ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মহাকালের তর্জনী: একটি গবেষণালব্ধ ঐতিহাসিক কাব্য সংকলন

সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫৮, ২৬ ডিসেম্বর ২০২২  
মহাকালের তর্জনী: একটি গবেষণালব্ধ ঐতিহাসিক কাব্য সংকলন

কানাডার নায়াগ্রা জলপ্রপাতের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই কবিতাটি: ‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান,/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’। কারণ বহমান নদীর জল আর বিশাল ঝরনাধারা কোনোভাবেই শেষ হবার নয়; তেমনি বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রবাহমান থাকবে।

তাঁকে নিয়ে নানা ভাবে গবেষণা হচ্ছে, হাজার হাজার গ্রন্থ রচিত হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে। যেন অফুরন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যাঁরা শুরু থেকে এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত, তাঁদের একজন মিছিলের সমান বয়সী কবি কামাল চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী কবিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। সেই প্রতিকূল পরিবেশে, বৈরী রাজনৈতিক রাহুগ্রাসের বিরুদ্ধে নানা ভাবে দুঃসাহসী ভূমিকা নিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে অবসর জীবনে পা দিয়েও তিনি ধারাবাহিক ভাবে বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ স্বেচ্ছাসৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটি বাস্তবায়নের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সম্পাদনা করেছেন বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বেশ ক’টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ এবং লিখেছেন দারুণ সব কবিতা। যেমন বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস নিয়ে তাঁর সেই বিখ্যাত ‘১০ জানুয়ারি ১৯৭২’ কবিতাটি আমার অত্যন্ত প্রিয়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দশটি সেরা কবিতার একটি ‘১০ জানুয়ারি ১৯৭২’। এক দিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত রক্তমাখা শোকে জড়ানো সদ্য স্বাধীন দেশ, অপর দিকে নেতার প্রত্যাবর্তনে স্বতঃস্ফূর্ততার আনন্দে মুখরিত পরিবেশ দ্রবীভূত করে রচিত এই কবিতা। যা নিয়ে আমি একটি চিত্রনাট্য তৈরি করেছি।

উল্লেখিত ঐতিহাসিক কবিতার প্রতিটি লাইনই এক একটি কবিতা। সেই কবিতায় মাটি, মানুষ, নদী, শস্যক্ষেত, বৃষ্টি, বাতাস, পাখি, প্রকৃতি, পতাকা প্রভৃতিকে কবি একাকার করে নির্মাণ করেছেন অসাধারণ ভাবে। তাতে কবিরা কাব্য প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে।

আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে গবেষণা করছি। শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব, ইনডেমনিটি বিল, বিভিন্ন ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা, বিদেশে বঙ্গবন্ধু চর্চা, পালাতক খুনি নূর চৌধুরীকে অনুসন্ধান এবং তথ্যমূলক গ্রন্থ রচনা ইত্যাদি অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধু নিয়ে এ পর্যন্ত যত কবিতার সংকলন প্রকাশ পেয়েছে, তার মধ্যে ‘মহাকালের তর্জনী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিবেদিত কবিতা’ শীর্ষে; সব দিক দিক থেকেই সেরা। লেখা নির্বাচন, সম্পাদনা, গবেষণা, প্রকাশনা থেকে সাড়ে এগারো পৃষ্ঠার ভূমিকা তার উজ্জ্বল উদাহরণ।

একাধিক কারণে আলোচ্য সংকলন ‘মহাকালের তর্জনী’ এ পর্যন্ত প্রকাশিত কবিতা সংকলনের মধ্যে সেরা। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে প্রকাশিত সংকলনগুলোতে তাঁকে নিয়ে লেখা নয়, এমন কবিতাও অন্তর্ভূক্ত আছে। বেশির ভাগ যাচাই বাছাই না করে এসব কবিতা সংকলনভূক্ত করার ফলে এগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত তৈরি হয়েছে। এ সংকলনে সে কবিতাগুলো অন্তর্ভূক্ত হয়নি’।

