ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

হাজার টাকায় শুরু করে পাঁচ মাসে লাখপতি সিথী

হাসান সিকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৪, ৮ জুন ২০২১   আপডেট: ১৮:৫২, ৮ জুন ২০২১
হাজার টাকায় শুরু করে পাঁচ মাসে লাখপতি সিথী

ফেরদৌসী ইসলাম সিথী। টাঙ্গাইল পৌর শহরের বেড়াডোমা এলাকার জহিরুল ইসলামের মেয়ে। বাবা-মায়ের তিন সন্তানের মধ্যে সিথী দ্বিতীয়। ইচ্ছাশক্তি, বুদ্ধি, মেধা, শ্রম, সততা, নিপুণ হাতের কৌশলে প্রমাণ করেছেন, মেয়েদের পক্ষে সব সম্ভব। সফলতা মেয়ে-ছেলে দেখে আসে না, আসে মেধা ও পরিশ্রম দেখে।  

ইতোমধ্যে বিয়ে করে সংসার পেতেছেন তিনি। কিন্তু দমে যেতে দেননি স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্নকে। ২০২০ সালের ১ জুন মহামারি করোনার মধ্যেই শুরু করেন ব্যবসা। তার প্রতিষ্ঠানের নাম ‘ইচ্ছে রঙিন’। ছেলে বন্ধুর (বর্তমানে স্বামী) কাছ থেকে নেওয়া মাত্র ১০০০ টাকাই ছিল ব্যবসার মূলধন। কঠোর পরিশ্রমে মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় হয়েছেন লাখপতি। এখন তার হ্যান্ড পেইন্টের শাড়ি বিক্রি করে মাসে আয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। 

ফেরদৌসী ইসলাম সিথী বলেন, স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। প্রথমে ভাবতাম, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না। যেখানে যা-ই করেছি, কোনোদিন সফল হতে পারিনি। অনার্স শেষ করে যখন বাসায় বসে থাকতাম, দম বন্ধ হয়ে আসতো। খুব বেশি হতাশ ছিলাম নিজেকে নিয়ে। হতাশার রাতগুলো ছিল আমার কাছে অনেক কষ্টের। বিবিএতে পড়াশোনা করার সুবাদে ব্যবসার প্রতি একটু ঝোঁক ছিল। তবে, আত্মবিশ্বাস ছিল না। কারণ ভাবতাম, ব্যবসা করতে অনেক বুদ্ধি লাগে, যা আমার নেই। হঠাৎ করোনা এসে পৃথিবীকে নিস্তব্ধ করে দিলো, সঙ্গে আমিও হতাশায় পড়ে গেলাম। বেড়ে গেল চিন্তা- মাস্টার্স কবে শেষ করব, কবে একটা চাকরি করব। 

হঠাৎ একদিন আমার বড় বোন উইতে (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম) আমাকে যুক্ত করেন। তখন শুধু মাথায় ঘুরত কিসের ব্যবসা করব, আমি তো কিছুই পারি না। আঁকাআঁকিটা যে আমি ভালো পারতাম, সেটা আমি নিজেও জানতাম না। আসলে সেভাবে কখনো আঁকাআঁকি করাই হয়নি। যখন স্কুল-কলেজে পড়তাম, তখন খাতার কোনায় কিছু না কিছু আঁকতাম। এই আঁকানো থেকেই আমার মাথায় আসে, আমি আঁকাআঁকি নিয়েই কিছু করব। তখনও আমি হ্যান্ডপেইন্ট সম্পর্কে কিছু জানতাম না। শাড়ি কাপড়ে কিভাবে আঁকে কিছুই জানি না। 

আমার বড় বোনের কথামতো একটি শাড়ি আর রঙ কিনে আঁকা শুরু করেছিলাম। এখনও সেভাবেই আঁকা চলছে। উদ্যোক্তা জীবনটা আমার কাছে অনেক মজার আর স্বাধীন মনে হয়। এজন্যই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, এমন কিছু করব, যেখানে আমি আমার মতো করে সবকিছু করতে পারব। এই জন্যই মূলত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হওয়া। 

প্রথম যখন উইতে যুক্ত হই, তখন শুধু একটাই ভাবনা ছিল, আমার কাজটা সবার মনে জায়গা করতে হবে। এজন্য আমি প্রচুর কষ্ট করেছি। আপনারা জানেন, হ্যান্ডপেইন্টের কাজ যত নিখুঁত হয়, তার ততই কদর বেশি। আমার প্রথম থেকেই অনেক অর্ডার আসত। কারণ, আমার কাজ সবাই অনেক পছন্দ করত, ভালোবাসত। সারাদিন কাজ করতাম, আবার সারারাত জেগেও কাজ করতাম। অনেক কষ্ট করতাম, এখনও করি। আমি এটা সব সময় মানি, পরিশ্রম করলেই সফলতা আসবে। কথার সাথে কাজে মিল রাখতাম সব সময়। মানের দিকে খেয়াল রাখতাম। তাই, লাখপতির খাতায় নামটা লিখতে পেড়েছি। পাঁচ মাসে লাখপতি হয়ে গেলাম। বর্তমানে আমার মাসে আয় ৩০-৩৫ হাজার টাকা। পুরো ব্যবসাটাই অনলাইনে। অফলাইনে সেল নেই। তবে এখন আস্তে আস্তে সবাই জানছে। 

