ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সুবোধ তুই পালিয়ে যা... 

শ্রীমন্ত বসু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪১, ১৪ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৭:২৫, ১৪ জানুয়ারি ২০২১
সুবোধ তুই পালিয়ে যা... 

টোকন ঠাকুর নির্মিত ‘কাঁটা’ চলচ্চিত্রের দৃশ্য

‘কাঁটা’ ছবিতে ১৯৭১ সালের একটি চরিত্র সুবোধ; সুবোধচন্দ্র দাস। যে কিনা বউকে নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় এসে ভূতের গলিতে বসবাস করছিল। তার বউয়ের নাম স্বপ্না রানী দাস। সুবোধ ঢাকায় সিনেমা হলে টিকেট বিক্রেতার চাকরি করত। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস আগেই তারা ঢাকায় এসেছিল। এবং চলমান যুদ্ধের মধ্যে সেই দম্পতি একদিন আজিজ ব্যাপারির বাড়ির উঠানের কুয়োর মধ্যে পড়ে মারা যায়। সুবোধ এমন একটা চরিত্র যে কিনা ভীত, পলায়নপর, অসহায় এবং যাকে দেখে যে কারোরই একবাক্যে মনে হবে- লোকটা বোকা। ঠিক এরকম একটা চরিত্রের সন্ধান চলছিল কাঁটা ছবির জন্য। কিন্তু এই সময় বোকা লোক পাওয়া কি এত সহজ? বিশেষ করে থিয়েটার, টেলিভিশন কিংবা সিনেমা করিয়েদের ভিড়ে বোকার জায়গা কোথায়? আমাকে প্রথম নির্বাচন করা হয়েছিল একটি ঢুলি চরিত্রের জন্য। তখন সুবোধ হিসেবে যাকে নিয়ে ভাবা হচ্ছিল, পরিচালকের ভাষ্যমতে, সে বেশি চালাক। আমিও কম চালাক না। বোকা লোকের চরিত্রে অভিনয় দেখিয়ে সুবোধ চরিত্রটি পেয়ে গেলাম।

চলচ্চিত্র দেখার অভিজ্ঞতা ও স্বপ্নের মধ্যে পার্থক্য আছে। সমাজদেহে ব্যক্তিসত্তা সুবোধ বা ব্যক্তিমননের মধ্যে রয়েছে যে সুবোধ তার সন্ধান করি সুবোধ চরিত্রে অভিনয়ের তাগিদে। মনের মধ্যে নিত্য যে সুবোধ লালিত পালিত হয় স্বপ্নের মধ্যে বাস করে অবচেতনে, সে হয়তো ঘুম পাড়ে। সমাজে সুবোধরা আজ থেকেও যেন নেই, খুব ম্রিয়মান তার উপস্থিতি। কেন? চরিত্রায়ণ প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে থাকি। দেয়ালচিত্রে গ্রাফিতি দেখি, ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, সময় এখন পক্ষে না।’ দেখি, একজন ভাঙাচুড়া মানুষ খাঁচা খুলে বেরিয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু চাইলেই সে তা পারবে কি? সুবোধ সমাজের বহমান বাস্তবতায় টিকে থাকার পথ না পেয়ে মারা পড়ছে কিংবা পালানোর পথ খুঁজছে। নিজের সঙ্গে নিজের এমন বোঝাপড়া চলছে  ভেতরে-বাইরে এই পরিস্থিতিতে। ‘কাঁটা’ সিনেমায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সুবোধের সঙ্গে থাকবে তার বউ স্বপ্না। এই পরিস্থিতিতে, মগবাজার ‘কাঁটা’ ক্যাম্প বা নারিন্দার শ্যুটিং বাড়ি পর্যন্ত বোঝাপড়া চলছে ডিরেক্টরের সঙ্গে। চলছে নিবিড় পর্যবেক্ষণ। স্ক্রিপ্টে বর্ণিত সুবোধের কথাবলার ঢঙ কেমন, দেহ ভঙ্গিমা, আকার, ওজন, আর্থিক সামর্থ্য, শিক্ষাদীক্ষা, মনগড়ন, পরিবারের মোট সদস্য, কেনইবা বারবার উদ্বাস্তু হতে হয় ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলেছেন ছবির পরিচালক টোকন ঠাকুর।

