ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

অনুবাদ গল্প

ভুলে যাওয়া নাম

অনিকেত সুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৩:২৫, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩
ভুলে যাওয়া নাম

রাভিনো আদর্শ ব্যাংক কর্মচারী। গত দশ বছর ধরে একই ব্যাংকে কর্মরত। ঋণ আদায়ে ওর দক্ষতার কোনও জুড়ি নেই। যথাসময়ে ও যথানিয়মে ঋণের কিস্তি আদায় আর এ সংক্রান্ত হিসাবপত্র ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখার মাধ্যমে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজন কর্মচারী হিসেবে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছে রাভিনো। লোন সেকশনেও সে কর্তব্যপরায়ণতা আর সাফল্যের সেরা উদাহরণ। 

রাভিনো একা থাকতে ভালোবাসে। সযত্নে এড়িয়ে চলে নতুন পরিচিত লোকদের। ক্যাফে-ক্যাসিনোতে কখনও যায় না। এমনকি কোনও মেয়ের সাথেও ওর ভালোবাসার সম্পর্ক নেই। আর এরকম জীবনেই ওকে বেশ তৃপ্ত, সুখী বলে মনে হয়। 

‘প্রতিদিন এতোগুলো টাকা নিজ হাতে নাড়াচাড়া করছ। কোনও প্রলোভন জাগে না তোমার মনে?’ এরকম কথা কেউ যদি বলে তো রাভিনো নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেয়, ‘যে-টাকা আমার নয়, তা আমি টাকা হিসাবে গণ্য করি না।’

একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঋণের টাকা আদায় করল ও। কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরল না। যারা ওকে চিনত, তাদের কারও মনে এ রকম সন্দেহ উঁকি দেয়নি- রাভিনো অন্যায় কিছু করতে পারে। ভাবল সবাই, নির্ঘাত কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে। 

পুলিশি তদন্তে দেখা গেল, বিকাল তিনটা পর্যন্ত আদায়-করা কিস্তির টাকাগুলো ও যথাসময়ে জমা দিয়েছে। সন্ধ্যা সাতটায় আদায় করেছে শেষ কিস্তিটা। ঐ সময়ে ওর কাছে ছিল দুই লক্ষ ফ্রাঙ্ক। এরপর থেকেই ওর কোনও হদিস মিলছে না। আশপাশের সব জায়গা ওরা চষে বেড়াল। সবখানে টেলিগ্রাফ করল। সীমান্ত অঞ্চলের সব পুলিশ স্টেশনে খবর পাঠাল। সবশেষে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো, রাভিনোর কাছ থেকে টাকা লুটে নেওয়া হয়েছে এবং ওকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়েছে নদীতে। আর ঘটনা ঘটিয়েছে পেশাদার কোনও দুর্বৃত্তের দল।

শুধু একজন লোক প্যারিসে বসে সংবাদপত্রে এই খবর পড়তে গিয়ে আপন মনে হাসল। যখন পুলিশের  গোয়েন্দা কুকুর হন্যে হয়ে ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, ঠিক সেই সময় সীন নদীর উপরকার একটা সেতুর খিলানের নিচে দাঁড়িয়ে অফিসের ইউনিফর্ম খুলে লোকটা পরে নিচ্ছিল ওর আটপৌরে দৈনন্দিন ব্যবহার্য একটা পোশাক, যা আগের রাতে সেখানে রেখে গিয়েছিল ও। পোশাক পাল্টে পকেটে ভরে নিল দু’লক্ষ ফ্রাঙ্ক। ইউনিফর্ম আর কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ, এ দুটোকে পুঁটুলির মতো বানিয়ে পাথরের সাথে বেঁধে ফেলে দিল নদীর মধ্যে। ফিরে এলো প্যারিসে। সাফল্যের তৃপ্তি ওর দু’চোখে এনে দিল গাঢ় ঘুম। এভাবে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে রাভিনো একজন পাকা চোরে পরিণত হয়ে গেল! 

