ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দ্রোহের সমুজ্জ্বল অক্ষরে লেখা সুবিমল মিশ্র

অলাত এহ্সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৩৭, ১৮ মে ২০২৩  
দ্রোহের সমুজ্জ্বল অক্ষরে লেখা সুবিমল মিশ্র

সুবিমল মিশ্র ও হাসান আজিজুল হক— দুজনই বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখক। কাউকে উপেক্ষার সুযোগ নেই। এটা লেখার ভূমিকা নয় বরং ভিত্তি।
সেদিক দিয়ে দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ বাদ দিলে, হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যকে যেভাবে শ্রমজীবী (পড়া যাক—নিম্নবর্গ) মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, সুবিমল মিশ্র কি তাই? বরং সুবিমলকে ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’ সাহিত্যিক হিসেবে বেশি মূল্যায়ন করা হয়। অথচ তিনি তকমার প্রতিষ্ঠানিক চর্চাকেই উপেক্ষা করতে চেয়েছেন।

সাহিত্যে ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা’র ধারণা নিয়ে এই দুই সাহিত্যিকের মধ্যে এক সময় মতবিরোধ হয়েছিল। তা নিয়ে সাহিত্যের ছোটকাগজে কিছু লেখালেখিও হয়েছে। এর জের টেনে ২০১৭ সালে জুনে এক সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হককে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম। পরে তা একটা অনলাইনে প্রকাশও হয়।  প্রশ্ন ছিল— ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, মানে যে প্রতিষ্ঠানগুলো অচলায়তন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার সমালোচনার দরকার আছে অবশ্যই। কিন্তু সমালোচনা করে তার কি কোনো বদল ঘটানো সম্ভব, নাকি বিকল্প সন্ধান বা গড়ে তুলতে হবে?’

উত্তরে তিনি বলেছিলেন—‘হ্যাঁ, তার বিরুদ্ধে লেখ। কিন্তু ওই কথা কেন, ওখানে আমি যাবো না— এই ভঙ্গিটা নিলো। কই, সুবিমল মিশ্র কি প্রতিষ্ঠান ভাঙতে পেরেছে? সুবিমল মিশ্র কোথায় এখন? তুমি কি সাহিত্য করবে, না তুমি বলবে যে, প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা লিখব, অ্যা?’

প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার কৌশল হিসেবে এই প্রশ্নগুলো প্রায়ই আসে— প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কি যাপন? না কি প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে লেখা? কিংবা প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বিকল্প লিখে যাওয়া? আজকের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে— প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা মানেই কি গণমুখী লেখা?

এ সব প্রশ্নের নিরিখে সুবিমল মিশ্র ও হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার’ ধারণা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়। এর কিছু আভাস হাসান আজিজুল হক সেদিনের সাক্ষাৎকারেই বলেছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল— ‘আপনার প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, না ব্যবস্থার বিরোধিতা নিয়ে সুবিমল মিশ্র কিন্তু একটা বড় লেখা লিখেছেন, আপনি কি দেখেছিলেন ওটা?’

প্রজ্ঞার সঙ্গে দারুণ রসবোধ ছিল হাসান আজিজুল হকের। তিনি বলেছিলেন—‘হ্যাঁ, সুবিমল লিখেছিল। সুবিমলের কথা থেকেই বলেছিলাম, সুবিমল বলেছিল আমরা সবাই প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক এবং সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত লেখক যারা আছেন, আনন্দবাজার বা এই সব পত্রিকায়, তাদের আমরা প্রস্রাব করি। তখন আমি আবার লিখেছিলাম যে, প্রস্রাব তুমি করতে পারো, প্রস্রাব করলেও ওই প্রস্রাব করাই সার হবে। অ্যা, আর একবার প্রস্রাব করলে আরেকবার প্রস্রাব করার জন্য কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে, মাঝখানে গ্যাপ দিতে হয়। কিন্তু আনন্দবাজারের বিল্ডিং যেমনটা তেমনই থাকবে। হা হা হা…। প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করে কোনো লাভ নেই। আমি বললাম যে, মুগুরটা দেখছো, মুগুরটা যে মারছে তাকে দেখতে পারছো না! তোমার মাথায় মুগুর পড়ছে, এই মুগুরের বিরুদ্ধে তোমার লড়াই করে কি হবে?’

