ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

এক আপসহীন গল্পের নাম মাছুমদা

নাদিম মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:২৯, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২২  
এক আপসহীন গল্পের নাম মাছুমদা

মাহমুদুল হাসান মাছুম

মাছুমদা, সমতল ও পাহাড়ের মানুষের কাছে কারো পরম বিশুদ্ধ বন্ধু, বাবা, কারো দাদা, দাদু। পাহাড় থেকে সমতল সবখানে তার সমান বিচরণ, সবার প্রিয় মুখ। জীবনের সাথে জীবন জড়িয়ে পড়ে বইমেলার কোনো এক বিকেলে আপনার সঙ্গে পরিচয়। বইমেলা ২০২২ দাদার সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে আমৃত্যু বন্ধুত্ব। কিন্তু এতো অল্প সময়ে আপনাকে বিদায় দিতে হবে ভাবতে পারিনি। কথা ছিল নভেম্বরে ফুরোমন পাহাড়ে বেড়াতে যাবো। 

তার আগেই বিদায় নিলেন পাহাড় চূড়ার শূন্যতাকে আরো শূন্য করে দিয়ে। কবি হিসেবে নয় এক সিনিয়র বন্ধু অভিভাবক হিসেবে পেয়েছি। আড্ডায় আপনার পাহাড় নিয়ে নানান গল্প শুনতে শুনতে আপনার সঙ্গে পাহাড়ে যাবার লোভ জেগে উঠলো মনে। একদিন বললাম পাহাড়ে নিয়ে যান। বললেন, এই বিজুতে চল!  কিন্তু বিজুতে তো যেতে পারবো না অফিস ছুটির ঝামেলা আছে। তবে নেক্সট টাইম দাদা আমি যাবো। দাদা ঘুরে এলেন। 

দাদা বিজুতে বাড়ি, নিমন্ত্রণ খাওয়ার গল্প করলে মনটা ভীষণ খারাপ লাগলো। কারণ পাহাড়ে অনেকেই যায় আমি গিয়েছি অনেকবার কিন্তু পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে তাদের বাড়িতে থাকা-খাওয়া হয়নি কখনো। 

দাদার সে সৌভাগ্য হয়েছে বহুবার। ১৯৮৪ সালের দিকে দাদা জীবিকার জন্য পাহাড়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর দু’দিন আগেও ঘুরে এলেন কাউখালী উপজেলার উল্টো পাড়া থেকে। এই সফরে আমিও ছিলাম দাদার সঙ্গে। বৃহস্পতিবার রাতে রওনা দিলাম তারপর সকালে রাঙামাটি শহরে বাস থেকে নেমেই দাদা বললেন, নাদিম পাহাড়ে এলেই মন শরীর ভীষণ ভালো হয়ে যায়। এরপর বললেন, চল আগে নাস্তাটা সেরে একটা ঘুম দিবো, তারপর যা করার করবো। আমি সিগারেট ধরালাম। দাদা বললেন, ধরাবো নাস্তাটা শেষ করি আগে তারপর। এরপর শুরু হলো রেস্টুরেন্ট খোঁজার পালা। এতো সকালে কোনো খাবার হোটেল পেলাম না। দাদা ঠিকই লেকের পাড়ে, একটা ছোট্ট দোকান পেলো। সেখানে গিয়ে দেখি রুটি পরোটা কিছুই নেই শুধু হালুয়া আর চা। তাই খেয়ে দাদার প্রিয় জায়গা উদ্যোগ রিসোর্টে উঠলাম। আমরা ঘুম দিলাম, ৮টার পর আমার ঘুম ভেঙে গেল। একটা কবিতা লিখলাম।

