মনস্তত্ব ব্যবহার করেই সাহিত্যে সৃজনশীলতা তৈরি হয়: মোহিত কামাল
উৎপল দত্ত || রাইজিংবিডি.কম
মন, মনস্তত্ত্ব, সাহিত্যপাঠ, ভালোবাসা এবং টিনএজ কিশোর-কিশোরীদের মনের বিকাশ নিয়ে কথাসাহিত্যিক ও মনোবিশ্লেষক মোহিত কামালের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গল্পকার, অনুবাদক উৎপল দত্ত।
উৎপল দত্ত: যারা বয়ঃসন্ধিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তাদের মন পরিচর্যার ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা কী ধরনের ভূমিকা রাখতে পারেন? এ প্রসঙ্গে সাহিত্যপাঠের প্রয়োজনীয়তার কথাও শুনতে চাই।
মোহিত কামাল: ভালোবাসা কিশোর-মনস্তত্ব বা পরিচর্যা যাই বলুন না কেন, মন বুঝতে হলে কগনিটিভ থিয়োরি বা কগনিশন বোঝার বিকল্প নেই। এটা সাহিত্যেও আছে। সাইকোলজিতেও আছে।
উৎপল দত্ত: কগনিশন সম্পর্কে সহজ করে বলুন।
মোহিত কামাল: কগনিশন শব্দের যৌক্তিক বাংলা করা অসম্ভব। ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানো যায়। তারপরও একটা বাংলা শব্দ প্রচলিত আছে- অবহিতি। যা চারপাশ সম্পর্কে অবহিতি জাগায়; বলতে চাচ্ছি- একটা বোধ জেগে ওঠে। অর্থাৎ আমাদের চারপাশ সম্পর্কে একটা বোধ জাগে যাকে বলা হয় পারসেপশন। মনের জানালা আছে। ঘরের যেমন জানালা আছে তেমন। এই জানালা হলো পঞ্চ ইন্দ্রিয়।
উৎপল দত্ত: মনের জানালার কাজ আসলে কী- একটু খোলামেলা করে জানাবেন?
মোহিত কামাল: মনের জানালা বা ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্কে তথ্য যায়। আমরা প্রত্যক্ষ করি। ইংরেজিতে বলি পারসেপশন। প্রত্যক্ষণ। যদি ক্রিয়াপদে বলি তবে হয় প্রত্যক্ষ করা। এভাবে আমাদের মধ্যে বোধ তৈরি হয়। এই বোধের ইউটিলাইজেশন হয়। আমার মোটিভেশনাল ফোর্স, আমার উৎসাহ , আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা তৈরি করে। এটা বিশ্বাস তৈরি করে। রিজয়নিং করার ক্ষমতা তৈরি করে। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা তৈরি করে। আমার চিন্তন জগত আলোড়িত করে। চিন্তন জগতে আলোড়ন উঠলে আমরা ডিসিশন বা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ার সমষ্টিই হলো কগনিশন।
উৎপল দত্ত: মানসিক প্রক্রিয়া আসলে কেমন করে কাজ করে?
মোহিত কামাল: মেন্টাল প্রসেসের কথা আমার বলি, ধরুন একটা দশ তলা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। একাধিক পিলার আছে তার। মনের স্বাস্থ্যে তেমন একাধিক পিলার আছে। তার একটা হলো পারসেপশন। তারপর মোটিভেশন, বাংলায় প্রেষণা। তারপর আসে ইমোশন। আবেগ। এভাবে আসে মেমরি। থিংকিং প্রসেস। এ সব অনুষঙ্গ মিলে আমাদের অ্যাটিচুড, বিলিভ, স্বপ্ন সব কিছু মিলে বোধ জাগে। আমরা চারপাশ সম্পর্কে অবহিত হই। চারপাশ সম্পর্কে আমরা জেনে যাই।
উৎপল দত্ত: অবহিতি কেমন করে কাজ করে?