ট্রেনে সীমান্ত পার হবার চেষ্টা করতে পারত ও। কিন্তু বুদ্ধিমান রাভিনো তা করল না। কারণ ও জানত, পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়া সহজ কাজ নয়; ওরা ওকে নিশ্চয়ই গ্রেফতার করবে। অতএব, মনে মনে অন্য এক ফন্দি আঁটল ও। দিনের আলো যখন ফুটল, টাকাগুলি একটা খামের ভিতর পুরে সীল করে দিল। হাজির হলো গিয়ে এক আইনজীবীর কাছে। 

‘মসিয়ে, এই খামে আমার কিছু মূল্যবান দলিল আছে। একটা লম্বা ভ্রমণে যাচ্ছি আমি। খামটা আপনার কাছে রেখে যেতে চাই। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?’ 
‘ঠিক আছে। একটা রশিদ দিচ্ছি আপনাকে।’ 

প্রথমে সম্মতি দিল রাভিনো। পরক্ষণেই ভাবল, রশিদটা কোথায় রাখবে, কার কাছে রাখবে। নিজের কাছে ওটা রাখা হবে বিপজ্জনক। একটু ইতস্তত করল; তারপর ধীর ও সহজ গলায় বলল, ‘মসিয়ে, পৃথিবীতে আমি সম্পূর্ণ একা। কোনও আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধুবান্ধব নেই আমার। যে দীর্ঘ ভ্রমণের পরিকল্পনা আমি করেছি, সেটা পুরোপুরি নিরাপদ নাও হতে পারে। রশিদটা হয়তো হারিয়ে যাবে বা ওটা নষ্টও হয়ে যেতে পারে। আপনি বরং ওটা আপনার নিজের ডকুমেন্টের সাথেই রেখে দিন না। আমি ফিরে এসে আপনার কাছে চাইলেই প্যাকেটটা আমাকে দিয়ে দেবেন।’
‘কিন্তু...’ 
‘রশিদের ওপর লিখে রাখুন, জিনিসটা এভাবেই দাবি করা হবে। আর এতে যদি কোনও ঝুঁকি থাকে তো সেটা আমার ওপরই ছেড়ে দিন।’ 
‘আচ্ছা, বেশ। কী নাম আপনার?’ 
আবার একটু ইতস্তত করল রাভিনো। তারপর মনগড়া একটা নাম বলল, ‘ডুভার্গার। হেনরি ডুভার্গার।’ 

রাস্তায় নেমে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল রাভিনো। ওর পরিকল্পনার প্রথম অংশটা সফল হয়েছে। ওরা এখন ওকে হাতকড়া পরাতে পারে। চুরি-করা টাকা এখন ওদের নাগালের বাইরে। শাস্তির মেয়াদ শেষে ও জমা টাকাগুলো ফেরত চাইবে। চার-পাঁচ বছর কারাবাসের পর হয়ে উঠবে যথেষ্ট অর্থের মালিক। দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঋণের কিস্তি সংগ্রহ করার চেয়ে ওটা বরং অনেক ভালো। টাকাগুলো নিয়ে ও চলে যাবে গ্রাম এলাকায়। বুড়ো বয়স পর্যন্ত সুখে-শান্তিতে কেটে যাবে দিন। গ্রামের লোকেরা ওকে চিনবে সৎ ও দানশীল মানুষ হিসাবে। কারণ, প্রাপ্ত অর্থের একটা অংশ ও পরের উপকারে ব্যয় করবে। 

কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে একটা কথাই শুধু বলল রাভিনো: ‘টাকাটার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। একটা বেঞ্চিতে বিশ্রাম নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে দেখি, টাকার ব্যাগটা আমার কাছে নেই।’ 

অতীতে ভালো কাজের রেকর্ড থাকায় রাভিনোর শাস্তির মেয়াদ হলো মাত্র পাঁচ বছর। শান্ত মনে স্থির দাঁড়িয়ে রায় শুনল ও। ভাবল, এখন ওর বয়স পঁয়ত্রিশ। চল্লিশেই ও মুক্তি পাবে আর হয়ে উঠবে দু’লক্ষ ফ্রাঙ্কের মালিক। কারাবাসটাকে ওই অর্থের বিনিময়ে একটা সামান্য ত্যাগস্বীকার হিসাবে বিবেচনা করল রাভিনো। 