এই শক্তিমান দুই লেখকই আজ প্রয়াত। তবে সুবিমল মিশ্রের ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার’ ধারণা এবং হাসান আজিজুল হকের ‘ব্যবস্থার বিরোধিতার’ বয়ান নিয়ে তর্ক এখনো আছে আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে। সবচেয়ে লক্ষণীয় হলো, দুজনেই যে দুজনকে মান্যতা দিয়ে লেখা পাঠ করেছিলেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরস্পরকে চেয়েছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে। মতের বৈচিত্র্যে দাঁড়িয়ে উদ্দিষ্টের বিরুদ্ধে ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে লড়াইটা ছিল তাঁদের, কলমে আর বয়ানে। ফলে সমস্ত সীমাবদ্ধতা, ব্যর্থতা নিয়ে তাঁদের কাছে বারবার প্রত্যাশা করেছে তরুণেরা। হাসান আজিজুল হক প্রয়াত হয়েছেন ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর। আর ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, বুধবার, প্রয়াত হলেন সুবিমল মিশ্র।

সময় আর ঘটনাকে সর্বতোভাবে নিজের মতো করে বলার বিরল ক্ষমতা ছিল সুবিমল মিশ্রের। তাঁর সময়ের মেধাবী মানুষটাই তিনি। প্রকাশ্যে আন্দোলন, আর ভেতর অন্য জীবন যাপনের মতো কাপট্য তাঁর ছিল না বোধ হয়। ফলে প্রকৃতই ‘প্রতিষ্ঠান’ আর ‘বিরোধিতা’ শব্দ দুটি একসঙ্গে (প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা) লেখার মতো আন্দোলনের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছিলেন। ফলে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা আর সুবিমল পরস্পর প্রতিশব্দের মতো উচ্চারিত হতো। কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকেই প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে অনুকরণ করতে চেয়েছেন। তাতেই বিপরীত ঘটল। যেমনটা ঘটেছিল বৌদ্ধদর্শন চর্চা করতে গিয়ে গৌতম বুদ্ধকে ‘ঈশ্বর’ জ্ঞান করে।

কখনো পশ্চিমা অনুকরণে, কখনো নিজস্ব উদ্যোগ-প্রেরণায় পশ্চিমবঙ্গে কিছু সাহিত্য আন্দোলন হয়েছে। বিরুদ্ধ প্রচার ও দমনের মুখে কয়েকটি আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে, নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্বে সংঘ ভেঙে গেছে, আর কয়েকটি আন্দোলনের পুরোধা মানুষ শেষ পর্যন্ত সাইনবোর্ড তুলে পুরোনো কীর্তি বিকিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনেরও যে রূপান্তর দরকার হয়, সেটা কোনো দলই আমল করেনি।

এই ইতিহাসের সাক্ষী খোদ সুবিমল মিশ্রও। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে বিকিয়ে দেননি বলেই এখনো মান্যতা পান। অর্ধশতকের সাহিত্য জীবনে বড় পত্রিকায় লেখেননি সেই মতাদর্শ থেকে। একই কারণে হয়তো তাঁকে একাই থাকতে হয়েছে জীবনভর। তাঁর জন্ম-মৃত্যুর তারিখ দিয়ে তাঁকে মাপা যাবে না। তিনি থেকে যাবেন যাপন আর তাঁর সাহিত্যে। 

আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সুবিমলকে নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রায় সবাই তাঁর ‘এটি রামায়ণ চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো’ সংকলনের কথা বলেন। অনেক সময় শুধু ওই নাম গল্পটার কথাই বলেন। কাণ্ডটা কী? এর উত্তর পাওয়ার যাবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সীর একটা গল্পে। তাতে দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি খুনের দায় এড়াতে দাবি করেন, ঘটনার সময় তিনি সিনেমা দেখছিলেন। তা প্রমাণ হিসেবে সিনেমার শেষ দৃশ্যের নির্ভুল বর্ণনাও দেন। পরে দেখা গেল, তিনি কেবল ওই শেষ দৃশ্যটিই দেখেছেন, আগের সময় হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। এই যে হত্যা করেও একটা দৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে দায় মুক্তির চেষ্টা, সাহিত্যের সেটা ঘটে লেখা না পড়েও খ্যাতিমান লেখকের অংশ হতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে। এই গোপন চর্চা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। যেমনটা ঘটে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের নামেও, বলার মতো কোনো ঘটনা না থাকলেও মানুষ যেমন সময়ের সাক্ষি হতে চান। যে কারণে সুবিমল মিশ্রের গল্পগ্রন্থ ‘রঙ যখন সতর্কীকরণের চিহ্ন’ নামের মতো লেখার ভেতর বর্ণের বিচিত্র উপস্থান দিয়ে কখনো তাঁকে চেনার শিশুতোষ চেষ্টা এখনো আছে। তবে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে, তাঁকে কি সামগ্রিকভাবে পাঠ করে ওঠা যায়? তাঁকে চিহ্নিত করার চিহ্ন দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

একাধিক সাক্ষাৎকারে সুবিমল মিশ্র জানিয়েছেন, তাঁর প্রিয় চলচ্চিত্রকার ফরাসি নিউওয়েভ ধারার পুরোধা জ্যাঁ-লুক গোদার। তাঁর কাছ থেকেই সুবিমল পেয়েছিলেন—গল্প বলার স্টাইলই কখনো কখনো বিষয় হয়ে ওঠে। বর্ণের বিচিত্র বিন্যাস তারই অংশ। এ কারণে লেখায় ভাষার কল্পনার চাইতে, তিনি ভিজুয়ালের দিকে গেছেন। প্রচলিত ভাষায় লেখা পড়তে পড়তে হয়তো হঠাৎ কিছু বর্ণের বিক্ষিপ্ত বিন্যাস, গোটা পাতায় একটি বর্ণ, কোনা পাতা সাদা রেখা দেয়া হয়েছে, অনেকটা কোলাজ, ভিজুয়াল ল্যাঙ্গুয়েজে চলে গেছেন লেখক।

সুবিমলের ভাষায়, ‘আঙ্গিকের প্রশ্ন, চরম কথা বোধ হয় গোদারেরই। তাঁর ভাবনায় আঙ্গিকটাই কখনো কখনো বিষয় হয় যেতে পারে, কিংবা বিষয়টাই আঙ্গিক। ঘটনাবস্তু তিনি ত্যাগ করেননি, যদিও ঘটনা বস্তুতই তাঁর একমাত্র বিষয় ছিল না। আমি ক্ষেত্র বিশেষ লিখি না। কোলাজ করি। কাট করি, যেভাবে ক্যামেরা অবস্থিত বস্তুকে করে। বস্তু আগে থেকে অবস্থিত থাকে। ক্যামেরা তাকে বের করে আনে। অবস্থান বিন্দু থেকে বিশিষ্টতা দেয়। সৃষ্টি করে। আমিও লেখা প্রস্তুত করি। ক্যামেরার ধারা ধারণ করি।’

ভাষাবিজ্ঞান যেমন বলে, একটি অর্থ বোধক শব্দ কোনো বস্তুর সংকেত রূপ হিসেবে আমাদের ভেতর জ্ঞান তৈরি করে। একইভাবে প্রাচীন মিশরের হায়ারোগ্লিফিক বর্ণ, চীনের বর্ণমালা জাপানের ক্রাঞ্চি বর্ণমালার একেকটি বর্ণ একটা দৃশ্য বা ধারণা তুলে ধরে। কিন্তু বাংলা বর্ণমালা তেমন নয়। সেক্ষেত্রে সুবিমল মিশ্রের লেখায় একটি বাংলা বর্ণের ছোট-বড় ব্যবহার কোনো সংকেত হিসেবে জ্ঞান তৈরি করে না, শুধু স্টাইল ছাড়া।

