ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বৃষ্টির বাগড়ায় ভেস্তে গেল সিপ্পি আরসুং অভিযান

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৯, ১৬ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বৃষ্টির বাগড়ায় ভেস্তে গেল সিপ্পি আরসুং অভিযান

মেঘের মাঝে উল্লাস

ফেরদৌস জামান : গত বছর সেপ্টেম্বরে পাহাড় থেকে ফেরার পথে আশ্রয় নেই রুমা উপজেলার বাকত্লাই পাড়ায়। পাড়ায় প্রবেশের পর দূর থেকে চোখে পড়ে আদ্যপান্ত সাদা ধবধবে পোশাক পরে মাচাতে পা ঝুলিয়ে বসে আছেন দুই ভদ্রলোক। একজনের চোখে আবার সানগ্লাস। গহীন পাহাড়ে কড়কড়ে ইস্ত্রি করা এমন সৌখিন পোশাক পরা মানুষ দেখে একটু বিস্মিত হলাম। কাছাকাছি গিয়ে মনে হলো আমাদের মতো একই উদ্দেশ্যে হয়তো তারাও এসেছেন। অভিযান সম্পন্ন হওয়ার পর দু’একদিন হয়তো রিল্যাক্স সময় কাটাচ্ছেন। তখনকার মতো শুধু কুশল বিনিময় হলো। রাতে খাওয়ার সময় দেখি আমরা একই বাড়ির অতিথি। তারপর যা হয়, আলাপ পরিচয় এবং দু’চার কথা।

জানতে পারলাম আমার মতো তারাও মিরপুরের বাসিন্দা। আক্ষরিক অর্থে মির্জা রাসেলের সাথে পরিচয় সেখানে হলেও প্রকৃতপক্ষে সে পরিচয় আরও আগের। পাহাড়ে পরিচয়ের সেই সূত্র ধরে প্রথম দেখা হয় এ বছর জানুয়ারিতে, বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড অভিযানে যাওয়ার ব্যাপারে আলাপ করতে গিয়ে। চূড়ান্ত উদ্যোগ গ্রহণের পর তা ভেস্তে গেলেও রাসেল ভাইয়ের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা সাক্ষাতের ব্যাপারটা চালু থাকল এবং সখ্য গড়ে উঠল। এরই ধারাবাহিকতায় গ্রহণ করা হলো পাহাড়-পর্বতে ঘুরতে যাওয়ার একাধিক পরিকল্পনা। যাই হোক, কয়েক মাস আগে কথাপ্রসঙ্গে চলে আসে বান্দরবান রেমাক্রি খালের উৎসের কথা। সেই উৎস স্থলে যাওয়ায় আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা শুনতে শুনতে তিনি যেন একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন। তখনকার মতো ঐ পর্যন্তই। বাসায় ফিরে রাতে ফোন করে বললেন, রেমাক্রি খালের উৎস নিয়ে একটি লেখার কথা মনে পড়ছে, যার সাথে আপনার কথার বা বর্ণনার হুবহু মিল খুঁজে পাচ্ছি, অনলাইন পোর্টাল রাইজিংবিডি ডটকম-এ বছর দুই আগে প্রকাশিত হয়েছিল। আরও জানান, লেখাটি পড়ে উৎসাহিত হয়ে এরই মধ্যে তিনি জায়গাটি ঘুরেও এসেছেন।