ভূমিকার এই বক্তব্যের সাথে আমি পুরোপুরি একমত। কারণ- ত্রুটিমুক্ত সংকলনটি অত্যন্ত বিশ্লেষণমূলক, তথ্যবহুল, গবেষণালব্ধ এবং সুসম্পাদিত। যদি শুধু গবেষণাধর্মী কাব্য সংকলন হিসেবে আলোচনা করি, তাহলে দু’একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। যেমন-
ক. সুদীর্ঘ ভূমিকাটি চুলচেরা বিশ্লেষণমূলক এবং ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় সমৃদ্ধ।
খ. ভারত-বাংলার দেড়শ’ কবির কবিতার সন্নিবেশ, সংগ্রহ, সম্পাদনা, নির্বাচনের পাশাপাশি প্রতিটি কবিতার প্রথম প্রকাশ, প্রেক্ষাপট উপস্থাপন নিঃসন্দের প্রশংসার দাবিদার। সেই সাথে কবিদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্যাবলি সংযোজন বাড়তি পাওনা।
গ. দক্ষ এবং নির্মোহ সম্পাদক হিসেবে অনেক কবিতা অমনোনীত করার দৃঢ়তা। যেমন, আল মাহমুদের ‘নিশিডাক’ কবিতাটা এখানে নেই। এরকম আরো কটি সমালোচিত, বিতর্কিত এবং বিভ্রান্তমূলক কবিতা স্থান পায়নি।
ঘ. আমার ‘লেফট রাইট লেফট’ কবিতাটি আলোচ্য সংকলনে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। কবিতাটি ছাপার পূর্বে সম্পাদক বেশ ক’বার ফোন দেন; কবিতাতে ব্যবহৃত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কিত প্রতিটি তথ্য যাছাই-বাছাই করার জন্য।

উল্লেখ্য, কবিতাটি বঙ্গবন্ধুর জীবনের নানান সংখ্যা নিয়ে লেখা। সেখানে দুটি সংখ্যা নিয়ে আমরা দফায় দফায় আলোচনা করি। সম্পাদক প্রমাণ চান বঙ্গবন্ধুর (২৪২৫৬১) এই ফোন নম্বর কোথায় থেকে নেয়া। আমি সাথে সাথে ১৭-১১-৬৯ তারিখে বঙ্গবন্ধুর প্যাডে লেখা আবুল ফজল কাছে প্রেরিত চিঠির স্ক্রিন শট দিলাম। কামাল চৌধুরী তখন বললেন, এটা তো স্বাধীনতার আগে এবং তৎকালীণ পূর্ব পাকিস্তান আমলের।

একটু পর আবার ফোন। এবার তথ্য যাচাই- বঙ্গবন্ধুর ৪৬৮২ দিন কারাবাস নিয়ে। আমি যথারীতি তথ্যসূত্র জানালে তিনি বললেন, ‘অন্য গ্রন্থে এই দিন হেরফের আছে। এটা বাদ দিতে হবে। আমি আমার সংকলনে ইতিহাস বিকৃতি করতে চাই না’। ব্যক্তিগত এ তথ্য অবগত করলাম সম্পাদকের ধৈর্য এবং নিখুঁত সম্পাদনার নমুনা দৃষ্টান্তস্বরূপ।

বয়স অনুযায়ী সাজানো বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯) থেকে শুরু করে মোস্তাক আহমাদ দীন (১৯৭৪) পর্যন্ত প্রত্যেক কবির কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যাবে কখনো সরাসরি ভাবে, কখনো ঐতিহাসিক ভাবে আবার কখনো প্রতীকী বা রূপকে।

প্রায় আড়াই শ’ পৃষ্ঠার সংকলন ‘মহাকালের তর্জনী: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিবেদিত কবিতা’ পড়তে পড়তে আমি যেন কবিতার মাধ্যমে বাংলার কাদামাটির ইতিহাস, রক্তাক্ত ইতিহাস, সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীতার ইতিহাস, জয় বাংলার ইতিহাস, শোক ও শান্তির ইতিহাস পাঠ করলাম।
  
 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়