জরুরি কথা হলো, সুবিমলের ভাষায়, ‘আমার ধারণা আঙ্গিক আদর্শগত ও শিল্পজ্ঞানের মৌলনীতির সমবায়ে এবং ব্যবহারিক প্রয়োগর অভিজ্ঞতার দ্বারা গঠিত হয়, সমৃদ্ধ হয়। ইতিহাসের পরাম্পরায় কোনো বিন্দুতে ভাবাদর্শগত রূপান্তর ঘটলে আঙ্গিকের রূপান্তর অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।’ কিন্তু সেই ষাটের দশকে শুরু করা সুবিমল মিশ্রের স্টাইল, পৃথিবীর ইতিহাসে এত বদলের মধ্যেও কোনো রূপান্তর ঘটেনি। দ্বন্দ্বটা সেখানেই। হাসান আজিজুল হক যেমনটা হয়তো বলতে চেয়েছিলেন—বিরোধী হতে হতে আর কিছুই থাকে না, বিমূর্ত হয়ে যায় সব, ভাঙতে ভাঙতে পড়া মেজাজটা আর ধরে রাখা যায় না, দুর্বোদ্ধ হয়ে ওঠে। এর পক্ষে সম্মতি সুবিমলের কথাও আছে।

প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বহু শক্তিশালী স্বল্পসংখ্যক লেখকের দিন চলে গিয়ে স্বল্প শক্তিশালী বহুসংখ্যক লেখকের দিন আসছে। এ যুগের লেখকেরা... শুধু মাসিক পত্রের পৃষ্ঠপোষক, তখন তাঁদের ঘোড়ায় চড়ে লিখতে না হলেও ঘড়ির ওপর লিখতে হবে।’ লেখার বিচিত্র ধরন, বর্ণের কোলাজ, যাপনের কড়াকড়ি দ্রুতই সুবিমল মিশ্রকে মিথে পরিণত করবে, ভাবা যায়। প্রমথ চৌধুরীর ওই উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি একবার যে আক্ষেপ করেছিলেন, তা হয়তো পূরণ হবে না।

‘২৪ ঘণ্টায় ৩ ঘণ্টা লেখা, ৫ ঘণ্টা পড়া। দিনে ২ পাতা হিসেবে ৭০০ পাতার মতো লিখি, ৭০ পাতা ছাপতে দেই।’ এই ছিলেন সুবিমল। এই সংযম ও পাঠই একজন লেখককে মান্যতা এনে দিতে পারে।

এখন তাঁর সাহিত্য রইল আমাদের কাছে। ভাবতে হবে, শিখতে হবে সেখান থেকেই। সাক্ষাৎকারে হাসান আজিজুল হক যেমন বলেছিলেন, ‘বলতে হবে ভাঙার কথা, না ভাঙলে নতুন গড়ার কথা উঠবে কোত্থেকে?’ চিন্তার তো বটেই, থিতু হয়ে পড়া অক্ষরের আকারেও ভেঙেছিলেন সুবিমল, চোখে পড়ার মতো।

পঁচিশ বছর আগের সাক্ষাৎকারে সুবিমল বলেছিলেন, ‘আমার ঘরে কোনো খাট আলমারি ড্রেসিং টেবিল সোফাসেট বসার জায়গা নেই। বই আছে। শুধু বই। বই শুধু বই-ই। টেবিলে বই, চেয়ারে বই, শোয়ার জায়গায় বই, মেঝেতে ডাঁই করা বই, তাকে বই, ঘরে ঢুকতে গেলে বই ঠেলে ঢুকতে হয়। আমাকে পোড়ানোর সময় যেন বই দিয়ে পোড়ানো হয়, ইচ্ছে।’ অথচ আজকের বাঙালি লেখকদের মধ্যে একটা কথা কী করে যেন চাউর হয়ে গেছে, বেশি পড়লে লেখার হাত নষ্ট হয়ে যায়। সেখানেই সুবিমল তাঁদের চেয়ে আলাদা ও বিশিষ্ট।