প্রশ্ন করলেন, আমি কোথাও লিখি কি না? বললাম হ্যাঁ এবং তা রাইজিংবিডিতেই। এই ছিল তার সাথে আমার আক্ষরিক পরিচয়েরও আগের পরিচয়। আমরা গ্রহণ করেছি পাহাড়ে যাওয়ার দুইটি বৃহৎ পরিকল্পনা, যার বাস্তবায়ন ঘটবে যথাক্রমে আগামী নভেম্বর ও পরের বছর জানুয়ারিতে। এ জন্য অপেক্ষায় আছি। কিন্তু দিন ফুরাচ্ছে না। এই মূহুর্তে তিনি কোথাও যেতে চান। তবে অবশ্যই পাহাড়ে। ইচ্ছা আমারও ছিল কিন্তু পকেটের স্বাস্থ্য তেমন ভালো ছিল না। এমন করে লোভ ধরিয়ে দিলেন যে, আর বসে থাকা গেল না। তারই প্রস্তাব ও উদ্যোগে তল্পিতল্পা নিয়ে একদিন বেরিয়ে পরলাম। বগুড়া থেকে যোগ দিল আরেক সহযাত্রী রোকনুজ্জামান সোহাগ। অভিযানটি ছিল প্রধানত দেশের প্রথম দশ শৃঙ্গের অন্যতম সিপ্পি আরসুং জয়।

সামুদ্রিক নিম্নচাপের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হচ্ছে। সারা রাতের বাস জার্নির পর ভোরে নামলাম বান্দরবান। সূর্যের প্রথম আলোতেই জেগে উঠল পাহাড় প্রাচীরে ঘেরা শহরটা। একটি রিকশা কেবল টুং টুং শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে। সাটার তুলে খাবারের দেকানগুলো খোলা হচ্ছে মাত্র। মফস্বলী নেড়ি কুকুরের দল হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে আমার হাতে ঝোলা পাউরুটির ব্যাগ। ওদিকে মাথার উপর ঝরছে টিপ টিপ বৃষ্টি। রুমা হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও বৃষ্টির কারণে গন্তব্যের পথে পরিবর্তন আনতে হলো। পাহাড়ি মেঠো পথ, বৃষ্টিতে গাড়ি চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায়। রুমা থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব পর্যন্ত মাল টানা চান্দের গাড়িগুলো যাতায়াত করে। বুঝিয়ে বলতে পারলে দু’তিন জনকে অনায়াসে নিতে পারে। আপাতত সে চিন্তা পরিত্যাগ করে সন্ধান করতে হলো বিকল্প পথের। একটা রিকশা করে সাঙ্গু সেতু পেরিয়ে রুয়াংছড়ি যাওয়ার বাসস্ট্যান্ডে যেতেই ডাকাডাকি শুরু হলো যেন- এইমাত্র ছেড়ে দেবে, ওঠেন, ওঠেন ইত্যাদি।

 

বিপদজনক পথে নিচের দিকে নেমে যাওয়া

 

এই পাহাড় টপকাতে পারলে পথের চার ভাগের এক ভাগ শেষ হলো বলে ধরে নেয়া হয়। পাহাড়ের ঠিক মাথার উপর একটি জুম ঘর। দুজন মানুষ একাগ্র মনে আদা রোপণ করছে। ঘরটায় বসে একটু বিশ্রাম নিতে চাইলে কৃষক দম্পতি মিষ্টি হেসে বসতে দিলেন। বাঁশের ঝাপনি তুলে মাটির ছোট্ট গর্ত থেকে একটি পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিয়ে বললেন, নিন খান। পানি ঠান্ডা রাখার অত্যান্ত সহজ অথচ চমৎকার একটি পন্থা। এরপর ঝুরি থেকে পাকা কলা বের করে দিলেন। এমন পরিস্থিতিতে পেট ভরে পানি পান করার পর কলা যে কতটা উপাদেয় ছিল তা বুঝতে পারি পরবর্তী পথে। তিন কি চারটি পাহাড় টপকে সন্ধ্যার আগে গিয়ে পৌঁছি নৃ-গোষ্ঠী বমদের রনিনপাড়ায়। পার্বত্য বান্দরবানের গহীন পাহাড়ে কোনো পাড়া বা বসতি সবচেয়ে বড় তা বলা আসলে মুশকিল। প্রথম দিকে জানতাম বাকত্লাইপাড়া, তারপর জানলাম সুংসংপাড়া। সর্বশেষ এইবার জানলাম রনিনপাড়া।

