ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ফ্যাশনের বিবর্তন || গুলসান নাসরীন চৌধুরী

গুলসান নাসরীন চৌধুরী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ২৭ জুন ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফ্যাশনের বিবর্তন || গুলসান নাসরীন চৌধুরী

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

ফ্যাশন বলতে আমি যেটা বুঝি তাহলো, আমি যে জিনিসটা পরব সেটা দেখে আমার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা তৈরি হবে। যেমন কেউ যদি ডাক্তার হন অথবা যে পেশাতেই থাকুক না কেন পোশাকের মধ্যে যেন সেটি ফুটে ওঠে। আমি যে জিনিসটা পরব সেটি পরে যদি আমি স্বস্তিবোধ করি তাহলে সেটিই ফ্যাশন। এ ছাড়া আবহাওয়ার ওপরও ফ্যাশন নির্ভর করে। গরম, শীত এবং বর্ষাকালের সঙ্গে মিল রেখে আমরা যে পোশাক পরব, সেটিই ফ্যাশন।

বাংলাদেশের সূচনার আগে আমরা পূর্ব পাকিস্তান ছিলাম। সে সময়টাতে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের আগে আমরা একটা ধারায় চলছিলাম। যেমন ভারতের ফ্যাশন ছিল এক  রকম। অন্যদিকে পাকিস্তানের ফ্যাশন ছিল আরেক রকম। তারা ট্রিপিক্যাল সালোয়ার কামিজ পরত। বম্বেতে সালোয়ার কামিজ পরত। কলকাতায় ছিল শাড়ি কিন্তু সেই শাড়িতে তারা স্লিভলেস ব্লাউজ পরত বা সিনথেটিক শাড়ি পরত। সেখানে এগুলোই ছিল ফ্যাশন কিন্তু আমাদের দেশে এ ফ্যাশনগুলো ছিল না। আমাদের দেশে ফ্যাশন বলতে তখন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের পোশাকই ছিল ফ্যাশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা ঢোলা টাইপের পাজামা এবং তার ওপরে হাফ শার্ট পরত। পোশাকগুলোর বেশির ভাগেই কলকাতার অনুকরণ করা হতো। কলকাতার উত্তমকুমার ও সৌমিত্র চ্যাটার্জির পোশাকের সঙ্গে ম্যাচ করে আমাদের দেশের ছেলেরা ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০ সালের দিকে কাপড় পরত।

তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে কিন্তু ছিল আলাদা। তারা শাড়ি পরত কিন্তু কলকাতার মেয়েরা যেমন স্লিভলেস পরত বাংলাদেশের মেয়েরা কিন্তু তা পরত না। তখন তারা ব্লাউজে থ্রি কোয়ার্টার বা নরমাল স্লিভ পরত। আর শাড়ির ক্ষেত্রে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত তারা সুতি শাড়ি পরত। বিয়ের পরে মেয়েদের শাড়িগুলো হয়তো একটু কাতান, সিল্ক এই পর্যন্ত ছিল। এখন আমরা যেমন পাতলা শাড়ি বা সিনথেটিক পরি তখন কিন্তু এগুলো ছিল না। তবে সেই সময় কলকাতা এবং করাচিতে সিনথেটিক শাড়ির প্রচলন ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের মেয়েরা সেগুলো তখনো গ্রহণ করেনি। সে সময় মেয়েরা ফ্রক পরত, এরপর অল্প কিছুদিন সালোয়ার কামিজ এবং কলেজে ওঠামাত্রই শাড়িতে চলে যেত।

 

এরপর আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ শুরু হয়। শরণার্থী হিসেবে আমাদের যারা  ভারতে ছিল, ওই সময়টাতে তাদের কালচারের সঙ্গে আমাদের আদান প্রদান শুরু হয়। তখন আমাদের পোশাকে কিছুটা পরিবর্তন হয়। তখনও আমাদের দেশের ছেলেরা পাকিস্তানের নায়ক যেমন নাদিম কিংবা ওয়াহেদ মুরাদ তাদের ফ্যাশন অনুকরণ করেনি বা বম্বের নায়কদের পোশাকও অনুকরণ করেনি। তখন ছেলেরা কলকাতার নায়কদের পোশাক পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে হঠাৎ কেমন যেন পরিবর্তন হতে শুরু করে। মেয়েরা সাধারণভাবেই শাড়ি পরত কিন্তু শাড়ির নকশাতে বিভিন্ন পরিবর্তন হতে শুরু করে। ইন্ডিয়া থেকে বিভিন্ন শাড়ি আসা শুরু হয় এবং আমাদের মা-খালারা সেটিই পরতে শুরু করেন। এভাবেই পরিবর্তনের শুরু।

