ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

প্রশাসনের উদ‌্যোগে সন্তানসহ বাড়ি ফিরলেন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সোনিয়া

নাটোর প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:১০, ৫ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ২২:১৬, ৫ এপ্রিল ২০২১
প্রশাসনের উদ‌্যোগে সন্তানসহ বাড়ি ফিরলেন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সোনিয়া

নাটোর নলডাঙ্গা উপজেলার প্রশাসনের সহযোগিতায় লকডাউনের মধ্যে বিশেষ নিরাপত্তায় ফায়ার সার্ভিসের অ্যাম্বুলেন্সে করে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী সোনিয়া খাতুন ও তার শিশু সন্তান নিরাপদে ফিরে গেলেন বাবার বাড়ি। 

সোমবার (৫ এপ্রিল) দুপুরে সোনিয়াকে বাড়ি পাঠানো হয়।

সে সময় উপস্থিত ছিলেন নলডাঙ্গা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন, নলডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. নজরুল ইসলাম, নাটোর ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা, বিসমিল্লাহ ক্লিনিকের মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন, মাধনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আতাউর রহমান প্রমুখ। 

সোনিয়াকে বুঝে নেন চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ইউএনও সাকিব আল রাব্বি। তারপর তাকে পরিবারের লোকজনের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।

ঘটনার শুরু বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল)। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ৯টা। নাটোরের মাধনগর রেলওয়ে স্টেশন প্লাটফর্মে প্রসব বেদনায় ছটফট করছিল সোনিয়া খাতুন (২০)। অসহ্য যন্ত্রনায় চিৎকার দিয়ে উঠলেও তার কাছে এগিয়ে যায়নি স্টেশন প্লাটফর্মে অবস্থানরত নারী-পুরুষদের কেউ। 

কেউ কেউ দূর থেকে তাকিয়ে দেখেছিল। কেউ কেউ কাছে গেলেও সোনিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর ব‌্যাপারে পদক্ষেপ নেয়নি। মানসিক প্রতিবন্ধী বা পাগল ভেবে কেউ তার কাছে যেতে চাচ্ছিলেন না। 

রাত তখন ১০টার কাছাকাছি। যন্ত্রণার মাত্রা আরো বেড়ে যায় সোনিয়ার। এক পর্যায়ে প্রসব বেদনায় চিৎকার-কান্নাকাটির আওয়াজে চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। 

এমন সময় এগিয়ে আসেন নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনাগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান ও স্থানীয় কিছু লোকজন। সোনিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে মানবতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে প্রমাণ করলেন মানুষ মানুষের জন্য। 

সোনিয়ার অবস্থার অবনতি দেখে তাৎক্ষনিকভাবে তাকে উদ্ধার করে নলডাঙ্গা বাজারে বিসমিল্লাহ ক্লিনিকে নিয়ে ভর্তি করেন। সেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে স্বাভাবিকভাবে তার একটি ছেলে সন্তান ভূমিষ্ট হয়। বর্তমানে মা-ছেলে দুজনই সুস্থ আছে। 

বিসমিল্লাহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নিবিড় পরিচর্যা আর আতাউর রহমানের মহানুভবতার কারণে এ যাত্রা বেঁচে গেলো সোনিয়া। এবার সন্তানের বাবার পরিচয় পেতে চায় সে।

এ নারী জানান, গত এক বছর ধরে স্বামীর সন্ধানে বহু স্থান ঘুরে বেড়িয়েছেন। খুঁজে পাননি। বাস স্ট্যান্ড, রেলওয়ে স্টেশনসহ পথে-ঘাটে স্বামীর সন্ধানে গর্ভবতী অবস্থায় ছুটে বেড়িয়েছেন। 

তিনি আরও জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর গ্রামে তার জন্ম। বাবার নাম মঞ্জু, দুই ভাই রিমন ও শিমুল। ঘরে সৎ মা। সেখানেই তারা বসবাস করেন। পরিচয়হীন ছেলেকে বিয়ে করার কারণে পরিবারের লোকজন তাকে অপছন্দ করে। তাই বাড়িও যেতে পারেনি সোনিয়া।

তার ভাষ‌্যমতে, বাবার দারিদ্রতার কারণে লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি। মা মারা যাওয়ার পর সৎ মা এলো। ঠিকমত ভাত জুটত না। পেট চালাতে ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করেন। বেশ কয়েক বছর ধরে ট্রেনে ভিক্ষা করেই চলছিল তার জীবন-জীবিকা। এরইমধ্যে ট্রেনের ভিতর কোনো একদিন অচেনা এক ছেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। প্রায় তিন বছর আগে সান্তাহার রেলওয়ে স্টেশনে ওই ছেলেটির সঙ্গে তার বিয়ে হয়। সেখানেই গড়ে ওঠে তাদের সংসার।

কিন্তু তার স্বামীর বাড়ি কোথায়, কী তার পরিচয় সে বিষয়ে কিছুই জানা হয়নি সোনিয়ার। সোনিয়া গর্ভবতী হয়ে পড়লে স্বামী তাকে ছেড়ে চলে যায়। এ অবস্থায় তার স্বামীকে প্রয়োজন। কিন্তু কোথায় পাবে স্বামীকে? তার তো কোনো ঠিকানা জানা নেই। গর্ভবতী অবস্থায় স্বামীকে খুঁজে বেড়াতে থাকে সোনিয়া। অবশেষে নাটোরের আব্দুলপুর রেলস্টেশনে আসে সে। সেখানেই থাকতে শুরু করে। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে কোনো রকমে চলছিল। দিনে দিনে তার প্রসবের সময়ও ঘনিয়ে আসে। 

এ অবস্থায় স্থানীয় একজনের পরামর্শে স্বামীকে খুঁজে বের করতে বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) বিকেলে আলী হায়দার নামে এক ভ্যান চালককে সঙ্গে নিয়ে উত্তরা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে সান্তাহারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন সোনিয়া। পথে ট্রেনের মধ‌্যে তার প্রসব বেদনা শুরু হয়। পরে নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগর রেল স্টেশনে নেমে পড়েন। সেখানেই প্রসব বেদনায় ছটফট করছিলেন। 

বিসমিল্লাহ হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. ওয়ারেছুন নাহার জেসি জানান, মা ও সন্তান দুজনই সুস্থ আছে। তবে বাচ্চাটি মায়ের বুকের দুধ একটু কম পাচ্ছে। 

ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. আতাউর রহমান বলেন, ‘মানবিক কারণে ওই মেয়েকে প্রসব বেদনায় ছটফটরত অবস্থায় বিসমিল্লাহ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হলে ইউএনও আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যার মেয়েটির সবসময় খোঁজ খবর নিয়েছেন। মেয়েটি যাতে তার ভুমিষ্ঠ শিশুটিকে নিয়ে অভিভাবকদের কাছে ভালোভাবে পৌঁছাতে পারে সে বিষয়েও পদক্ষেপ নিয়েছেন। অর্থ সহায়তাও করেছেন।’

নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, মেয়েটি যাতে তার শিশু সন্তানকে নিয়ে অভিভাবকের কাছে ভালোভাবে ফিরে যেতে পারে এবং ভালো পরিবেশে থাকতে পারে, সে ব্যাপারে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। 

স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, ক্লিনিক ও ফায়ার সার্ভিসকে মানবিক কাজে সহায়তার হাত বাড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানান নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন।

আরিফুল ইসলাম/সনি

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়