‘গহিনে নিজেকে দেখার কেউ নেই। 
সব খবর সব সময় মিথ্যে নয়।
চূড়া থেকে নেমে এসে যারা সমতলে জমাট বেঁধেছে।
মস্তিষ্কে সিরোসিস একটা ভাবনা ভাবায়। 
মৃত্যু!  ভাবতে হয় সকল যাতনাকে খাদে ফেলে। 
শহর জুড়ে কৃত্রিম আলোর ছড়াছড়ি 
কোথায় থেকে আসে এইসব পূর্ব অনুমান ছাড়াই
চিৎ করে ফেলে দেয় মহা শূন্যতায়। 
তার আগে হয়তো লিখে যাবো  শূন্যতার নতুন ইতিহাস। 
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভুগবে তীব্র মৃত্যু শূন্যতায়।
পৃথিবী! লাফিয়ে লাফিয়ে কোথায় চলে গেছে! 
জানে না শুধু তৃতীয় বিশ্বের পারাপারের মাঝি,
আকাশ আর পাতালের শূন্যতা ছোট হয়ে আসছে মানুষের হাতের মুঠোয়,
জানেনা শুধু আফ্রিকান ক্ষুর্ধাত শিশু।
হিংসা বিদ্বেষ, ঘৃণা প্রতারণা জেগে উঠবে বালুচরের মতো নিজের অবয়বে,
দল বেঁধে এগিয়ে যাবে মহিমান্বিত মৃত্যুর ফাঁদে। 
যখন পড়তে শিখবে অপ্রকাশিত গোপন, অবচেতন চিন্তার বহর 
তখনই দেখা দেবে কাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংকট।’

এই লেখটা শেষ করে আমার চোখে ঘুম চলে এলো। কিছুক্ষণ পরে দুজনেই উঠলাম। দাদাকে লেখাটা দেখালাম। বললেন ভালো হয়েছে। এরপর নিটশের জরথুস্ত্র বলছি বই থেকে ‘লোকাতীত বিশ্বাসীগণ এবং দেহ-বিদ্বেষীরা’ পড়ে শুনালাম। এরপর শুধু একটা মন্তব্য করলেন, দেখ আমাদের শাহবাগ উদ্যানকেন্দ্রীক আড্ডার মানুষরা ধর্ম বিশ্বাস করে না অনেকেই কিন্তু সবার মৃত্যুর পরে যার যার ধর্ম মেনে শেষ বিদায় হয়।  তখন আর কারোরই কিছু করার থাকে না। কবিতাটা যে প্রথম আঘাত করবে বুঝতে পারিনি, জানতে পারলে পোস্টই দিতাম না।

দুপুরের পর আমি, দাদা, প্রগতিদা, সুশীলদা, তাদের পরিবারবর্গ এবং মারিয়া রওনা দিলাম উল্টোপাড়ার উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি উঁচুনিচু রাস্তায় চলেছি মনোরম পরিবেশ। চারদিকে পাহাড়, লেক, পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট বাড়িঘর, পাহাড়িদের টং দোকানে চা বিরতি। নানান রকম বিচ্ছিন্ন গল্প এখন স্মৃতি হয়ে বসে আছে সময়ের ফ্রেমে।

সিএনজি থেকে নামলাম। দেখলাম একটা পাহাড়ি ছেলে দাড়িয়ে আছে, দাদা নেমে দাঁড়ালো আমার পাশে। ছেলেটা দাদার কাছে আসলো। দাদা বললেন চিক্কু! চিক্কু পা থেকে জুতোটা খুলে রেখে দাদার পা ধরে সালাম করলো। এরপর পাহাড়ের মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটা শুরু। দাদা বললেন, এখন আর গাড়ির প্যাঁ পুঁ নাই শুধু পাখি আর পোকার শব্দ। পাহাড়ের নির্জনতা দাদাকে ভীষণভাবে গ্রাস করতো। দাদা বিজ্ঞাপন দিয়ে ভালো মানুষ সাজার চেষ্টা করেনি কখনো। দাদার ভেতর দ্বিচারিতা ছিল না।  যা বলতো অকপটে বলত। তোর মধ্যেও খারাপ কিছু দেখলে বলবো- ছাড় পাবি না। দাদার সঙ্গে এক যুগ চলতে পারলে অনেক কিছু লাভ করতে পারতাম, দাদার সেলিম মোর্শেদ ভাইকে নিয়ে একটা ইন্টারভিউ নেয়ার কথা ছিল, কমপক্ষে বিশজন সাহিত্যিকের ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছিলেন দাদা। লেখক-সাহিত্যিকদের চিন্তা-ভাবনা অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ একটা গাইড লাইন তৈরি হতো। পরবর্তী প্রজন্ম অনেকটা এগিয়ে যেতো। 