জেলের ভেতর অন্য কয়েদীদের জন্য ও ছিল একটা মডেল, ঠিক যেমনটি ছিল ব্যাংক কর্মচারী হিসাবে। নিরুদ্বেগ ও ধৈর্যশীল মনে বন্দীজীবনটা যাপন করল ও । 

অবশেষে প্রতীক্ষিত মুক্তির দিন এল। রাভিনোর মগজে শুধু একটাই কল্পনা। সেই আইনজীবীর কাছে ফিরে যাওয়া। আসন্ন সাক্ষাৎকারের দৃশ্য ভাসছিল ওর চোখে। এতদিন পর ভদ্রলোক কি ওকে চিনতে পারবেন? পাঁচ বছরের কারাজীবনের অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই ছাপ ফেলেছে ওর চেহারায়। নাহ্! ভদ্রলোক চিনতে পারবেন না। দৃশ্যটা কল্পনা করে নিজের মনে হাসল রাভিনো। 

‘আপনার জন্য কী করতে পারি, মসিয়ে?’ 
‘পাঁচ বছর আগে একটা খাম জমা রেখেছিলাম আপনার কাছে। ওটা ফিরিয়ে নিতে এলাম।’
 ‘কোন খাম? কী নামে?’
‘নামটা হল, মসিয়ে...’ 

হঠাৎ থমকে গেল রাভিনো। কী নামে খামটা জমা করেছিল, মনে পড়ছে না ওর। মগজের ভেতর চষে বেড়াতে লাগল। কিন্তু কোনও নাম মনে পড়ল না। মাথাটা কেমন খালি খালি লাগছে। ধপাস করে বসে পড়ল একটা বেঞ্চিতে। স্মৃতি যেন বিদ্রোহ করছে ওর সাথে। 
‘কী যেন...কী যেন নামটা? কোন অক্ষর দিয়ে শুরু...?’ 

এক ঘণ্টা পর্যন্ত ও বসে রইল বেঞ্চিতে। পাগলের মতো স্মৃতি হাতড়াতে লাগল। কোনও কূল-কিনার পেল না। সময় পেরিয়ে যেতে লাগল। নামটা যেন ওর সামনে-পেছনে, চারপাশে নেচে চলেছে। অক্ষরগুলি লাফিয়ে উঠছে, আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। কোনওভাবেই জোড়া দিতে পারছে না। হঠাৎ মনে হল, পেয়ে গেছে!... ওই তো ভাসছে ওর চোখের সামনে, চলে এসেছে ঠোঁটের ডগায়...এই তো...হ্যাঁ...কিন্তু নাহ্! আবার মিলিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য কোনও তাণ্ডবে। 

শুরুতে একধরনের অস্বস্তি হচ্ছিল। এখন সেটা তীব্র তীক্ষ্ণ প্রায়-শারীরিক একটা যন্ত্রণায় রূপ নিয়েছে। যেন চিরে ফেলছে, দ্বিখণ্ডিত করে দিচ্ছে ওর সমগ্র সত্তা। শিরদাঁড়া বেয়ে তপ্ত একটা স্রোতের ওঠা-নামা টের পেল ও। পেশীগুলি সংকুচিত হয়ে উঠছে। স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না। কাঁপতে শুরু করেছে হাতগুলি। শুকনো ঠোঁটজোড়া কামড়াতে লাগল রাভিনো। ভেতর থেকে ফেনিয়ে ওঠা ক্রন্দন, আর্তনাদ, সেইসাথে পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝবার একটা মরিয়া চেষ্টা, এ দুইয়ের দ্বৈরথে ভয়ঙ্কর দুলতে লাগল। ভুলে যাওয়া নামটা যতই স্মরণে আনার চেষ্টা করল, ততই ঘোলাটে হয়ে ওঠল ওর স্মৃতি। শেষে মাটিতে সজোর পা ঠুকে ও উঠে দাঁড়াল। চিৎকার ক’রে বলে ওঠল, ‘দুশ্চিন্তা ক’রে কী লাভ! ভাবনা ছেড়ে দিলাম। সব ঠিক হয়ে যাবে বিলকুল।’ 

