ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

অরক্ষিত বধ্যভূমি, লিপিবদ্ধ নেই গণকবরের ইতিহাস

আমিরুল ইসলাম, রংপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ১৬ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ২০:৩৩, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২
অরক্ষিত বধ্যভূমি, লিপিবদ্ধ নেই গণকবরের ইতিহাস

১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত  করে বিশ্বের বুকে জন্ম লাভ করে স্বাধীন বাংলাদেশ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণায় উদ্দীপ্ত হয়ে সে সময় দেশের অনান্য এলাকার মানুষের মতো রংপুরের মুক্তিকামী মানুষও যুদ্ধে অংশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার স্মারক হয়ে তাই আজও দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশের অসংখ্য বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রগুলো। পরবর্তীতে এসব গণকবর বা বধ্যভূমিগুলো সরকারিভাবে সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেও অনেক গণকবর এখনও অরক্ষিত অবস্থায় রয়ে গেছে। এছাড়া যেসব গণকবর-বধ্যভূমিকে স্মৃতি হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে সেসব বধ্যভূমির সঠিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ বা সংরক্ষিত না থাকায় হারিয়ে যেতে বসেছে শহিদদের ইতিহাস। 

সম্প্রতি রংপুরে একাত্তরের শহিদদের স্মৃতিবিজড়িত কয়েকটি বধ্যভূমি সংস্কার করা হয়েছে। তবে সেগুলোর নেই যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও স্মৃতি সংরক্ষণ। 

প্রশাসন বলছে, অনেক বধ্যভূমি ও গণকবর নতুন করে সংস্কার ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে বাকি বধ্যভূমিরগুলোর কাজও করা হবে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, রংপুরের কয়েকটি বধ্যভূমি ময়লা-আবর্জনার স্তূপে ঢাকা। নেই যাতায়াতের রাস্তা। নির্দিষ্ট দুই একটি দিন ছাড়া সারা বছরই বধ্যভূমিগুলোর কেউ কোনো খোঁজ খবর নেন না। দেখাশুনার লোক না থাকায় কোথাও কোথাও বধ্যভূমি দখলে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। আবার হঠাৎ দেখে বোঝার উপায় নেই কোনটা বধ্যভূমি আর কোন জায়গায় রয়েছে গণকবর।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুরে ছোট-বড় অনেক বধ্যভূমি থাকলেও জেলা প্রশাসন থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৩টি চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো হলো- রংপুর টাউন হল, দখিগঞ্জ শ্মশান, সাহেবগঞ্জ, দমদমা, বালার খাইল, নব্দীগঞ্জ, লাহিড়ীরহাট, ঘাঘট নদী, নিসবেতগঞ্জ, জাফরগঞ্জ ব্রিজ, বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ার বিল ও পদ্মপুকুর এবং মিঠাপুকুর উপজেলার জয়রাম আনোয়ারা বধ্যভূমি। এছাড়াও জানা-অজানার মধ্যে রয়েছে মডার্ন সিনেমা হল, নারিরহাট, শংকরদহ, বৈরাগীগঞ্জ, বলদিপুকুর, দেবীপুর, শিবগঞ্জ এলাকা বধ্যভূমি এবং রংপুর সেনানিবাস গণকবর।

এসব বধ্যভূমির মধ্যে কয়েকটি বধ্যভূমি এখনও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়নি। আর যেগুলোর সংরক্ষণ দৃশ্যমান সেগুলোতে সংক্ষিপ্ত আকারে ইতিহাস দেয়ালিকায় লিপিবদ্ধ করা হলেও শায়িত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মজীবনী তুলে ধরা হয়নি। ফলে বধ্যভূমিতে শায়িতদের ইতিহাস তো দূরের কথা! স্মৃতিচিহ্ন কেনো ধরে রাখা হয়েছে সেটিও অজানাই থাকছে অনেকের কাছে।