এই শুরুর মধ্যে ধামাকা দিল নায়করাজ রাজ্জাকের সিনেমা রংবাজ। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে আমাদের ছেলেদের পোশাকে একটা বিশাল পরিবর্তন আসে। রাজ্জাক বম্বের নায়কদের মতো পোশাক পরা শুরু করল। খুব সম্ভবত কবরীও স্লিভলেস পরল। এ ছাড়া গানগুলোতে পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। সেই সঙ্গে পোশাকেও। সবকিছুই একটা যোগসূত্র রয়েছে। গানের সঙ্গেও কিন্তু ফ্যাশনের যোগসূত্র রয়েছে। যেমন মেলোডি গানে একরকম পোশাক আবার রক গানের অন্য রকম। এই সিনেমার মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাকে পরিবর্তন লক্ষ করা গেল। ছেলেরা প্রিন্টেড শার্ট পরা শুরু করল। ভেলবটম প্যান্ট পরতে লাগল। প্যান্ট একটু উঁচু করে পরা শুরু করল। শার্টের কলার বড় হয়ে গেল। মেয়েরা তখন সিনথেটিক শাড়ি পরা শুরু করল। ফ্যাশনেবল মেয়েরা স্লিভলেস পরা শুরু করল। এরপর ১৯৭৩ সালের দিকে যখন বাংলাদেশি সামরিক বাহিনির কর্মকর্তারা, যারা পাকিস্তানে কর্মরত ছিলেন, তারা দেশে ফিরতে শুরু করলেন। তারা রাতারাতি আসায় পাকিস্তানে তারা  যেসব পোশাক পরতেন, দেশে ফিরে সেগুলোই পরতেন। কারণ, তাদের নতুন পোশাক তৈরির জন্য সময়ের প্রয়োজন ছিল। সে সময় পর্যন্ত তারা ওই পোশাকগুলোই পরতেন।

 

 

সে সময় তাদের দেখে আমাদের দেশের ছেলেরা কাবলি পোশাকের এবং মেয়েরা সালোয়ার কামিজ, শর্ট কামিজ এবং ভেলবটম সালোয়ার, এখন যেটাকে পালাজ্জো বলা হচ্ছে, তা পরার প্রচলন শুরু হলো। সে সময় আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, তাই পাকিস্তানিদের পোশাক পরা যাবে না, তেমন কিন্তু ছিল না। উল্টো তাদের এই পোশাকই ফ্যাশনে পরিণত হলো। কিন্তু আমাদের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ না খাওয়ায় এটির আবেদন আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। আর এটিই হলো ফ্যাশন। আপনি চাইলেই অনেক কিছু আনতে পারেন কিন্তু যতক্ষণ না সেটি আরামদায়ক হবে, যতক্ষণ না সেটি সাধ্যের মধ্যে না হবে, ততক্ষণ সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। পাকিস্তানি পোশাকে কাপড়ের পরিমাণ বেশি লাগত তাই খরচটা তুলনামূলক বেশি হওয়ায় সেটি গ্রহণযোগ্যতা হারাতে শুরু করে। ১৯৭৬ সালের দিকে কামিজের ঝুল আবার লম্বা হওয়া শুরু হলো। আমরা মানুষ, তাই আমাদের মধ্যে পরিবর্তনটা আপনাআপনিই চলে আসে, একই ধরনের পোশাক আমরা বেশি দিন পছন্দ করি না। আগে যেখানে পাকিস্তান ও ভারত ছিল। স্বাধীনতার পর সেখানে তিনটি দেশে পরিণত হয়। এবং এখনকার মতো না হলেও এই দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ হতে শুরু হলো এবং বিভিন্ন ম্যাগাজিন এবং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষ এই সব দেশের পোশাক অনুকরণ করতে শুরু করে। তবে পাকিস্তানের পোশাকের প্রতি আগে থেকেই আমাদের তেমন কোনো ঝোঁক ছিল না। আমাদের ঝোঁকটা ভারতীয় পোশাকের প্রতি বরাবরই বেশি। তাই ভারতীয় কালচারের পোশাক পরা শুরু করলাম। এভাবেই প্রায় ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত চলে। তখনো আমরা আমাদের নিজস্ব কোনো স্টাইল তৈরি করতে পারিনি।