কিন্তু বৃথাই প্রবোধ দিল নিজেকে। পথচারীদের মুখের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে চাইল। রাস্তার পাশের দোকানগুলির সামনে থেমে দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনল দোকানের জানালায়। জনকোলাহলে কান পাতল। কোনও দৃশ্য বা ধ্বনি তবু ওর চোখ-কানের ভাণ-করা অর্থহীন একাগ্রতাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। মগজের ভেতর ঘুরেফিরে উচ্চারিত হতে লাগল একই প্রশ্ন, ‘মসিয়ে...? মসিয়ে...?’ 

রাত এল। ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে উঠতে লাগল শহরের রাস্তা। ক্লান্ত, বিপর্যস্ত রাভিনো একটা হোটেলে গিয়ে ওঠল আর পোশাক বদল না করেই ধুপ করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। কিন্তু ঘুম এল না। একটানা চার ঘণ্টা জেগে রইল আর সারাক্ষণ মনে করার চেষ্টা করল নামটা। ভোরের দিকে ঘুম নেমে এল চোখে। সকাল গড়িয়ে যখন প্রায় দুপুর, তখন ঘুম থেকে জাগল। আড়মোড়া ভাঙল সহজ আয়েশী ভঙ্গিতে। কিন্তু ভেতরে আবার ঘুরপাক খেয়ে চলল একই নাছোড় চিন্তা, একই প্রশ্ন, ‘মসিয়ে...? মসিয়ে...?’ 
মনের যন্ত্রণা ছাপিয়ে এবার একটা ভয়ের বোধ, একটা ঘন শঙ্কা জেগে ওঠল ওর মধ্যে। হয়ত আর কোনও দিন ওই নাম মনে করতে পারবে না। কখনও না। হোটেল ছেড়ে রাস্তায় নামল। উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেড়াল কয়েক ঘণ্টা। আইনজীবীর অফিসের আশপাশে ঘুরঘুর করল অনেকক্ষণ। 

রাত এল দ্বিতীয়বারের মতো। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে গুঙিয়ে উঠল রাভিনো, ‘ওহ্! পাগল হয়ে যাব আমি!’ 

একটা ভয়ানক মরণ ভাবনা ওর ভেতরটাকে গুঁড়িয়ে দিল। দু’লক্ষ ফ্রাঙ্ক আছে ওর। হ্যাঁ, দু’লক্ষ ফ্রাঙ্ক। অসৎ উপায়ে পাওয়া যদিও, তবু সেটা ওরই। অথচ তা এখন ওর নাগালের বাইরে। ওই অর্থের মালিক হতে ও পাঁচ পাঁচটি বছর কারাগারে কাটিয়েছে! কিন্তু সেগুলো এখন আর ছুঁতে পারবে না। 

নোটগুলো অপেক্ষা করছে ওর জন্য। কিন্তু শুধু একটা নাম, দুটো কেবল শব্দ একটা অলঙ্ঘ্য দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু’য়ের মাঝখানে। হাত মুঠো পাকিয়ে ও সজোর ঘুষি ঠুকল নিজের মাথায়। ওর বোধবুদ্ধি, চিন্তাশক্তি কি লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে? মাতালের ভঙ্গিতে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ধাক্কা খেল রাভিনো। হোঁচট খেল ফুটপাতে। এখন আর আচ্ছন্নতা বা যন্ত্রণা নয়, একটা প্রবল ভয়াবহ আতঙ্ক পেয়ে বসেছে ওকে। ওর বিশ্বাস, নামটা আর কখনও মনে করতে পারবে না। এরকম ভাবনায় হঠাৎ মনের অজান্তেই হেসে উঠল পাগলের মতো। পথচারীরা সচকিত হয়ে ওর দিকে তাকাল। ওদের দৃষ্টি থেকে নিজেকে আড়াল করতে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল রাভিনো। দৌড় লাগাল। ধাক্কা খেল পথচারীদের সাথে। রাস্তায় চলমান গাড়িগুলো ওকে চাপা দিতে পারে, এই ভয়টাও ওর মনে এল না। বরং কামনা করতে লাগল, দ্রুত ধাবমান কোনও গাড়ি ওকে চাপা দিক। গুঁড়িয়ে দিক ওর অস্তিত্ব। এই উন্মত্ততার মধ্যেই ওর ভেতর একই জিজ্ঞাসা বার বার আবর্তিত হতে লাগল, ‘মসিয়ে...? মসিয়ে...?’ 