যেমন, ১৯১৩ সালে নির্মিত রংপুর অঞ্চলের সাংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ চর্চার প্রাণ কেন্দ্র রংপুর টাউনহল ছিল ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরা শত শত নারী ও পুরুষকে এখানে ধরে এনে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করতো। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মুক্তির আনন্দে উদ্বেল শত শত মানুষ রংপুর টাউন হল থেকে নির্যাতনের শিকার নাম না জানা প্রায় ৫০ জন নারীকে উদ্ধার করে।

তখন রংপুর টাউনহলের উওর দিকে পাওয়া যায় অগণিত বিকৃত মৃতদেহ। নির্যাতিত বীরঙ্গনাদের ছিন্ন বস্ত্র, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত অস্ত্র বুলেটের খোসা। অনেকে তাদের কষ্টের কথা নিজেদের রক্তমাখা আঙ্গুল দিয়ে টাউন হলেও ঘরের দেওয়ালে লিখে রেখেছিলেন।

গত বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে এই বধ্যভূমিটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করেছিলেন দুই যুবক। এই বধ্যভূমি সম্পর্কে সুমন নামের এক যুবককে প্রশ্ন করা হলে তিনি কিছুই জানেন না বলে উত্তর দেন। বলেন, ‘স্যার আমাদের পরিষ্কার করতে বলেছেন তাই করছি।’ 

আলামিন নামের আরেক যুবককে বধ্যভূমিতে কারা শুয়ে আছে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, ‘এখানে মানুষের কবর আছে শুনেছি কিন্তু তারা কারা তা জানি না।’ 

রংপুর শহর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে দমদমা ব্রিজের পাশের একটি বধ্যভূমি ইতিহাসের স্মারক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ কারমাইকেল কলেজের ৬ জন অধ্যাপককে পাক হানাদার বাহিনী ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে সেখানে একটি বধ্যভূমি নির্মিত হলেও দিবস কেন্দ্রিক চলে সেখানে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা। 

স্থানীয়দের দাবি বধ্যভূমিতে শায়িত অধ্যাপকদের অতীত স্মৃতি ও তাদের ছবি সংরক্ষণ করা গেলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রাণ পেত এই বধ্যভূমির ইতিহাস।

রংপুর সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বলরাম মহন্ত বলেন, ‘১৯৭১ সালে এ দেশকে পাকিস্তানি পাক হানাদারদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ হয়েছিলো। সেই যুদ্ধের ইতিহাস পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার নানা উদ্যোগ সরকারসহ মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় নিয়েছে। কিন্ত সেই সময়ে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাসহ গণহত্যার শিকার যারা হয়েছেন তাদের ইতিহাস সঠিক ভাবে সংরক্ষণ অনেকাংশে করা হয়নি। এমনকি গণকবরগুলোর ইতিহাস এবং শায়িত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মজীবনীও ঠিকমতো তুলো ধরা হয়নি। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আমাদের চাওয়া ৭১’র বধ্যভূমিগুলোর সঠিক ইতিহাস নাম ফলক আকারে সংরক্ষণ করা হোক। আর এটি করা হলে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বধ্যভূমিরগুলোর সঠিক ইতিহাস শ্রদ্ধার সঙ্গে রয়ে যাবে।’

রংপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানানোর জন্য বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা জরুরি। সরকারের উচিত এমনভাবে বধ্যভূমিগুলোকে সংরক্ষণ করা এবং ফুটিয়ে তোলা, যাতে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বেঁচে থাকে। তানাহলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতা সংগ্রামের কষ্ট-অর্জন অজানা থেকে যাবে।‘ 

রংপুর জেলা প্রশাসক ড. চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, ‘রংপুরে আমি নতুন যোগদান করেছি। বধ্যভূমিগুলোর কি অবস্থা সেটি আমাকে দেখতে হবে এবং বিস্তারিত জানতে হবে। তবে বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ ও স্মৃতি ফলকের কাজ চলমান আছে। এছাড়াও বধ্যভূমির সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেখানে শায়িত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা সংরক্ষণ এবং তাদের আত্মজীবনী স্মৃতি হিসেবে রাখতে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে কাজ চলমান রয়েছে।’

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়