ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

জলবায়ু পরিবর্তন, ঝুঁকিতে শিশুরা

ইয়াসমিন আক্তার, ঢাকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১১:০৫, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
জলবায়ু পরিবর্তন, ঝুঁকিতে শিশুরা

কল্যাণপুরের একটি খাবার হোটেলে কাজ করে নাহিদ। ছবি: রাইজিংবিডি

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার একটি সরকারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাহিদ। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পরিবারের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার কল্যাণপুরের একটি বস্তিতে ওঠে। নাহিদের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন সে কল্যাণপুরের একটি খাবার হোটেলে কাজ করছিলো।

নাহিদ বলে, ‘এখানে ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করা লাগে। মাসে ৩ হাজার টাকা দেয়। ’ স্কুলে যেতে চাও কি না-জানতে চাইলে নাহিদ বলে, ‘কাজ কইরাই কূল পাওয়া যায় না। স্কুলে যামু কোন সময়?’ নাহিদ বলে, ‘আমরা বাধ্য হইয়া ঢাকায় আইছি। নদীতে আমাগো ঘর-বাড়ি সব ভাইঙ্গা নিয়া গেছে। বস্তিতে আমার মা, বাবা আর ছোট বোন আছে।’ 

নাহিদের মতো অনেক শিক্ষার্থী স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বন্যা হয়। পাশাপাশি ঝড়, জ্বলোচ্ছ্বাস বাড়ছে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। বন্যায় অনেক পরিবার বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। তাদের সঙ্গে শিশুরাও উদ্বাস্তু হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে শিশুদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

বন্যায় শিশুরা পানিতে ডুবে যাওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে, যা ইতিমধ্যেই দেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বন্যার সময় শিশুরা তাদের পরিবারের সঙ্গে জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেয়। স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পরীক্ষা বাতিল করা হয়। এই পরিস্থিতিতে শিশুদের পড়াশোনায় আরও বিঘ্ন ঘটছে।

নোয়াখালীর আন্ডারচরে একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো তাহমিনা আক্তার। ২ বছর আগে বন্যায় মেঘনা নদীতে বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ার পর এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয় তাহমিনার পরিবার। পরিবারে ৬ সদস্য। তাহমিনার বাবা তাহমিনাকে বিয়ে দিয়ে দেন ২০২২ সালে। তখন তাহমিনার বয়স ছিলো ১৪ বছর।  বিয়ের ১ বছর পর স্বামীর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার কল্যাণপুরের এক বস্তিতে ওঠে সে। কয়েক মাস আগে একটি মেয়ে সস্তানের জন্ম দেয় তাহমিনা। তাহমিনার কাছে জানতে চাই-স্কুল কেমন ছিলো? তাহমিনা কিছুক্ষণ চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘স্কুলে খুব মজা হইতো, ক্লাস আমার ভালো লাগতো। আমি ভাবছিলাম পড়ালেখা শিখখা বড় হইয়া আমি ডাক্তার হবো।’ 

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার শিশু মনিরুল ঢাকার মিরপুরের একটি ছোট সবজি বাজারে সবজি বিক্রি করে। মনিরুলের বাবা সকালে আড়ৎ থেকে সবজি কিনে দিয়ে রিকশা চালাতে চলে যান।  মনিরুল সারাদিন বাজারে বসে সেসব সবজি বিক্রি করে। তিন বছর আগে বন্যায় বাড়ি ডুবে গেলে মনিরুলরা ঢাকায় আসে। আগে নিজেদের এলাকায় একটি প্রাথমিক স্কুলে পড়তো, পরে ঢাকায় এসে পরিবারের সঙ্গে কাজে যোগ দেয় সে।

পথে খাবার বিক্রি করছে নজরুল মিয়া। ছবি: রাইজিংবিডি 

মনিরুল জানায়, বাবা রিকশা চালায় আর মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে। তার এক বোন এখনো ছোট। মা কখনো তাকে সঙ্গে নিয়ে কাজে যায় আর কখনো মনিরুলের সঙ্গে বাজারে রেখেই কাজে যায়। আবার স্কুলে যেতে চায় কি না? এমন প্রশ্নে মনিরুল বলে, ‘সেইটা আর হইবো না। পরিবারের অনেক খরচ। আব্বা-মা আমারে স্কুলে দিতে চায় না।’ 

গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার একটি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নজরুল মিয়া। পানিতে ঘর ডুবে যাওয়ায় গত বছরের জুন মাসে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার মিরপুরের একটি বস্তিতে ওঠে। নজরুলের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন সে ফেরি করে আমড়া, পেয়ারা বিক্রি করছিলো। নজরুলের বাবা বাদাম বিক্রেতা, মা বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে। নজরুলের আরও ৩ ভাই বোন আছে।

নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে দুর্যোগ, বিশেষত ঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশ শিশু। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগে এসব শিশুর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

ইউনিসেফের তথ্য বলছে, শহরের বস্তিতে থাকা বেশির ভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় না। আর দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ আরও কম। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় ১৭ লাখ শিশু নিষিদ্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। তাদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের বয়স ১১ বছর কিংবা তারও কম। অনেক মেয়েশিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে।

ঢাকা ও আশপাশের বস্তিতে বসবাস করা বেশির ভাগ শিশু ট্যানারি, লঞ্চ ইয়ার্ড, দরজির দোকান, অটোমোবাইল কারখানায় কাজ করে। অনেকে ফল ও সবজির বাজারে মাল টানা এবং বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট কিংবা রেলস্টেশনে কুলির কাজ করে। তাদের বেশির ভাগ দুর্যোগপ্রবণ বিভিন্ন জেলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় এসেছে।

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শফি আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশে জলবায়ু পরিবর্তন অনেক বড় ক্ষতি। গত চার-পাঁচ বছরে পদ্মা, যমুনা, ধরলাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর ভাঙনে উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ৩০০ স্কুল নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এতে করে শিশুরা পরিবারের সঙ্গে শহরাঞ্চলসহ বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে।  এমনিতেই পরিবারগুলো দরিদ্র তার ওপর তাদের পারিবারিক আয় কমে যাচ্ছে। নতুন জায়গায় গিয়ে অন্য স্কুলে ভর্তির সুযোগ থাকে না। অনেক সময় শিশুদের লেখাপড়ার সুযোগ থাকলেও তাদের ইচ্ছে থাকে না।  শিশুরা পুনরায় শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরে যেতে পারে না। এতে তারা পিছিয়ে পড়ছে। বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।  অভাব-অনটনে বাবা-মা তাদের সন্তানদের কাজ করাতে বাধ্য করছেন।

তাহমিনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলছেন প্রতিবেদক ইয়াসমিন আক্তার। ছবি: রাইজিংবিডি 

বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে শিশুরা নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে এসব শিশুদেরকে মাদক পাচারের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।  সামগ্রিক বৈষম্যের শিকার হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হতাশাগ্রস্ত হয়ে বড় হচ্ছে।  যেসব শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় যাচ্ছে সেসব শিশুর জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে অন্য স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে সেইসঙ্গে তাদের জন্য আগে থেকেই বাড়তি বই রাখতে হবে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের ক্লাইমেট চেঞ্জ প্রোগ্রামের প্রধান আবু সাদাত মনিরুজ্জামান খান বলেন, শিশুরা যে জায়গায় বেড়ে ওঠে সে জায়গার সঙ্গে একটা সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।  জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শিশুরা যখন বেড়ে ওঠা জায়গা থেকে পরিবারের সঙ্গে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হয়, তখন নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে তাদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। গ্রামে যে শিশুরা স্কুলে পড়তো, শহরে বস্তিতে গিয়ে তার পক্ষে নতুন করে পড়ালেখা করার সুযোগ থাকে না। পানিতে লবণক্তাতা বেড়ে যাওয়ার কারণে সুপেয় পানির অভাবে তাদের শারিরীক বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। এছাড়া স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা যেমন ডায়রিয়া, চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগ হয়।

তিনি আরও বলেন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো শিশুদের পুষ্টি রক্ষা ও শিক্ষা নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া সরকারের শিক্ষা ও পুষ্টি নিয়ে বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে তবে তা চাহিদার তুলনায় কম। 

/এসবি/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়