ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

যে কারণে ওরা পাহাড়ের চূড়ায় থাকে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যে কারণে ওরা পাহাড়ের চূড়ায় থাকে

ফেরদৌস জামান : রোদের তীব্রতা থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই থাইক্ষ্যাং পাড়ায় উপস্থিত হয়ে যাই। বম জাতীর বসতি, কারবারী  হাম নং বম সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন তার বাড়িতে। সাজানো গোছানো বসতি, ঝরনা থেকে পাইপ দিয়ে পানির সরবরাহ করা হয়েছে। ঝরঝরে একটা গোসলের পর বসল গল্পের আসর- সাথে এক গ্লাস করে রং চা। ওদিকে রাতের খাবার প্রস্তুত হচ্ছ্। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ খাবার ঘর থেকে ডাক আসে। মারফা (শসা জাতীয় এক ধরনের পাহাড়ি প্রজাতীর সবজি)’র শুকনো ছালের তরকারীর সাথে ঝিরি থেকে সংগ্রহ করা ছোট ছোট শামুকের একটি পদ। প্রত্যেকের সামনে বাটিতে রাখা শামুক।

 

দু’এক গ্রাস ভাতের পর একটা করে শামুকের মাংস খাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ছিল একেবারেই নতুন। সজারুর কাঁটার চোখা মাথার হালকা খোঁচাতেই বেরিয়ে আসে নরম তুলতুলে মাংস।

 

সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়, সূর্য ইতিমধ্যেই দাঁত বের করে তার কটকটে রোদ ছড়ানো শুরু করে দিয়েছে। জঙ্গলের পর পরিত্যাক্ত জুম ক্ষেত। ক্ষেতের ঘাসগুলি কখনও কখনও এক মানুষ পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। তার মাঝ দিয়েই ট্রেইল। রোদের মধ্যে এমন পথে ট্রেকিং করা কষ্টসাধ্য। ঘাসের খড়খড়ে ধারালো ডগার আঁচড়ে হাত পায়ের অবস্থা নাকাল। গরমও প্রচুর। তাই আগে খানিকটা জিরিয়ে নিলাম। এমন পরিবেশে ধীর কদমে কাছে আসে তিন-চারটি কিশোর, তাদের হাতে গাছের ছালের দড়িতে ঝুলানো এক ধরনের পোকা। দা দিয়ে খুঁড়ে সেগুলি ধরতেই তারা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। লবণ, মরিচ দিয়ে রান্না করে খেতে নাকি ভীষণ মজা। বৃত্তান্ত শোনার পর পোকার ছরি হাতে তাদের কয়েকটা ছবি তোলায় তারা অনেক খুশি। সেই খুশিতে অবশ্য মজে থাকার উপায় নেই। কারণ বেশি দেরি করলে সূর্য মাথার ওপর চলে আসবে। তাতে এই পথে হাটা অধিক কষ্টকর হয়ে উঠবে।

 

 

পাড়ায় গিয়ে মেলে এক দল শিকারীর সাক্ষাত। এক সপ্তাহের অধিক হয় তারা বনের গভীরে ঘুরে ঘুরে শিকারে ব্যস্ত। নিকটে কোন মিলিটারি ক্যাম্প না থাকলেও পাড়ার মাথার ওপর একটি হেলিপ্যাড রয়েছে। মসৃণ ঘাসের সমতলে হেলিপ্যাড শিকারী দলের সাথে চললো রাত দশটা পর্যন্ত এক লম্বা আড্ডা। তারপর তাদেরই সাথে খাওয়াদাওয়া। পরের দিন সকালে তারা চললো তাদের উদ্দেশ্যে আর আমরা ‘লুং ফ্যার ভা’র পথে। আমাদের এই পর্বের পথপ্রদর্শক আগের দিন মারফা দিয়ে আপ্যায়নকারী জুম চাষী দাদা। অত্যান্ত সাদাসিধে মানুষ। জুম চাষ এবং শিকার, এটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ তার জীবনের গল্প। জীবনের শেষাবধি পরিবারের সদস্যদের মুখে দুটো খাবারের যোগান দিয়ে যাওয়ার প্রত্যাশাই তার একমাত্র স্বপ্ন। তারা ভেবেই পায় না, আমরা শহর বা সমতলের মানুষেরা কি দেখতে পাহাড়-পর্বতে যাই?

 

খামাখা এই পরিশ্রমের কোনো অর্থ তারা খুঁজে পায় না। যখন বলা হয় পাহাড় কত সুন্দর! যে সুন্দরের টানেই বারবার ছুটে আসি। প্রতি উত্তরে নিজেদের চলতি ঢঙে তারা বলে- না, পাহাড় ভালো না যে, শুধু কষ্ট! সাথে আরও বলে, সমতলে চলাফেরা সহজ, গাড়িঘোড়া কত কি আছে! খাওয়ার জন্য এত কষ্ট করে চাল উৎপাদন করতে হয় না। এই সমস্ত গল্প করতে করতে সামনে পড়ে একটি জুম ঘর। ঘরটায় ব্যাগ রেখে জুমের মাঝ দিয়ে ত্রিশ মিনিট নিচে নেমে শুনতে পাই দূর থেকে ভেসে আসা ঝরনার ছর ছর শব্দ। অন্ধকার, তারওপর চারপাশ নিস্তব্ধ, গাছপালা ঢাকা হিম শীতল জায়গা, জনমানুষের চিহ্নটি নেই। ঝরনার শব্দের সাথে কেবল মিশে যাচ্ছে দূর থেকে ডাকা  দু’একটা অপরিচিত পাখির কিচিরমিচির শব্দ। অভিযাত্রীদের নজরে ‘লুং ফ্যার ভা’ এখনও সেভাবে আসেনি। এলেও সকলের পক্ষে যে সেখানে যাওয়া সম্ভব হবে তা বলা যায় না। কারণ পথ অনেক কঠিন এবং কষ্টকর। সুন্দর একটি ঝরনা তবে বর্ষায় বা ঠিক তার পর পর না যেতে পারার দরুণ প্রকৃত সৌন্দর্য থেকে অনেকটাই বঞ্চিত হয়েছি। সুতরাং আগেই বলে রাখছি, যারা যাবেন তারা বর্ষাতেই যাবেন।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়