাকে জানালেন আমাকে নিতে চিয়াং কাইশেক বিমান বন্দরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছেন তিনি। অল্প্ক্ষণের মধ্যেই তিনি বিমান বন্দরে প্রবেশ করবেন। স্যুকে অনুসরণ করে আমি পৌঁছে গেলাম লাগেজ কর্নারে লাগেজ তুলতে। স্যুর সঙ্গে বড়ো কোনো লাগেজ ছিল না, তবু সে আমার জন্য বিমান বন্দর ছেড়ে গেল না।

 

এবার চারদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মনে হল আরেক ভিন্ন জগতে এসে পড়েছি আমি। হংকংয়ের মতো বিশাল নয়, জাঁকটাও কম। তবে ছিমছাম, নিরিবিলি এয়ারপোর্ট। যাত্রীদের মধ্যে তাড়াহুড়ো ভাব তেমন একটা নাই। তবে অসংখ্য বিদেশি যাত্রী চোখে পড়ল। তাদের অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ। তাইওয়ানি-শ্বেতাঙ্গ যুগলও চোখে পড়ল।

 

তাইওয়ানিরা আদিতে চীনা বংশোদ্ভূত বলে তাদের চোখ-মুখ-চুল শরীরের গঠন সবই চীনাদের মতো। খুব সহজেই তাই তাদের চেনা যায়। বিদেশিরা এদের চীনা বলে ভুল করতেই পারে। আমারও সিকেএস-এ নেমে সেকথাই মনে হল। তবে একটু পরেই আমার ভুল ভাঙল। বিমান বন্দরেই দেখলাম তাইওয়ানের একটা যাদুঘর আর অ্যান্টিকের দোকান।

 

আদিবাসীদের ঐতিহ্যকে তারা শুধু সংরক্ষণ করেই রাখেনি, বিদেশিদের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করেছে। তাইওয়ানিরা যে তাইওয়ানিই, চীনা নয়, এই বোধ তাদের খুবই টনটনে। স্যু আমাকে একথাই একবার বলেছিল বিমানের মধ্যে থাকতে।

 

এবার চাক্ষুস সেটা দেখতে পেলাম। জাদুঘরটা যখন আমি আর স্যু এভাবে ঘুরে ঘুরে দেখছি, তখনই বেজে উঠলো স্যুর সেলফোন। ওপারে ফুর কণ্ঠ। গাড়ি নিয়ে তিনি আমার জন্যে যাত্রী লাউঞ্জের একেবারে মুখটাতে অপেক্ষা করছেন। স্যু আমাকে পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিল প্রফেসর ফুর কাছে। তারপরই তার বিদায়।

 

ইতিমধ্যে আমি স্যুর ব্যবহারে সত্যি মুগ্ধ। তাকে কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষাও আমার নাই। তবে আমি সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছি প্রফেসর ফু চুনের ব্যবহারে। তার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা এক বিদেশি  আমি, বাংলাদেশের মানুষ। একটা সেমিনারের সূত্র ধরে ইন্টারনেট আর দু-একবার ফোনে আলাপ-পরিচয়-কথপোকথন। কিন্তু তিনি আমাকে যেভাবে সাহায্য করছেন, কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও নিকট আত্মীয়ও এমনটা করেন না।

 

স্যুর মাধ্যমেই ফুর গাড়িটা খুঁজে পাওয়া গেল। আমাকে দেখেই বুঝতে পারলেন আমিই সেই বাংলাদেশি যে নতুন এক অভিজ্ঞতার সন্ধানে তাইওয়ানে এসেছি। ফু দেখতে খুবই সাধারণ কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত দীর্ঘকায় এক পুরুষ। মুখে তার স্মিত হাসি। চীনারা যেমন দেখতে হয়, ফু তেমনটা নন। তার চেহারায় ভারতীয়-চীনা আদলের একটা সংমিশ্রণ আছে। কাছাকাছি আসতেই, “গুড মর্নিং, আই আম ফু চুন” বলে করমর্দনের জন্যে আমার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন।

 

বললেন, “চলুন গাড়িতে যেতে যেতে কথা বলি। আপনাকে আবার চুংলিতে পৌঁছে দিতে হবে। এর মধ্যে তো আবার লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে।” আমি কিছুটা অবাক হলাম লাঞ্চের কথা শুনে। ইতিমধ্যে তাইওয়ানের সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মাত্র বারোটা বাজে, অর্থাৎ দ্বিপ্রহর। মাথার ওপর সূর্য।

 

‘জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর, এই তিন মাস তাইওয়ানের গ্রীষ্মকাল। জুলাইতে এর তীব্রতা চরমে ওঠে। সমস্ত স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটি হয়ে যায়। এরপর টানা প্রায় দুইমাস পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলে। এই সময়েই শুরু হয় নতুন শিক্ষাবর্ষ।  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খুলবে এই সময়। অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে। আপনিও এই নতুন শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেবেন ‘

 

ফুর কথা শুনতে শুনতে আমার মনে পড়ে গেল প্রফেসর চ্যান এমন একটা কথাই আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু এই বারোটার সময় লাঞ্চ করতে হবে কেন? কথাটা জিজ্ঞেস করতেই ফু জানালেন তাইওয়ানে দুপুর বারোটা থেকে দেড়টার মধ্যে সবার লাঞ্চ সারা হয়ে যায়। এর পর কোনো রেস্তোরাঁই খোলা থাকে না। কোথাও কোনো খাবার পাওয়া যাবে না।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জুন ২০১৬/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়