মোহিত কামাল: এই যে আমরা বলি ‘চোখ কান খোলা রেখে চলো’। প্রবাদের মধ্যে আছে- এটা বিজ্ঞান। ‘মনোযোগ দিয়ে শেখো’- এ রকমও বলি। যখন মনোযোগ দেবো কোনো বিষয়ে তখন মনে রাখতে হবে মনোযোগ মানে হচ্ছে ফোকাস ইন দ্যা মাইন্ড। আরেকটি হচ্ছে অ্যাটেনশন। অ্যাটেনশন হচ্ছে ফোকাস ইন দ্যা মাইন্ড ইন দ্যা টাস্ক ইন দ্যা হ্যান্ড। এই যে ফোকাস, এটা হলো মনোযোগ। আর কনসেন্ট্রশন হলো সাস্টেইনিং অ্যাটেনশন। অর্থাৎ মনোযোগকে আমরা কতোটা ধরে রাখতে পারি। আমরা আমাদের কাজের মধ্যে মনকে কতোক্ষণ ধরে রাখতে পারি। অ্যাটেনশন এবং কনসেন্ট্রশন- এ দুটোই ভাইটাল পিলার। অ্যাটেনশন, কনসেন্ট্রশন সব মিলিয়ে আমরা চারপাশকে জানতে পারি। কিছু কিছু কগনিশন নেগেটিভ হয়। কিছু কিছু আবার পজিটিভ। ‘না আমার দ্বারা কিছু হবে না’- এটা নেগেটিভ কগনিশন। ‘না আমি তো অনেক কিছু করেছি। আই ক্যান ডু। আই হ্যাভ আ্যবিলিটি টু ডু’- এটা হলো পজিটিভ কগনিশন।
উৎপল দত্ত: সাহিত্যে কগনিশন বা অবহিতি কীভাবে কাজ করে?
মোহিত কামাল: হ্যাঁ, এবার সাহিত্য বা বিশ্বসাহিত্যের কথায় আসি। কী হয় সেখানে? এই কগনিশন বিশ্বসাহিত্যে ব্যবহৃত হয়েছে। পজিটিভ ও নেগিটিভ কগনিশন ব্যবহার করেই সেখানে চরিত্র ও পরিবেশ-প্রতিবেশ নির্মিত হয়েছে। বলে রাখা ভালো তারা যে সাইকোলজি পড়েই সেটা করেছেন তা কিন্তু নয়। লেখক এক অর্থে অন্তর্যামী, পাঠকের মন, জীবন এবং আবহমান জীবনধারা সে তার নিজের মধ্যে ধারণ করে। মনের আলোকে কথাসাহিত্যে তিনি তা ছড়িয়ে দেন।
উৎপল দত্ত: কথাসাহিত্য নিয়ে আপনি যখন কাজ করছেন মন অথবা মনস্তত্ত্বের অপরিবর্তনীয় উপাদানগুলি আপনি কী করে প্রত্যক্ষ এবং ব্যাখ্যা করেছেন?
মোহিত কামাল: আমার ক্ষেত্রে যা হয়েছে আমি কথাসাহিত্য চর্চা করছি। পেশাগতভাবে আমি একজন মনোবিশ্লেষক। আমি এই দুই ধারাকে ধরার চেষ্টা করেছি, আবিষ্কার করতে চেয়েছি। কিন্তু লেখার সময় প্রত্যক্ষভাবে সাইকোলজি ব্যবহার করিনি, আরোপ করিনি। হয়ে গেছে। ওটা মন থেকে এসেছে। মনস্তত্ত্ব বা মনস্তত্বের থিয়োরি নয়- মন, ইতিবাচক মন, মানুষের মানসলোক আলোকিত করার অদ্ভুত তাড়না- এ সবই আমার ভেতর আমার অন্তর্জগতে নিয়ত ক্রিয়াশীল থেকেছে।
উৎপল দত্ত: আপনার নিজের সৃষ্টিকর্ম থেকে উদাহরণ দেবেন যেন বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়?
