ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

প্রতিবন্ধী রিপনের টিকে থাকার সংগ্রাম 

মহাসিন আলী, মেহেরপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪২, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১১:৪৬, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রতিবন্ধী রিপনের টিকে থাকার সংগ্রাম 

‘সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করিনি। প্রতিবন্ধী হয়েও ভিক্ষাবৃত্তিও ছেড়েছি। রোদ-তাপ, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ব্যাটারিচালিত রিকশায় শহর থেকে গ্রামগঞ্জে হকারি করে চলেছি। সামান্য আয়ে কোনোরকমে সংসার চলে। শহরের ভাড়া বাড়িতে থাকি একমাত্র সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করার আশায়। তবে শঙ্কায় থাকি- এই অসাধ্য সাধন করতে পারবো তো?’ 

সম্প্রতি মেহেরপুর শহরের কলেজ মোড় এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু জিনিস ফেরি করে বিক্রি করার সময় কথাগুলো বলেছিলেন রিপন।

রিপনের বয়স ৩৫ বছর। নয় বছর বয়সে তিনি জ্বরে পড়েন। চিকিৎসায় জ্বর ভালো হলেও আস্তে আস্তে তার দুই হাত আর দুই পা অবশ হতে থাকে। মেহেরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র রিপন অসুস্থ হতে থাকায় সেখান থেকে ৭ম শ্রেণির ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ির কাছে শহরের কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু বিধিবাম। এরপর আর বেশিদূর এগোয়নি রিপনের শিক্ষা। এখন অবশ পা নিয়ে রিপন একা একা চলাফেরা করতে পারেন না। 

সামান্য আয়ের রিপনের বিয়ে হয় মেহেরপুর সদর উপজেলার ঝাউবাড়িয়া গ্রামের মফিজুল ইসলামের মেয়ে রুনার সঙ্গে। এক সময় রুনার কোল জুড়ে আসে ছেলে সন্তান। নাম রাখা হয় রাফিউল ইসলাম রাব্বি। মা-বাবা আর দাদির আদরে বড় হতে থাকে রাব্বি। তবে মায়ের আদর রাব্বির বেশি দিন জোটেনি। প্রায় ১০ বছর আগে রাব্বির ৩ বছর বয়সে তাকে ছেড়ে চলে যায় মা রুনা। এরপর আর বাব্বির খোঁজ নেননি তার মা। 

রিপনের মা কুলসুম বেগম বলেন, তিনি মেহেরপুর শহরের নতুন পোস্ট অফিসপাড়ার জাফর আলী শেখের মেয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তার বাবা শহীদ হন। পরে তিনি চাচা খলিল শেখের কাছে থেকে বড় হন। 

কুলসুম বেগম আরও বলেন, মেহেরপুর গাংনী উপজেলার আকুবপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ছেলে রিপনের জন্মের ৬ মাস পর আব্দুর রহমান দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এরপর মা-ছেলে বাড়ি ছেড়ে মেহেরপুরে চলে আসেন। আর আব্দুর রহমান বহু বিয়ে করতে থাকেন। তাই আর আব্দুর রহমানের সংসারে ফিরে যাওয়া হয়নি কুলসুম বেগমের। এরপর রিপনকে কোলে নিয়ে মেহেরপুর শহরের গোরস্থানপাড়ায় চাচার বাড়ি চলে আসেন কুলসুম। চাচা খলিল শেখের বাড়ি থেকে শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। তিনি কখনও মেহেরপুর সরকারি কলেজে, কখনও মেহেরপুর তুলা উন্নয়ন অফিসে মাস্টার রোলে আয়ার কাজ করেছেন।

কুলসুম বেগম আরও বলেন, সবাইকে হারিয়ে এই বয়সে প্রতিবন্ধী ছেলে ও একমাত্র নাতিকে নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। রিপন তিন মাস পরপর ২২৫০ টাকা করে প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। গত ছয় মাসেও তা পায়নি। নাতি রাব্বিকে ভালো খাবার, জামা-কাপড় দিতে পারেন না। কুলসুমের চিন্তা হয় তার অবর্তমানে ছেলে-নাতিকে কে দেখবে?

প্রতিবেশি মেহেরপুর দারুল উলুম আহমদিয়া ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষক মোস্তাফিজুর রহমান (বাবু) বলেন, গত বছরও রিপন বাসে বাসে চড়ে ভিক্ষা করতেন। এখন শহরে ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে ইদুর, ছারপোকা, তেলাপোকা, পিঁপড়া মারার ওষুধ, দাঁতের মাজন, লেন কাটার, সুঁচ, দাঁতের খিলন, টাইগার বাম ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করেন। প্রচার ও ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে সঙ্গে রয়েছে লাউড স্পিকার। 

রাব্বি শহরের মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পিইসি পাস করে বর্তমানে কবি নজরুল শিক্ষা মঞ্জিল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। রাব্বি জানায়, মাকে তার মনে পড়ে না। মা তাকে কোনোদিন খোঁজও নেইনি। রাব্বি মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে চায়।  

রিপন বলেন, সন্তান যাতে সৎ মায়ের হাতে নির্যাতনের শিকার না হয়, তাই দ্বিতীয় বিয়ে করেননি। ছেলে যাতে কারো কাছে ছোট না হয়, তাই ভিক্ষাবৃত্তি ছেড়ে দিয়েছেন। সন্তানকে মানুষ করার জন্য শহর থেকে গ্রামেগঞ্জে হকারি করে বেড়াচ্ছেন। দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়। তাতেই তিনজনের পরিবারে খাওয়া-পরা চলে তার। তবে করোনা মহামারিতে আয় কমে গেছে।  

‘কেউ যদি ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব নিতো- তাহলে স্বস্তি পেতাম।’-দীঘশ্বাস ছেড়ে বলেন রিপন। 

ঢাকা/বকুল

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