এরকম বহুমাত্রিক সুবোধ কাজ করে কাঁটা সিনেমায় গল্প-চিত্রনাট্য লেখার গুণে। ‘কাঁটা’র চিত্রনাট্য পড়েই মোহ বেড়ে যায়। ইচ্ছে জন্মে আবার পড়বার। বারবার জেনে নেবার আগ্রহ জন্মায় ঘটনার ঘনঘটা। সুবোধ এমন একটি কাঙ্ক্ষিত চরিত্র, যে চরিত্রে অভিনয় করতে পারার স্বপ্ন থাকে যেকোনো অভিনেতার জীবনে। তেমনই আমার জীবনে সুবোধ চরিত্র করার সুযোগ এলো। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! ঠিক একইমাত্রায় বা তার চেয়ে কঠিন হয়ে উঠল চরিত্র নির্মাণের সময়টা। এজন্য নাওয়া খাওয়া ঘুম উধাও হয়ে গেল।

আমার ওজন ছিল ৭৬ কেজি। পরিচালক বললেন, ‘গ্রামের মুচির ছেলে ঢাকায় সিনেমাহলে টিকিট বিক্রির চাকরি করে, কয় টাকাই বা আর বেতন পায়? সুবোধের ওজন ৬৫ কেজির হতে হবে।’ তারপর শুরু হলো আমার উপর নাৎসি নির্যাতন। প্রথমেই যা করা হলো, আমার খাবারের উপর সেন্সর আরোপ করা হলো। যা খেতাম আগে তা তিনভাগের একভাগ করা হলো। হরিজন সম্প্রদায়ের একজন মানুষ হিসেবে তৈরি করার জন্য মাটিতে খাবার দেওয়া হতো এবং অনেক সময় সামনে থেকে ভাতের থালা সরিয়েও নেওয়া হতো। এখানেই শেষ নয়, হাতে দুরমুজ ধরিয়ে ৫০ ফিটের একটি রাস্তা সমান করার কাজ দিলেন নির্মাতা, সঙ্গে ইট ভাঙা তো আছেই। ‘কাঁটা’র অন্যান্য টিম মেম্বারদের সহযোগিতা সমেত টানা ৩৬ দিনে নির্মিত সেই রাস্তা ‘কাঁটা’ ছবিতেই দর্শক দেখতে পাবে। সিটি কর্পোরেশনের লোক নিয়ে আসা হয়েছে, কিন্তু বালতি বালতি গু পরিষ্কার করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ, পরিচালক বললেন, ‘হতে পারে সুবোধ মেথর বাড়ির ছেলে।’ যা আমি কোনোদিন কল্পনাও করিনি। চোখ নাক মুখ বেঁধে আমাকে পিঠমোড়া করে বেঁধে শ্যুটিং বাড়ির উঠোনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়েছে। ডিরেক্টর বললেন, ‘মনে করো কাল সকালবেলা ১৪ ডিসেম্বর, তোমাকে পাওয়া যাবে রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে।’

ডিরেক্টর তার চরিত্রের প্রয়োজনে যা যা বলতেন অভিনেতার পাশাপাশি আমি নিজে একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর; এই আমাকে অন্যান্য অ্যাসিস্ট্যান্টরা নির্মমভাবে বেঁধে ফেলত। মনে হয় বাড়াবাড়ি করত। এমনকি এক অ্যাসিস্ট্যান্ট আমাকে মেরে রক্তাক্ত করে ফেলল। ডিরেক্টরের কাছে বিচার গেলে তিনি বললেন, ‘এ তো আমি চাইনি।’ আমি রীতিমত অসুস্থ হয়ে গেলাম। মিডফোর্ড হাসপাতালে ভর্তিও হলাম কিন্তু সুবোধ চরিত্রে অভিনয় করার নেশায় নিজেই ফিরে এলাম ‘কাঁটা’ ক্যাম্পে। তার দুয়েকদিন বাদেই আমি ‘কাঁটা’ ক্যাম্প থেকে পালিয়ে যাই। ভাবলাম দুই কোটির লোকের শহরে আমাকে আর খুঁজে পায় কে? কিন্তু আমার কী দুর্ভাগ্য ‘কাঁটা’র স্ক্রিপ্ট সুপারভাইজার কাম অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর তুরা পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমাকে ধরে ফেলল।

