নাকফুলওয়ালাদের গ্রাম
টিপু || রাইজিংবিডি.কম
নিজের তৈরি নাকফুলে সজ্জিত গৃহবধূ
আশরাফুল আলম লিটন
মানিকগঞ্জ, ১৯ জানুয়ারী : খলিলাবাদ নাকফুলওয়ালাদের গ্রাম। দুধবিক্রেতা দুধওয়ালা এবং মাছবিক্রেতা মাছওয়ালা হলে নাকফুলবিক্রেতা অবশ্যই নাকফুলওয়ালা। সেই নাকফুলওয়ালাদেরই গ্রাম মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার খলিলাবাদ।
এ গ্রামের দুই শতাধিক পরিবার ৬০ বছর ধরে জড়িত এই কাজে । এসব পরিবার নিজেদের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের সাথে সাথে জাতীয় অর্থনীতিতেও রাখছে বিশেষ ভূমিকা।
নাকফুল বাঙালি নারীর রূপসজ্জার অন্যতম অলংকার। নাকফুল নিয়ে রয়েছে নানা গল্প-কাহিনী, গান আর কবিতা। যা কম-বেশি সবার মনেই ভালোলাগার দোলা দিয়ে যায়। ছোট্ট এই অলংকারটি হঠাৎ করেই বদলে দেয় নারীর রূপ। নারীর মুখচ্ছবিও এর জাদুকরী স্পর্শে হয়ে ওঠে মোহনীয়, দর্শনীয়।
সেই নাকফুল জীবনমানেও প্রভাব ফেলেছে খলিলাবাদ গ্রামে। যেখানে কয়েক শ’ নারী-পুরুষ জীবিকা নির্বাহ করছেন নাকফুলের ব্যবসা করে।
নাকফুল তৈরির প্রথম শুরুটা করেছিলেন স্থানীয় সম্ভু মল্লিক (৮০)। তিনি জানান,তার বয়স তখন ১৯ কী ২০। শারীরিক দুর্বলতার কারণে তিনি চাষাবাদে অভ্যস্ত হতে পারেননি। তাদের গ্রামে সে সময় কয়েক ঘর স্বর্ণকার বাস করতেন। স্বর্ণালংকারের পাশাপাশি তাঁরা ইমিটেশনের নাকফুল, কানফুল তৈরি করতেন। তবে সেটা ছিল খুবই সীমিত।
এ সময় তাদের কাছে বসে তিনি সময় কাটাতেন। পাশাপাশি তিনি স্বর্ণকারদের কাজে টুকটাক সাহায্যও করতেন। আর এ সাহায্য করতে গিয়েই তিনি কিছু কাজ শিখে ফেলেন। পরে বয়সী এক স্বর্ণকারের পরামর্শে তিনি শুরু করেন ইমিটেশনের নাকফুল বানানো। ক্রমে তার কাজের পরিধি বাড়তে থাকে।
স্বাধীনতার আগে-পরে গ্রামের স্বর্ণকারদের বেশির ভাগই দেশ ছেড়ে চলে গেলে কাজটি তিনি পুরোদমে শুরু করেন। তার দেখাদেখি তখন গ্রামের আরো কয়েকজন এই ব্যবসা শুরু করেন। বর্তমানে এ গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের ৫/৬ শত নারী পুরুষ এই কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন বলে জানান তিনি ।
নাকফুল তৈরির কথা জানালেন কারিগর আব্দুল আজিজ। তিনি জানান, তাদের তৈরি নাকফুলের মূল উপাদান পিতল। আর এ পিতলে পলিশ করে সোনালি রং করা হয়।
একটি নাকফুলের চারটি অংশ। একটি অংশ তারা। ওই তারার ওপরে বসানো হয় রঙিন পাথর। তারপর সরু একটা নল ঝালাই দিয়ে তারার সঙ্গে আটকে দেওয়া হয়। এ নলকে বলা হয় চুঙ্গি। নাকে পরার পর যেন খুলে না যায়, সে জন্য অন্য একটি তার ঢোকানো হয় ওই চুঙ্গির ভেতরে। এরপর তারের নিচের অংশে গোল একটি চাকতি ঝালাই করে জোড়া দেওয়া হয়। এ চাকতির জন্য চুঙ্গি থেকে তারটি বেরিয়ে আসতে পারে না। তার ও চাকতি মিলে যে অংশ তৈরি হয় তাকে বলা হয় তলসা। মূলত তলসার কারণেই নাকফুলটি খুলে না গিয়ে নাকেই সেঁটে থাকে।
সুবাস চন্দ্র সাহা জানান, এক কেজি পিতলের দাম প্রকারভেদে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। এক কেজি পিতলে তৈরি হয় ১২ হাজার পিস নাকফুল। পিতল ও পাথরের দাম এবং তারা, চুঙ্গি, তলসা, মজুরি ও ঝালাই বাবদ খরচ হয় ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা।
পাইকাররা এগুলো কিনে নিয়ে যায় ২০০ থেকে ২৫০ টাকা হাজার দরে। তাতে প্রতি হাজারে তাদের দেড় দুই হাজার টাকা লাভ থাকে। এক কেজি পিতলের নাকফুল তৈরি করতে দুই তিনদিন সময় লাগে।
কলেজ ছাত্রী শাহানাজ জানান, পড়াশোনার পাশাপাশি নাক ফুল তৈরিতে বাবা মাকে সহযোগিতা করি। তাতে দুই তিনশ টাকা আয় হয়। যা দিয়ে নিজের হাত খরচ চলে যায়।
তবে ব্যবসায়ীরা জানান, দিনে দিনে পিতলসহ অন্যান্য উপকরণের দাম বাড়ছে। সেই সঙ্গে মেশিনে তৈরি বিদেশি নাকফুলও এখন পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে তাদের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। তবে গ্রামগঞ্জে এখনো তাদের নাকফুলের বেশ কদর আছে।
সরকারী বেসরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেলে নাকফুল তৈরির কাজ আরোও সম্প্রসারিত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাইজিংবিডি / টিপু
রাইজিংবিডি.কম