মোহিত কামাল: যেমন ‘কার্তিকে বসন্ত’ আমার উপন্যাস। এই উপন্যাসে দেখা যায় কগনিশন ইতিবাচক হলে কীভাবে চারপাশ ঝলমল করে ওঠে। উপন্যাসটির পরিপ্রেক্ষিত দুর্দশাগ্রস্থ একটি গ্রামীণ জনপদ। মঙ্গাকাল। তবু সবুজ প্রকৃতির ডাক আছে সেখানে। একদল মেয়ে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। বিয়েবিচ্ছেদ, বাল্যবিবাহ, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া- এ সবের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে। তাদের সংগ্রামী চেতনা একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর জন্ম দেয়। মঙ্গাপীড়িত জীবন থেকে বেরিয়ে এসে আলোর দিকে তাদের যাত্রা শুরু হয়। একটা নেতিবাচক কগনিশন ইতিবাচক হয়ে ওঠে। আগে ছিলো দুঃখ-দুর্দশা। পরে দেখা গেল সংগ্রামী চেতনা। একাতাবদ্ধ হওয়া। এখানে হিউম্যানিজম এসেছে- মানবিক দিকটা এসেছে। দুষ্টচক্র পিছু হঠেছে। কার্তিকে বসন্তের খোলা হাওয়া বইছে। এই কগনিশন সামাজিক। এই কগনিশন মনস্তত্ত্বের থিয়োরির একটি অংশ। কিন্তু সাহিত্যে তার ব্যবহার ও প্রয়োগ অন্যরকম। থিয়োরির মতো নয়। উপরন্তু তা ব্যক্তি, সমাজ, পরিবেশ ও জীবনসংলগ্ন।
উৎপল দত্ত: বাংলা সাহিত্যে মনের এই ক্রিয়াশীলতা নিয়ে বলুন।
মোহিত কামাল: রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য নিয়ে কিছু বলা ‘হ্যামলেট উইদাউট প্রিন্স অব ডেনমার্ক’ কথাটির মতো। তাকে নিয়েই বলি। রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ গল্পে ‘পাড়াবেড়ানি’ মৃন্ময়ীর কথা বলা হয়েছে। আর অপূর্ব শহর থেকে আসা কেতাদুরস্ত শিক্ষিত ছেলে। তাকে দেখে মৃন্ময়ী খিলখিল করে হাসে। অপূর্ব তার প্রেমে পড়ে। মৃন্ময়ীকে দেখার সাথে সাথে তার মস্তিষ্কে একটা রসায়ন ঘটে গেছে। এই প্রজন্ম হলে বলতো ‘ক্রাশ খায়’। হ্যাঁ আমি সেরকমই বলবো। কিন্ত এটা আসলে কেমিক্যাল অ্যাফিলিয়েশন। দেখার সাথে সাথেই প্রেম- লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।
উৎপল দত্ত: আপনি কী করে দেখছেন মৃন্ময়ীর পরিবর্তনকে সাহিত্য ও বিজ্ঞান উভয় দিক থেকেই।
মোহিত কামাল: গল্পের পুরোটা জুড়ে আমি দেখি যে একটা কগনিটিভ চেঞ্জ হয়েছে মেয়েটার। আবেগ থেকে তার বুদ্ধির জগতে উত্তোরণ, চিন্তার জগতে পরিবর্তন এসেছে। রবীন্দ্রনাথ জীবনের বোধ থেকে সেটা করেছেন। সুতারং আমরা রবীন্দ্রসাহিত্যের মধ্যেও মনস্তত্ত্ব দেখতে পাই। আবেগ, কগনিশন এগুলো মনস্তত্ত্বের বিষয়। আবেগ ছাড়া কোনো সাহিত্য রচনা হবে না। কেউ বলতে পারে আবেগ সস্তা। আসলে তা নয়। আবেগ কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি।
পোস্টমাস্টার গল্পে রয়েছে একটি দর্শন নিয়ে আবেগের ব্যবহার। আমি ছোট বেলায় পড়ে হু হু করে কেঁদেছি। রতনের আবেগকে পাঠকমনে ছড়িয়ে দিতে না পাড়লে গল্পের দর্শন ব্যাখ্যা করা যেত না। এ আবেগ চিরন্তন। পোস্টমাস্টার বাবুটি চলে যাবার পরও রতন ‘বাবুটি ফিরবেন’ এ রকম একটি বিশ্বাস নিয়ে বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রতন তখন বালিকা রতন নয়। একশ বছর পরও এই জীবনঘনিষ্ঠ আবেগের গুরত্ব থাকবে- মাানুষ কাদবে, রতনের ব্যথার সহযাত্রী হবে। কারণ এ আবেগ, এ বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি চিরকালের। এ কষ্ট, যন্ত্রণা, এ আবেগ কতোটা শৈল্পিকভাবে রবীন্দ্রনাথ উপস্থাপন করেছেন দেখুন! আ্যখ্যানের মধ্যে, চরিত্রের মধ্যে শিল্পরীতি মেনেই মনস্তত্ত্বের ব্যবহার রয়েছে। এটা কালজয়ী। এই আবেগের পরিবর্তন নেই। আবেগের প্রকাশভঙ্গীর মধ্যে পরিবর্তন হতে পারে। আবেগ যখন আমাদের স্পর্শ করে, তাড়িয়ে বেড়ায় জীবনের সাথে সংলগ্ন থেকে তখন তা হয়ে যায় শিল্পকর্ম। এভাবে মনস্তত্ব ব্যবহার করেই সাহিত্যে সৃজনশীলতা তৈরি হয়।
উৎপল দত্ত: তাহলে কী আপনি বলবেন সাহিত্যকর্মে মনস্তত্ত্ব অনেক সক্রিয় ও সফলভাবে কাজ করে?