 

১৯৮৫ সালের পর থেকে আমরা চিন্তা করলাম আমাদের নিজস্ব কিছু ফ্যাশন হওয়া প্রয়োজন। যেমন বাঙালি নারীদের ক্ষেত্রে শাড়ি। আর আমাদের নারীদের দৈহিক গড়নের ক্ষেত্রে শাড়িটাই বেশি মানায়। কিন্তু কী শাড়ি পরব, এটা প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তখন গরম এলে আমরা সুতি পরা শুরু করি। দেখা গেল সুতির মধ্যে অ্যামব্রয়ডারি। তারপর হয়তো অ্যাপলিক পরা শুরু করলাম। এরপর যখন বর্ষাকাল, তখন হয়তো সিল্ক পরতে শুরু করলাম অথবা সিনথেটিক পরতে শুরু করলাম। তবে সিনথেটিকগুলো আমরা আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে মিল রেখে তৈরি করলাম। ইদানীং বাংলাদেশে সিনথেটিক শাড়ি তৈরি হচ্ছে। এগুলোতেই আমরা অ্যাপলিক, কাঁথা ফোঁড়ের পাড় অথবা লেজ এগুলো বসিয়ে আমরা ফ্যাশন শুরু করলাম। এ ছাড়া বারো মাসে তেরো পার্বণ বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে। উৎসবের কারণে আমাদের ফ্যাশনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে।

 

মাঝে মেয়েদের ফ্যাশনে যোগ হয়েছিল ব্যাগি ড্রেস। যেটি ছিল অনেকটা ব্যাগের মতো। কিন্তু এতে মোটা মেয়েদের আরো মোটা দেখাতে শুরু করল। ফলে সেটি আস্তে আস্তে আবেদন হারাতে শুরু করল। এটিই আমাদের বুঝতে হবে। যেটি আমাদের মানিয়ে চলবে সেটিই আমাদের বেছে নিতে হবে। যেমন -ট্রেডিশনাল শাড়ি- কাতান, জামদানি, মসলিন, বেনারসি কিন্তু থাকবেই। এক সময় ছিল জর্জেটের মধ্যে অ্যামব্রয়ডারি করা। পরে ওটি হারিয়ে গেল। পরে সেটি আবার আসে কিন্তু কিছুটা পরিবর্তন হয়ে। তখন দেখা গেল সফট জর্জেটের মধ্যে অ্যামব্রয়ডারি করা। এটিই হলো ফ্যাশন। একই জিনিস, হয়তো কিছুটা পরিবর্তন হয়ে আবার ফিরে আসবে। এ ছাড়া ওয়েস্ট্রান কালচারটাও আমাদের পোশাকের ফ্যাশনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে যারা ‘এ’ লেভেল ‘ও’ লেভেল পড়ে তারা ওয়েস্ট্রান কালচারটাকেই বেছে নেই। তারা মনে করে পড়ালেখা শেষ করে তাদের গন্তব্য পশ্চিমা কোনো দেশেই হবে। তাই শুরু থেকেই তারা এ ধরনের পোশাকে অভ্যস্ত হয়। তাদের দেখাদেখি হয়তো তাদের আশপাশের অনেকেই এ ধরনের পোশাক পরা শুরু করে। এ ছাড়া স্যাটেলাইটের যুগে বিভিন্ন চ্যানেলে বা ইন্টারনেটে পোশাক  দেখে সেই ফ্যাশনগুলো নিজেদের মধ্যে মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়। এভাবেই মূলত আমাদের দেশের ফ্যাশন পরিবর্তন হয়ে আসছে।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ জুন ২০১৬/মারুফ/এএন   

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়