রাভিনোর পায়ের কাছে প্রবাহিত হয়ে চলেছে সীন নদী। স্বচ্ছ জলের মধ্যে আকাশের উজ্জ্বল তারাগুলোর প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে ও। যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে ওঠল, ‘‘মসিয়ে...? মসিয়ে...?’...ওহ্, সেই নাম! সেই নামটা!...’ 

আরও কয়েক পা এগিয়ে ও নেমে এল নদীর কিনারে। তেতে-ওঠা মুখ জুড়িয়ে নিতে উবু হল জলের ওপর। হাঁপাতে লাগল। শীতল জল ওকে কাছে টেনে নিল। জুড়িয়ে দিল ওর তপ্ত চোখ...কান...মাথা... 

হঠাৎ টের পেল, পা পিছলে নেমে যাচ্ছে ও নিচের দিকে। কিন্তু খাড়া পাড়ে ভারসাম্য রাখতে পারল না। পড়ে গেল। কনকনে জল যেন ওর শরীরের চামড়া ভেদ করে সেঁধিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। হিম করে দিচ্ছে হাড়। লড়তে চাইল রাভিনো। সজোরে দু’হাত ছুঁড়ে মাথাটা বাড়াল জলের ওপরে। আবার নিচে নেমে গেল। আবার জলের ওপর ভসে উঠল মাথা- চোখ দুটো খোলা, বিস্ফারিত! হিমে অবশ শরীর নিয়েই মরিয়া হয়ে চেঁচাল হঠাৎ, ‘পেয়েছি!...ডুভার্গার!...হেল্প!...ডুভা!...’

নির্জন ঘাটের কাছে সেতুর পিলারগুলোতে বাড়ি খেয়ে মৃদু আওয়াজ তুলছে প্রবহমান জল। সেতুর গুরুগম্ভীর খিলানে, নৈঃশব্দের বুকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরল সেই নাম, ডুভার্গার!...ডুভা!...ডুভা!... 

সীন নদীর বুকে ঢেউ অলস ভঙ্গিতে উঠছে আর নামছে। তীরের কাছে এসে দুর্বল হয়ে পড়া ছোট্ট ঢেউগুলির পেছন পেছন আসছে আরও বড় ঢেউ; তীরে এসে সেগুলোও দুর্বল হয়ে পড়ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে। 

আর সবকিছুই স্থির, প্রশান্ত...

ফরাসি নাট্যকার ও ছোটগল্প রচয়িতা মরিস লেভেলের জন্ম ১৮৭৫ সালের ২৯ আগস্ট। যুদ্ধ ও অপরাধ মনস্তত্ত্বের কুশলী এই কথাকারের বেশ কিছু লেখা ইতিপূর্বে চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। তাঁর প্রতিটি লেখায় রয়েছে নৈতিকতার বার্তা আর মানুষের যাবতীয় অপরাধের প্রতি ঘৃণা। কিন্তু সেই ঘৃণাকে গল্পের শরীরে এমন সূক্ষ্ম ও প্রচ্ছন্নভাবে ধরে দেন যে গল্পপাঠ শেষে পাঠকের মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়, সেই প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই একটি মহতী গল্পের সাফল্য স্বতঃস্বীকৃত হয়ে ওঠে। ১৯২৬ সালে ৫১ বছর বয়সে মরিস লেভেল মৃত্যুবরণ করেন। অনূদিত লেখাটি তাঁর বিখ্যাত The Debt Collector গল্পের ভাষান্তর। 

তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়