প্রকাশনা নিয়ে বলতে গিয়ে অরুন্ধতি রায় একবার বলেছিলেন, আমরা বোধ হয় এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন সবাইকেই কোনো না-কোনো ক্ষেত্রে স্ববিরোধের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সুবিমল মিশ্র বলেছেন, তাঁর একটা লেখার শিরোনামই যেমন, ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা একটা টোট্যাল ব্যাপার।’ ফলত ব্যাপারটা স্থির, স্থবির প্রায়।  অমিতাভ ঘোষ বলেন, পৃথিবীর গোড়ার কথা হলো পরিবর্তনশীলতা, রূপান্তর। পরিবর্তনই পৃথিবীর নিয়ম। তা যখন না হয়, সেটা ভেঙে পড়তে থাকে। 

সুবিমলকে নিয়ে যাদের পাঠ-চর্চা, তাঁরাও সুবিমলের সবটা মেনে উঠতে পারেন, তাও নয় বোধ হয়। সুবিমলের মতো নয়, তাঁর প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার যে ধারণা তাতে হয়তো নানাভাবে দোল দেবে তরুণ লেখকেরা। যেভাবে সুবিমল নিজেকে তৈরি করেছেন, যেমনটা সুবিমল নিজেই বলেছেন— ‘তোমরা আমাকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলো। আমি কিন্তু কখনো এই একটিমাত্র ঘেরাটোপে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাইনি। তবে কি এই সংজ্ঞার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চেয়েছি? কক্ষনো না, আমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী— একশ বার, কিন্তু কখনোই শুধু প্রতিষ্ঠানবিরোধী নই। নিজেকে আমি কোথাও, কোনো সংজ্ঞায় আটকে রাখার বিরোধী। আমি তেমন লেখা লিখতে চেয়েছি যা দিয়ে কোনো না-কোনোভাবে এই শোষণকেন্দ্রিক স্থিতাবস্থা ব্যাহত হয়। ব্যবস্থাটাকে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চেয়েছি আমি, কিন্তু কোনো পথের কথা বলতে পারি নি, কেননা পথ আমার জানা নেই— আমি নিজেই একজন পথসন্ধানীমাত্র, এক অর্থে আমার লেখা এই পথ-সন্ধান-প্রচেষ্টা। তা করতে গিয়ে আমাকে আমার নিজস্ব বলার ধরনও খুঁজে নিতে হয়েছে।’

লেখালেখিতে স্থানুবদ কোনো ধারণা নেই, কেন না সাহিত্যই হচ্ছে প্রবল স্রোত। আপনি যা-ই করেন, তা ওই স্রোতে মিশে যাবে। পাঠক সেখান থেকেই স্বাদ নেবেন। কিন্তু স্রোতে মিশে যেতে হবে বলে তাতে ভেসে যাওয়া নয়, বরং নিজের মতো করে যতটুকু অবদান রাখতে পারা যায়, সেটাই লেখকের কৃতিত্ব। সুবিমলও বাংলা সাহিত্য অবদান রেখেছেন, খুবই নিজস্বতার ভেতর দিয়ে। সেজন্যই তিনি স্মরণীয়।

সুবিমল মিশ্রের দুটি বই পেয়েছিলাম নীলক্ষেতের অধুনালুপ্ত পুরোনো বইয়ের দোকান ‘মোস্তফা বই’-এ। অ্যান্টি উপন্যাস, অ্যান্টি গল্প সংগ্রহ। প্রকাশনীর কথা মনে নেই, সম্ভবত ‘বিতর্ক’। কালো প্রচ্ছদ, তার ওপর ছড়ানো হরফে লেখা শিরোনাম। মৃত্যুর মতো কালো প্রচ্ছদের ভেতর দ্রোহের সমুজ্জ্বল লাল অক্ষরে লেখা— ‘সুবিমল মিশ্র’।

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়