পাহাড় বেয়ে বেয়ে যখন সমতলে নামলাম দেখলাম সবুজ ধানের মাঠ চারদিকে পাহাড় ঘেরা, মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম বাঁশের সাঁকো পার হয়েই চিক্কুদের বাড়ি। এরকম বিচ্ছিন্ন এলাকায় আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাসহ বাড়ি ভাবতেই পারিনি। আমরা যখন চিক্কুদের বাড়ি পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই পাহাড়ের বুকে, সন্ধ্যা মনে হয় পৃথিবী। চোখে তন্দ্রা লেগেছে। চারদিক থেকে ধেয়ে আসছে অন্ধকার। বাসার বারান্দায় বসতে বসতে দাদা দাবা নিয়ে বসে গেলেন, আমিও চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু টানতে পারিনি।

এরপর সবার সাথে পরিচিত হলাম। রাতের খাবার আয়োজনটা ছিল সুশীলদার শ্বশুরবাড়িতে, ঝিরিপথ উঁচুনিচু রাস্তা পার হয়ে। রাতের খাবার তালিকায় ছিলো মুরগি, মাছ, বাঁশকোরল, শাক, পাহাড়ি চুয়ানি, এর পর শুরু হলো গান, কবিতা আর আড্ডা। পাহাড়ের নির্জনতা জেঁকে বসেছিলো মনে। পরদিন সকালে নাস্তা শেষ করে বের হলাম তিন বাড়িতে দাওয়াত। সব বাড়িতে চুয়ানি দিয়ে আপ্যায়ন করলো, এইরকম পরিবেশে আর কোনোদিন যেতে পারবো কি না জানি না; দাদা নেইতো। বিকেলে আবার মন্দির দেখতে গেলাম। দাদা চকামাদের অনুকরণে লুঙ্গি পরলেন। 

মন্দিরের সামনে গিয়ে বললেন। আমার পিছন থেকে ছবি তোল। ছবিগুলো আছে দাদা নেই! ভাবি কোনো একদিন বিকেলবেলা দাদা মেসেজ দিয়ে বলবেন, বের হলামরে কাঁটাবন আসিস। কখনও আমি আগে চলে যেতাম কখনো দাদা। জিজ্ঞেস করতাম। দাদা কখন এলেন, বলতো এই এলাম কেবল মাত্র, আয় চা খাই নয়তবা কফি, সিগারেট নিয়ে আয়, তোর এগুলান আমার পোষায় না। এরপর কখনো কবিতা পরিষদ, উজান, জাগতিক এভাবে ঘুরে ঘুরে চলতো আড্ডা, ৮টার দিকে মার্কেটের বাইরে আড্ডা হতো কবি টোকন ঠাকুর, কবি দিলদার হোসেন, শাহীন ভাই, কচি ভাই আরো অনেকে। আমি কখনো বসতাম আবার কখনো চলে যেতাম। দাদা একসময় উদ্যানকেন্দ্রীক আড্ডায় বসতো। শেষের দিকে এসে কেন জানি দাদা আর টিএসসি, মন্দিরকেন্দ্রিক আড্ডায় যেতেন না। 