সমৃদ্ধ একটি বসতি। প্রবেশ পথটি এগিয়েছে কবরস্থানের মাঝ দিয়ে। পুরনো বৃক্ষের তলে বহু এপিটাফ। নতুন কবরগুলো বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সাধারণত প্রতি পাড়ায় একজন করে কারবারী (পাড়া প্রধান) থাকে কিন্তু এই পাড়ায় রয়েছে চারজন। পাড়ার আয়তনের সাথে সাথে বেড়েছে কারবারীর সংখ্যা। আমরা থাকার জায়গা করে নিলাম পাড়ার সর্বোচ্চ ও শেষ অংশের কারবারী লালথান লেন বম-এর ঘরে। পাহাড়ের জীবন মানেই সংগ্রামের, প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিস সংগ্রহের জন্য করতে হয় নিদারুণ কষ্ট। তার মাঝে একটি হলো পানি। পানি সংগ্রহের জন্য তাদের তিন-চারশ ফুট বা তারও বেশি নিচে নামতে হয়। তাই বৃষ্টির পানি নানাভাবে সংগ্রহ করে রাখে তারা। ঘরে প্রবেশের আগেই চোখে পড়ল ছোট, বড় নানা আকারের পাত্রে পানি ধরে রাখা হয়েছে। চার সন্তানের জনক কারবারী লালথান। প্রতিটি সন্তানই পড়াশোনা করে। বড় ছেলে উচ্চ মাধ্যমিকে আর সবচেয়ে ছোট মেয়েটি ৪র্থ শ্রেণীতে। প্রত্যেকেই আবাসিকে থেকে পড়াশোনা করে, কেউ খুলনা তো কেউ গাজীপুর। গ্রীষ্মের ছুটিতে সকলেই বাড়ি এসেছে।

 

 


সেদিন রাতের পর চলে এলো আর একটি দিন কিন্তু বৃষ্টি ছাড়ার নাম নেই। সারাটা দিন কারবারীর পরিবারের সাথেই কেটে গেল। কথা হলো পাহাড়-পর্বতের নানা অভিজ্ঞতার ব্যাপারে। তারা ভেবেই পায় না আমরা সমতলের শহুরেরা পাহাড়ের কি সৌন্দর্যটা দেখতে আসি। তাদের মতে এসব নিছক বিলাসিতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তার পরের দিনও বৃষ্টি সাথে ঝড়ো বাতাস। সকলের মন্তব্য চার-পাঁচ দিনে এই বৃষ্টি থামবে না। উপায় না দেখে এমন আবহাওয়ার মাঝেই সিপ্পি আরসুং আরোহণের ঝুকিটা নিতে চাইলাম। বিপত্তি বাঁধল গাইড নিয়ে, পাড়া থেকে কাউকে রাজি করানো গেল না। সকলের কথা বৃষ্টিতে ট্রেইল বিপজ্জনক হয়ে আছে, তাছাড়া জোঁকের উপদ্রব বেড়ে গেছে বহুগুণ। প্রত্যেকের একই পরামর্শ, দু’চার দিন অপেক্ষা করি। এত কষ্ট করে যখন এসেছি তখন অপেক্ষা করা কোনো বিষয় নয়, তবে সহযাত্রীদের অফিস তো আর সে কথা মানবে না। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ফিরতি পথে। অন্তত ফেলে আসা দু’একটা পাড়ায় দুটো দিন থেকে তাদের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করা যেতে পারে। প্রতিনিয়ত পাহাড়ের সাথে সংগ্রাম করে টিকে থাকা মানুষগুলো বোঝে পাহাড়ে পথ চলা কতটা কষ্টকর?

ঢাকা থেকে দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে লক্ষের কাছাকাছি থেকে ফিরে যেতে হচ্ছে। বিষয়টি ভেবে অনুশোচনায় সকলের মুখ মলিন হয়ে গেল। বিষয়টি এমন যেন বৃষ্টি নয়, তাদের কারণেই আমরা সফল হতে পারলাম না।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জুলাই ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