ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গবেষণায় সত্যের কাছাকাছি পৌঁছুতে চাই

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৩১, ২৩ মার্চ ২০২২   আপডেট: ২১:৫৩, ২৩ মার্চ ২০২২
গবেষণায় সত্যের কাছাকাছি পৌঁছুতে চাই

সৃজনশীল ও মননশীল সাহিত্যের দুই ধারাতেই রয়েছে রঞ্জনা বিশ্বাসের পদচারণা। কবিতা ও ফোকলোর চর্চা তার ব্রত। পরিচিতি পেয়েছেন গবেষণাকর্মে। তার ‘বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা’, ‘বাংলাদেশের পালকি ও পালকিবাহক: নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়’, ‘বাংলাদেশের বেদে জনগোষ্ঠীর নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয়’ গ্রন্থগুলো প্রশংসিত হয়েছে। স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন ‘কালি ও কলম তরুণ কবি ও লেখক সাহিত্য পুরস্কার’, ‘ব্রাক ব্যাংক সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’। রঞ্জনা বিশ্বাসের বইয়ের সংখ্যা ২৪। সার্বিক সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন হিসেবে সম্প্রতি তিনি অর্জন করেছেন অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার। কবি স্বরলিপির সঙ্গে এই কথোপকথনে উঠে এসেছে রঞ্জনা বিশ্বাসের গবেষণাকর্মের নানা দিক।

স্বরলিপি: ‘অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৮’ প্রাপ্তিতে আপনাকে অভিনন্দন। এই প্রাপ্তির আনন্দ কীভাবে উদযাপন করছেন?

রঞ্জনা বিশ্বাস: পুরস্কার এক ধরনের ভালোবাসা। ভালোবেসে কেউ যদি দূর্বা ঘাসের একটি আংটিও পরিয়ে দেয়, সেটিও আমার কাছে পুরস্কার প্রাপ্তির মতোই গুরুত্ববহ। তবে এ জাতীয় পুরস্কারের ক্ষেত্রে ভালোবাসার চেয়ে বেশি কাজ করে মূল্যায়ন। অর্থাৎ আমি যে কাজ করেছি, সেই কাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা হয়। আর আনন্দ উদযাপন আমার কাছে ‘আনুষ্ঠানিকতা’ অর্থে নয়। এমন মনে হওয়ার পেছনে নানা কারণ, বিষয় ও অভিজ্ঞতা আছে। আমি মনে করি, পুরস্কার কাজকে পাল্টে দেয় না সত্য কিন্তু কাজের প্রতি লেখককে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে পারে।  

স্বরলিপি: ‘বাংলাদেশের লোকধর্ম’ বইটিতে আপনি লোকধর্মের যে সব বিষয় উপস্থাপন করেছেন তা মানুষের বহু মত ও বিশ্বাসকে সামনে নিয়ে আসে, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক ভাবনার দিকে এগিয়ে দেবে। এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ করার পেছনে আপনার কোন ভাবনা কাজ করেছে?

রঞ্জনা বিশ্বাস: যখন ধর্ম তার আচরণ ও বিশ্বাসকে অনড় অবস্থানে ধরে রাখতে চেষ্টা করে, তখনই সৃষ্টি হয় ধর্মের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। এখানে এসে মানুষ শাস্ত্র নির্ধারিত আইন-কানুন বা নিয়ম-নীতির বাইরে যেতে পারে না। কারণ এখানে আত্মায় বিশ্বাস যেমন অনড়, তেমনি আচরণগত বিষয়ের প্রতি সিদ্ধান্ত অনড়। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুসারীদের পক্ষে ধর্মীয় বিধানের বাইরে যাবার সুযোগ তৈরি হয় না। কিন্তু মানুষ তো যন্ত্র নয়, সে তার আচরণ আত্মা দ্বারা সবসময় নিয়ন্ত্রণের পক্ষপাতীও নয়; সেও নিজের অস্তিত্বের বিষয়টি জানান দিতে চায়। ফলে শাস্ত্রীয় ধর্মের সঙ্গে সৃষ্টি হয় সংঘাত। প্রকৃতির মধ্যে মানুষ যে দুর্মর প্রবল শক্তি লুকিয়ে থাকতে দেখে, তা সে নিজের মধ্যে অনুভব করতে চায়। তখন আত্মার বিশ্বাস নয়, আত্মবিশ্বাসে সে বলীয়ান হয়ে ওঠে এবং খারিজ করে দেয় শাস্ত্রীয় নিয়ম। মানুষ তখন আবার তার সামাজিক জীবনকে বৈধতা দিতে তার বিশ্বাসকে যৌক্তিক করে তোলার যাবতীয় চেষ্টা চালায়। আর এভাবেই সৃষ্টি হয় ভিন্ন একেকটি ধারা, যাকে আমরা লোকধর্ম বলি। এটি প্রতিবাদী আন্দোলন বা ধারা নামেও পরিচিত। 

লোকধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শাস্ত্রীয় ধর্মকে অস্বীকার করা। যেমন ভগবানিয়া একটি লোকধর্ম সম্প্রদায়, যারা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচলিত সব রীতি-নীতি অস্বীকার করে একটি স্বতন্ত্র বিশ্বাস ও আচরণ দ্বারা পরিচালিত। একইভাবে মাতুয়া, বাউল, পাগলচাঁদ, রাই রসরাজ, বলাহাড়ি প্রভৃতি সম্প্রদায় তাদের বিশ্বাস ও আচরণের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে এবং মানুষকে ঈশ্বর জ্ঞানে শ্রদ্ধা ও ভক্তি নিবেদন করেছে। বাংলাদেশে এই রকম লোকধর্মের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কাজটি শুরু করতে গিয়ে হোরেস হেম্যান উইলসন (১৭৮৬-১৮৬০)-এর কথা বারবার মনে পড়েছে। ১৮০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বেঙ্গল স্টাবলিশমেন্টে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন হিসেবে ভারত আসেন। এখানে এসেই তিনি লিখে ফেলেন বেশ কিছু বই। এর মধ্যে ‘A Sketch on the Religious Sects of the Hindus’ উল্লেখযোগ্য। বইটির সাহায্যেই রচিত হয় অক্ষয় কুমার দত্তের ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। এই দুটি বইয়ের আলোকে ‘বাংলাদেশের লোকধর্মের’ বিষয়টি চিন্তা করি এবং তা বৃহৎ পরিসরে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছি। 

প্রতিটি লোকধর্মের দর্শন, অন্যান্য ধর্ম-সম্প্রদায়গুলোর সঙ্গে সংযোগ ও স্বাতন্ত্র্য, তাদের সামাজিক আচার-সংস্কার ও দৈনন্দিন জীবন, প্রবক্তার জীবন ও কর্ম এই গ্রন্থে তুলে ধরেছি, যেন আগ্রহী পাঠক তাদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে। এখানে তুলনামূলক ও আন্তঃসম্পর্কের ভিত্তিতে ধর্মের যে নৃবৈজ্ঞানিক অধ্যয়ন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। তাছাড়া এটি কোনো একাডেমিক গবেষণা নয়। আমরা চেয়েছি বাংলাদেশের লোকধর্মগুলোর প্রকৃতি ও ধর্মচর্চার অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে। এ লক্ষ্যে পাঁচটি লোকধর্ম ভগবানিয়া, বলাহাড়ি, মতুয়া, রাইরসরাজ ও পাগলচাঁদ সম্প্রদায় নিয়ে সম্পন্ন হলো ‘বাংলাদেশের লোকধর্ম- প্রথম খণ্ড।

স্বরলিপি: আপনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ ‘বাংলাদেশের পালকি ও পালকিবাহক’। পালকিবাহকদের বর্তমান পরিস্থিতি কেমন?

রঞ্জনা বিশ্বাস: এই বইয়ে ১৩টি অধ্যায় রয়েছে, যার প্রাণকেন্দ্রে আছে পালকি ও পালকিবাহক জনগোষ্ঠী। ঐতিহ্যগতভাবে পালকি হলো একটি লোকবাহন আর পালকিবাহক জনগোষ্ঠী হলো ফোকলোরে এমন একটি মানবগোষ্ঠী যারা একই ভৌগোলিক পরিবেশে বাস করে, যাদের জীবন ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, জীবিকা ও ঐতিহ্যের অবলম্বন কোনো না কোনোভাবে একই সূত্রে গ্রথিত। পালকি তাদেরই সৃষ্ট উপকরণ। পালকিকেন্দ্রিক সংস্কৃতি, পালকির গান, ধাঁধা, লোককাহিনি ইত্যাদি তাই ফোকলোরের অংশ।

পালকি এমন একটি উপকরণ যার উদ্ভব ঐতিহ্যের আশ্রয় সম্ভব হয়েছে এবং বর্তমানে তা শিল্প, সাহিত্যে বিশেষভাবে বিশেষ অর্থে প্রতিফলিত প্রতিরূপিত হয়ে কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এই বিচারে পালকি ও পালকিবাহক জনগোষ্ঠীর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে ফোকলোর বিভাগে। বর্তমানে পালকিবাহকদের মধ্যে বাগদী জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার অবস্থা খুবই খারাপ। তারা নিজেদের পালকিবাহক জনগোষ্ঠী বলে পরিচয় দেয়। তবে তারা এখন আর পালকি বহন করে না। তারা অনেকে রিকশা চালায়, কেউ শ্রমিকের কাজ বা দিনমজুরের কাজ করে। এছাড়া মুসলিম বেহারা পাড়াগুলো এখন উঠে গেছে। যেমন রাজবাড়ী বেহারা পাড়ার নাম এখন ‘কলেজ পাড়া’। এভাবে তারা মূল জনস্রোতে মিশে যেতে চাইছে। আধুনিক যন্ত্রযানের কারণে পালকি নামক বাহনের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। ফলে পালকি বাহকের উপস্থিতি সমাজে এখন আর প্রয়োজন নেই। এখন তারা নানা ধরনের পেশায় ঢুকে গেছে।

স্বরলিপি: বর্তমানে কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন?