মোহিত কামাল: হ্যাঁ। এ দুটি ইন্টার কানেক্টেড। বিশ্বসাহিত্যে এভাবেই মনস্তত্ত্ব এসেছে।
উৎপল দত্ত: বিশ্বসাহিত্যে মন বা মনস্তত্ত্বের উপস্থিতি এবং তার ক্রিয়াকৌশল আমরা কেমন করে দেখতে পাই?
মোহিত কামাল: বিশ্বসাহিত্যে এর ব্যবহার রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা’র কথা আমি বিশেষ করে বলবো। এখানে যৌনতা আর ভালোবাসার পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেখানো হয়েছে। ভালোবাসা আর যৌনতা এক নয়। অনেকের সাথেই ফ্লুরেন্তিনো আরিজা বিছানায় যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার ভালোবাসা পুষে রাখে ফারমিন দাজার জন্য। মার্কেস যেটা দেখিয়েছেন আরিজা যখন প্রথম দাজাকে দেখে তার মধ্যে একটি চৌম্বকীয় টান তৈরি হয়। পঞ্চাশ বছর পরও এই চৌম্বকীয় টান বেঁচে থাকে। ফাারমিন দাজার স্বামীর মৃত্যুর পর ফ্লুরেন্তিনো আরিজা জাহাজে করে দাজার কাছে হাজির হয়। এটা ভালোবাসার অনন্য দর্শন। ট্রু লাভ। এই ট্রু লাভকে মার্কেস শিল্পসম্মত করে দেখিয়েছেন। এ জন্য বিশ্বসাহিত্যে এটা গৃহীত হয়েছে।
উৎপল দত্ত: আমারা জানি, ফ্লুরেন্তিনো আরিজা পঞ্চাশ বছরের ব্যাপ্তিকালে নিজেকে যৌনতা থেকে বিরত রাখেনি। তবু সে ফারমিন দাজার কাছে নিজের ‘কৌমার্য হানি’ হয়নি বলে দাবি করে।
মোহিত কামাল: হ্যাঁ। গাব্রিয়েল গর্সিয়া মার্কেস ‘ভালোবাসা’কে অমরত্ব দিয়েছেন, স্থুল যৌনতাকে নয়। যৌনতা অন্ধকারে তলিয়ে যায় ভালোবাসার উদ্ভাসের কাছে। মন, মনস্তত্ত্ব, দর্শন ও শিল্পকৌশল- সব দিক থেকেই এই ‘ভালোবাসা’ স্বীকৃত এবং অনন্য।
উৎপল দত্ত: ‘লাভ ইন দ্যা টাইম অব কলেরা’ ঠুনকো যৌনতা থেকে ভালোবাসার স্বাতন্ত্র্য এবং তার অতলস্পর্শী গভীরতা। উল্টো পিঠে যদি দেখি ‘ক্রাশ খাওয়া’ ‘ব্রেক আপ’ ‘নেগেটিভ ইমোশন’ এ প্রজন্মকে মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার প্রবণতার দিকে ঠেলছে। এ থেকে মুক্তির উপায় কী? আপনার সাহিত্যে কি আপনি এটি দেখিয়েছেন?