দাদা অনেকের আচার আচরণে বিরক্ত হয়ে এই শিল্প সাহিত্যের মানুষদের নিয়ে কবিতা লিখেছেন। কবিতার শিরোনাম ‘খানকিপাড়ার বাসিন্দা’ প্রায় সুযোগ পেলে পড়ে শোনাতেন। দাদা ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, জীবনবোধ, বর্তমান হালচাল নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতেন। কোনো অসঙ্গতি দেখলে সজোরে আঘাত করতেন। দাদার সঙ্গে প্রথম পাহাড়ে যাওয়া ২০২২-এর মে মাসে কাপ্তাই গিয়েছিলাম। রাইন্যা টুগুন রির্সোটে যে দিন রাতে পৌঁছালাম সে রাতে আড্ডা শেষ করে সবাইকে কফি খাওয়ালাম। আমি, তারপর সবাই শুতে গেলাম আর হঠাৎ একটা কোকিল ডাক দিলো। এরপর এক এক করে তিনটে ডাক দিলো। দাদা একটু উঠে বসলেন, ডাকের বিষয়টা ভালো ঠেকছে নারে! এই কথা শোনার সাথে সাথে সবার চোখে-মুখে চরম ভয় দেখালাম, এরপর দাদা ললিতদাকে কল দিলেন। বললেন, দাদা ডাকটা শুনতে পাচ্ছেন। ললিতদা বললেন, আরে এটা হলো সঙ্গীহারা কোকিল। ও সঙ্গী জোগাড় করার জন্য ডাকছে। ভয় নেই ঘুমিয়ে পড়েন। 

এরপর দাদা বললেন, পাহাড়ি উগ্রপন্থীরা তাদের লোকজনকে কোকিলের ডাক দিয়ে সিগনাল দেয়। সে রাতে ঘুমোতে পারিনি। টানা দু’রাত তিনদিন অনেক গান কবিতা আড্ডা হলো, সেইসব স্মৃতি উন্মুক্ত হাওয়ার মতো দল বেঁধে আসে আর এলোমেলো করে দিয়ে যায়।

দাদার চোখে অসহায়ত্ব দেখেছি। অপূর্ণতা দেখিনি কখনো। দাদা প্রায় বলতেন, আমি তো বেকার মানুষ তবে আমার মেয়েরা যা হাত খরচা দেয় তাতেই আমার চলে যায়। পুরুষ মানুষের ইনকাম না থাকলে যা হয়। একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস আমার মাঝেও ছিল; দাদার মাঝেও দেখতাম। 

আপনার দেশপ্রেম, সহজ জীবন বোধ, শিল্প সাহিত্য নিয়ে নানান চিন্তা ভাবনা, বিজ্ঞজনদের একটা প্রশ্ন করতেন সাহিত্যের বিগত পঞ্চাশ বছরের অর্জন কী? অনেক উত্তর নিতেন, আবার কারোরটা খারিজ করে দিতেন। প্রায়ই বলতেন- শিল্পের জন্য শিল্প নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে হবে, আর যে শিল্প সাহিত্য সমাজ পরিবর্তনে অবদান রাখতে না পারে ওগুলো সব আবর্জনা।  

আমিও বলতাম এইসব বলে লাভ কি দাদা! দাদা বলতেন, আঘাত করতে হবে। অপরিসীম প্রাণ শক্তির অধিকারী ছিলেন দাদা। দু’ঘণ্টা বাসে করে আসতেন আড্ডা দিতে। ভাবা যায়? আমি হলে আসতাম না। কথা ছিল পাহাড় থেকে ফিরে সেলিম মোর্শেদ ভাইয়ের ইন্টারভিউটা নেবেন। এই কাজটা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করছিলেন। নওগাঁর মুক্তিযুদ্ধ ও আওয়ামী লীগের নানান ইতিহাস এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আপনার গ্রামের কথাগুলো লেখার কথা ছিলো, পাহাড়ে পাঠাগার করবেন- এত সব কাজ ফেলে কোথায় হারিয়ে গেলেন দাদা।

ছেড়ে যাবেন বলেই হয়তো বলেছিলেন, প্রয়োজনে একা চলবি আর লিখে যা, লেখাটা বন্ধ করিস না। পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই- এক আপসহীন গল্পের নাম মাছুমদা, কবি মাহমুদুল হাসান মাছুম।

লেখক: কবি


 

/তারা/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়