আমার বোনের কবিতার বইটি ‘কাঁটা’ ক্যাম্পে ছিল। সেখানে ওর ফেসবুক প্রোফাইল লিংক ছিল। সেই লিংক ধরে আমার বোন চামেলী বসুর সঙ্গে যোগাযোগ করে। এবং আমি ধরা খাই, আমার নাম সুবোধচন্দ্র দাস, আমার ভাইয়ের নাম পরাণ। ভালো কথা বলে ক্যাম্পে ধরে এনে আবার সেই সুবোধচন্দ্র অনুশীলন কেন্দ্রের ছাত্র, মুক্তি নেই, সুবোধের মুক্তি হয় না।  সময়েই আমার চেহারার গদাই লস্করি নাদুসনুদুস ভাব কেটে যেতে থাকে এবং আমার মধ্যে এক রুক্ষ শ্রমিকের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে। ব্যক্তিগতভাবে এ আমার কাম্য ছিল না কিন্তু সুবোধ চরিত্রের প্রয়োজনে অন্তত তিনমাস এ ধরনের ৩৬টি ট্রিটমেন্ট আমার উপর করা হয়েছে। আমার ক্যারিয়ারে সুবোধ চরিত্রের গুরুত্ব কতখানি এটা যারা বুঝতে পারতেন না, তারা আমাকে স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সতর্ক করতেন বারেবারে। যদিও তারা ছিলেন আমারই সুহৃদ। আমার নির্মাতার প্রতি আস্থা ছিল। সেই আস্থা নিয়ে একদিন খুব গোপনে, ক্যাম্পের সবার চোখ এড়িয়ে ডিরেক্টরের কাছে গিয়ে প্রায় আধাঘণ্টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। ডিরেক্টর বললেন, ‘কী চাও?’ আমি হাউমাউ করে কেঁদে তার কাছে জানতে চাই, ‘আপনি আসলে আমার কাছে কী চান?’ তিনি নির্বিকারভাবে বললেন, ‘সুবোধ, একটি চরিত্র চাই।’
কষ্ট ছাড়া কি কেষ্ট মেলে!

সুবোধ চরিত্রে নতুন নতুন মুখ স্বপ্নার সঙ্গে মহড়া করে, আমি দেখি। স্ক্রিপ্ট পড়ি বারবার এবং প্রতিযোগিতায় নামি সুবোধ চরিত্র ধরে রাখার প্রশ্নে। ডিরেক্টর মনে মনে ধরে নিয়েছেন হয়ত আমি পারব, সেটা টিমের সদস্যরাও আন্দাজ করেছে অনেকেই। ‘কাঁটা’ ছবিতে সুবোধ চরিত্র চারটি। এই চরিত্রে অভিনয় করতে পারার অভিজ্ঞতা চার সুবোধের চার রকম। পরিচালক যেমন চেয়েছেন। যেমন সুবোধ অনিমেষ আইচ ‘কাঁটা’ ক্যাম্পে এলে তার জন্য চা সিঙারা পুরি এনে পরিবেশন করার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। ছোট সুবোধ সোহেল তৌফিক এলে তাকে খাটের ওপর বিছানা করে দিয়ে মেঝেতে ঘুমাতে হতো আমাকে। কারণ কী? ডিরেক্টরের চাওয়া একাত্তরের সুবোধকে বেশি সুবোধ হতে হবে। কারণ হিন্দু হয়েও শুধু যুদ্ধের কারণে তাকে দাঁড়ি রেখে টুপি মাথায় কলেমা মুখস্ত করতে হচ্ছে, বাঁচার জন্য। আমি যে সিনেমায় সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার, সেই সিনেমারই আরেকটি ক্যারেক্টারের বিছানা করে দিতে হচ্ছে আমাকে। এ নিয়ে আমার মধ্যে চাপ যে তৈরি হতো না তা নয়। ‘কাঁটা’ সেটে সেরকম ভাব নিয়ে থাকার সুযোগ কারোরই ছিল না। সুবোধ চরিত্র নির্মাণে আমি শারীরিক ঝুঁকি নিয়েছি, চ্যালেঞ্জ নিয়েছি মনে, শরীরের ওজন ৭৬ থেকে ৬৪.৭৫ কেজিতে এনেছি, রোগে ভুগেছি, সেভাবেই কাজ করে চলেছি কিসের নেশায়? বাংলার খেটে খাওয়া দৈনিক ঘামঝরানো নিন্মবর্গের মানুষের মুখের অভিব্যক্তিকে খুঁজে পেতে চেয়েছি। নেশা এখানেই। মুচিবাড়িতে লোকনাথের ছবি আনতে গেছি। ২৪ ঘণ্টা ধ্যানস্থ থেকেছি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে প্রতিটি কাজে।

মানুষ ধ্যানস্থ থেকে কাজ করে গেলে সবই পারে। অনেক কাজ বাকি আছে। ভূতের গলির মহল্লাবাসীদের স্মৃতিপটে ঘুরেফিরে আসে ব্যাপারির বাড়ির ভাড়াটিয়া সুবোধ-স্বপ্নার কথা। নয়নতারা ফুটে থাকে পোড়োবাড়ির অঙিনায়। তুলশি গাছটি চোখে পড়ে। নারী পুরুষের লাশ তোলা হয় কুয়ো থেকে। 
সেই লাশ কাদের?
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়