রঞ্জনা বিশ্বাস: কয়েকটি কাজের টেবিল ওয়ার্ক শেষ করেছি। ‘বাংলাদেশের লোকধর্ম’ দ্বিতীয় খণ্ডের কাজ এখনো চলছে। এছাড়া ‘মুক্তিযুদ্ধে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়’ প্রথম খণ্ড বেরিয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের কাজ রয়ে গেছে। সম্প্রতি আরও একটি কাজে হাত দেবো ভাবছি- টেবিল ওয়ার্ক করছি। 

স্বরলিপি: টেবিল ওয়ার্ক করার ক্ষেত্রে ঠিক কী ধরনের সহযোগিতা আপনাকে নিতে হয়?

রঞ্জনা বিশ্বাস: যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে যাচ্ছি, সেই বিষয় সম্পর্কে যিনি জানেন তার সঙ্গে কথা বলি। তাদের সাক্ষাৎকার নেই। এরপর সেকেন্ডারি উৎসের তথ্য নেই। সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা নেই কবি পরিতোষ হালদারের কাছ থেকে। যেহেতু তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। আমাদের দেশের সমস্ত কিছুই তো রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, বুঝি অথবা না-বুঝি আমাদের জীবনযাপনও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এই রাজনৈতিক ব্যাপারগুলো বোঝার ক্ষেত্রে পরিতোষ হালদার দাদা প্রায়ই পরামর্শ দেন। এমনকি কোনো বইয়ের নাম রাখার ক্ষেত্রেও তিনি আমাকে চিন্তাভাবনা করার কথা বলেন। এছাড়া আমাকে সহযোগিতা করেন ড. তপন বাগচী।

স্বরলিপি: একদিকে গবেষণা অন্যদিকে পরিবার- কীভাবে সামলান?

রঞ্জনা বিশ্বাস: আমি যখন কাজ করি তখন একসঙ্গে একাধিক কাজ করি। যেখানে বা যে অঞ্চলে গবেষণার কাজে যাই, পাশাপাশি ওই অঞ্চলে এমন কিছু খুঁজতে থাকি যেটা আলাদা, যেটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। এরকম কিছু ভাবার চেষ্টা করি। কখনোই কাজ ছাড়া থাকি না। পরিবারের কথায় আসি, সব সফল ব্যক্তির পেছনে একজন ত্যাগী মানুষ থাকেন। আমার ক্ষেত্রে সেই ব্যক্তিটি হচ্ছেন দিদি। আমার একান্ত পরিবার বলতে দিদি আর মেয়েকে নিয়ে সংসার। এই সংসারের সমস্ত দিক দিদি সামলান, আমি অর্থনৈতিক যোগান দিয়ে থাকি। এর বাইরে আমার কাজ লেখা। আমি পরিবারকে সময় দেওয়া অর্থে বুঝি নিজের উপস্থিতি অনুভব করাতে সক্ষম হওয়া। সেটা সবসময় ঠিক রাখার চেষ্টা করি।

স্বরলিপি: প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আপনার বিস্তর। মানুষের মুখ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত হতে কী করেন?

রঞ্জনা বিশ্বাস: একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি- যখন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গবেষণা করি, একদল বলছিল যে- এরা মুক্তিযোদ্ধা। আরেক দল বলছিল- এরা মুক্তিযোদ্ধা নন। তখন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই করতে হয়েছে। যেমন তারা ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়েছে কিনা, দেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকলে কোথায় প্রশিক্ষণ নিয়েছে। কারা তাদের নেতৃত্বে ছিলেন, কোন ধরনের কাজ করেছেন, কোথায় যুদ্ধ করেছেন, এই বিষয়গুলোর যিনি বর্ণনা দিতে পেরেছেন বইয়ে তাকে অন্তর্ভুক্ত রেখেছি। ঐতিহাসিক সত্য বা ঐতিহ্যগত সত্য যাচাই করার জন্য আমাদের হাতে যে সব তথ্য, উপাত্ত, বই, প্রামাণ্য দলিল থাকে সেগুলোর ভিত্তিতে নতুন তথ্য যাচাই করে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছুতে চাই। 

স্বরলিপি: আপনার আগামী দিনের কর্মপরিকল্পনা জানতে চাই?

রঞ্জনা বিশ্বাস: আমি যে কাজটি করতে চাই, সেই কাজেই মনোনিবেশ করতে চেয়েছি। আমি যদি প্রতিযোগী তৈরি করি, তাহলে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে আমার নিজের সঙ্গে। যে বইগুলো লেখা হয়ে গেছে সেগুলো নিজে পড়ার পর যদি মনে হয় যে ভালো লাগেনি, তাহলে ওটাকেই উৎরে যাবার চেষ্টা করেছি। অন্য কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবিনি কখনো। এখনও মনে হচ্ছে যে নিজের সেরা কাজটি করা হয়নি। সেজন্য ভাবছি আরও ভালো কী দিতে পারি।

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়