আমার শুরুটা একটু কঠিন ছিল। কারণ, পরিবারের কেউ ব্যবসা করেনি কখনো। আমার বাবা সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। সেই সুবাদে আমরাও চাকরিটাকেই পছন্দের তালিকায় রাখি। তবে, আমার পরিবার যে ব্যবসা অপছন্দ করে, তা কিন্তু নয়। তবে, আমি পারব কি না, সেটা নিয়ে সবার চিন্তা ছিল। যখন প্রথম ব্যবসার জন্য বিনিয়োগ করি, সেই টাকা ছিল আমার প্রিয় মানুষ স্বামীর (তৎকালীন ছেলে বন্ধু) কাছ থেকে নেওয়া। অবশ্য আজ থেকে ১১ মাস আগে আমাদের বিয়ে হয়নি। ভালোবাসতাম একে-অপরকে। সেই সময়েই তিনি আমার পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। 

প্রথমে ১০ হাজার টাকা দিতে চান। আমি বলেছিলাম, এত টাকা না, অল্প টাকা আগে নেই, দেখি শুরুটা কেমন হয়। তখন আমি ৩ হাজার টাকা তার কাছ থেকে চেয়ে নেই। সেই টাকা থেকে মাত্র ১ হাজার টাকা নিয়ে মূলত ব্যবসাটা শুরু করি। একটা প্রাইড শাড়ি আর রঙ-তুলি কিনে শুরু করি উদ্যোক্তা জীবন। এরপর যখন আমার অনেক অর্ডার আসা শুরু হয়, তখন আমাকে টাকা দিয়েছেন আমার মা ও বড় বোন। মা সব সময় আমার পাশে ছিলেন। আসলে আমার পরিবারের প্রতিটি মানুষ আমার পাশে আছেন। আমার ব্যবসার পেছনে সব থেকে বেশি যে প্রভাবটা ছিল, তা হচ্ছে পরিবারের সবার সাহস। 

সবাই আমাকে অনেক সাহস দিয়েছেন। উইতে পোস্ট করার পর পজিটিভ কমেন্টগুলো আমাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে। সাথে ভয়গুলো কেটে গেছে। তখন থেকে ব্যবসার প্রতি আমার মনোযোগ আরও বেড়ে গেল। প্রথম আমি উইয়ের কথা বলব। কারণ, উই ছাড়া আজকের আমি বানানো সম্ভব ছিল না। উইয়ের জন্য নিজের প্রতিভাটা নিজের ভেতর থেকে বের করে আনতে পেরেছি। আমিও যে কিছু করতে পারব, তা শুধুই উইয়ের অবদান। তাছাড়া, পরিবারের সবাই আমার পাশে থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। 

আমি প্রচুর পরিশ্রম করি। কারণ, স্বপ্ন দেখি একদিন মিলিয়নিয়ার হবো। বাবা-মায়ের শুধু তিনটি মেয়ে বলে যেন তাদের কখনো কষ্ট পেতে না হয়। তাই নিজেকে স্বাবলম্বী করে সারাজীবন তাদের পাশে থাকতে চাই। আমার হাতে আঁকা পণ্য দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে যাবে। যদিও বর্তমানে কয়েকটি দেশে আমার পণ্য গেছে। আমি চাই, ইচ্ছে রঙিন একটি ব্র্যান্ড হবে। এক নামে সবাই চিনবে। 

আমার বাবা সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। অনেকের কাছেই আমার বাবা-মাকে শুনতে হয়েছে, ছেলে হয়নি? মেয়ে দিয়ে আর কি ভবিষ্যত হয়? আজ সে ধারণা আমি বদলে দিয়েছি। আমি মেয়ে হয়েও ব্যবসা করে লাখ লাখ টাকা আয় করছি। বাবা-মায়ের ছেলে নেই তাতে কি, আমরা আছি তো। আমার সব সময়ের সাপোর্টার আমার বড় বোন। সেই প্রথম থেকে আমার পাশে আছে। আর একজনের কথা না বললেই নয়, সে আমার একসময়ের বয়ফ্রেন্ড, এখন স্বামী। যে কিনা আমার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। পণ্য আনা থেকে পারসেল দেওয়া- সবকিছুতেই তার সাহায্য আমি পাই। 

আমি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে ব্যবসা নিয়েই আছি। মাস্টার্স করার ইচ্ছা আছে। টাঙ্গাইল বিন্দুবাসিনী গার্লস স্কুল থেকে এসএসসি, সরকারি কুমুদিনী কলেজ থেকে এইচএসসি, টাঙ্গাইল হাজী আবুল হোসেন ইনস্টিটিউট থেকে অনার্স শেষ করি। বর্তমানে সিগনেচার পণ্য ও হ্যান্ডপেইন্টের সব ধরনের পণ্য নিয়ে কাজ করছি। সঙ্গে আছে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত পণ্য।

লেখক: শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী।

টাঙ্গাইল/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়