মোহিত কামাল: সাহিত্যে চরিত্র সৃষ্টির মাধ্যমে তা দেখানো যায়। আমি তা করেছি। পরিস্থিতির ইতিবাচক মূল্যায়ন জীবনে সাফল্য আর আনন্দ সংযোগ করে। নেতিবচক মূল্যায়ন ধ্বংসকে আমন্ত্রণ জানায়। আমি তা দেখিয়েছি। বিজ্ঞান আর মনকে আমি আলাদা করতে পারি না। মন সাহিত্যের ভেতর একটি প্রাণ-রসায়ন এবং প্রাণকেন্দ্র। আমি যা চিন্তা করছি, আমি যেভাবে রিজয়নিং করছি, কল্পনা করছি, আমার চরিত্র নির্মাণ করছি, পরিবেশের বর্ণনা দিচ্ছি- হয়তো সব সময় তা আমি দেখছি না- এটা আমার মেধার অঙ্গ। এই মেধা আমার মনের অঙ্গ। এই মন আমি ব্যবহার করি লেখার জন্য, আমার সাহিত্যকর্মে। আমি আমার কিছু সাহিত্যকর্মে দেখিয়েছি- আমি যদি বলি, এই ছেলে মাদক নিয়ো না। আমার কথা সে শুনবে না। তার পরিবর্তে আমি এটা বলার চেষ্ট করেছি- মাদক কীভাবে জীবনকে তছনছ করে। সাহিত্যপাঠের মধ্য দিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ সে ধরতে পারে। বলা যায়, তার কাছে উন্মোচিত হয়ে যায়। তখন সেটা কাজ করে। অর্থাৎ সাহিত্যকর্মে মনস্তত্ত্বের এই উপস্থাপন তার মনে অন্যরকম কগনিশন তৈরি করে।
উৎপল দত্ত: আজকের অভিভাবকরা চিন্তিত এবং সংশয়গ্রস্ত সন্তানদের নিয়ে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের এই যুগে সব কিছুই আশাতীত দ্রুত লয়ে বদলে যাচ্ছে। অভিভাবকদের প্রতি আপনার বার্তা কী?
মোহিত কামাল: খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমি বলবো, সাহিত্যকর্মে ধ্বংসের উপাদানগুলো দেখানো হয়। জীবনসংলগ্ন হওয়ার অনিবার্য সূত্রগুলো দেখানো হয়। প্রবৃত্তিকে আমি যদি নৈতিক মূল্যবোধ দিয়ে শাসন করতে না পারি তাহলে জীবনের উঠোনে পিছলে পড়ার ঝুঁকি প্রতি মুহূর্তে থাকে। একটি ছেলে একটি মেয়েকে দেখলো, ভালো লাগলো, অথচ ভালোবাসার পরিবর্তে সে ধর্ষকামী হয়ে উঠলো। প্রতিদিন প্রচুর মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। কারণ ছেলেরা নৈতিক সত্তা নিয়ে বড় হচ্ছে না, তারা ভোগবাদী সত্তা নিয়ে বেড়ে উঠছে। প্রযুক্তি, ওয়েব থেকে যারা ভোগবাদী হওয়ার শিক্ষা নিচ্ছে তাদের কাছে ভালোবাসা আশা করা যায় না। অথচ আমরা এ প্রশ্ন নিজেদের করছি না- আমার সন্তান কেন ভোগবাদী হবে? এটা সমাজের দুষ্ট ক্ষত। মহান সাহিত্যকর্মে আমি দেখেছি, এই মুহূর্তে সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছি না, সমাজকে কীভাবে এই দুষ্ট ক্ষত থেকে বদলানো যায় তার চিত্র ও সম্ভবনার ইতিবাচক দিক আছে। তবে মনোচিকিৎসক হিসেবে আমরা একটা ‘সেট লিমিট’ করে দেই।
উৎপল দত্ত: ‘সেট লিমিট’ প্রসঙ্গে বলুন।
মোহিত কামাল: সেট লিমিট হলো, এটা বলা যে তুমি একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের মধ্যে যুক্ত হবে। যেমন তুমি একটি মোবাইল ফোন পাচ্ছ কিন্তু তুমি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেটা ব্যবহার করবে। এখন বিশ্বের অনেক দেশেই কিছু অ্যাপস আছে যা শিশুদের উপযোগী। ওই অ্যাপস ইনস্টল করে দিলে শিশুরা ক্ষতিকর ওয়েবসাইটে ঢুকতে পারে না। আমরা যদি পারি তবে সেটা আমাদের করা উচিত। তাদের মনোজগতে মোরাল বা নৈতিক সত্তার আধিপত্য থাকতে হবে। এই মুহূর্তে তা খুব জরুরি। একটা অনুশাসনের বৃত্তে শিশুদের নিয়ে আসা উচিত। আর সেট লিমিট শিশুকাল থেকেই আরোপ করতে হয়।
তারা//