ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মুক্তিযোদ্ধা ‘টাইগার লোকমান’র অন্যরকম যুদ্ধ 

জাহিদুল হক চন্দন, মানিকগঞ্জ  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৩, ১৫ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১১:২৮, ১৫ মার্চ ২০২৩
মুক্তিযোদ্ধা ‘টাইগার লোকমান’র অন্যরকম যুদ্ধ 

মানিকগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে ঘিওর উপজেলার আশাপুর গ্রাম। গ্রামের কালীগঙ্গা নদীর তীরে মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেনের বাড়ি। নয় শতক বসতভিটার ওপর ছোট্ট বাড়িতে থাকার ঘর মাত্র দুটি। একটিতে ছেলে, ছেলেবউ ও নাতি থাকেন। অন্যটিতে লোকমান হোসেন স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন। এই শোবার ঘরেই লোকমান গড়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের ছবির সংগ্রহশালা। 

২০০৯ সালে লোকমান হোসেন জেলার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধার ছবি দিয়ে সংগ্রহশালাটি গড়ে তোলেন। সংগ্রহশালায় রয়েছে তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার ছবি। যাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ জীবিত নেই।

মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেখতে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিককর্মীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ আসেন। স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাসে লোকমানের বাড়িতে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ে। 

সরেজমিনে সংগ্রহশালায় গিয়ে দেখা যায়, যুদ্ধকালীন যাঁরা শহীদ হয়েছেন এবং যাঁরা পরে মৃত্যুবরণ করেছেন এবং যাঁরা জীবিত আছেন, সেসব বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি সংগ্রহশালায় রয়েছে। ঘরের ভেতর টিনের বেড়ায় ছবিগুলো সযত্নে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। 

লোকমান হোসেন শুধু সংগ্রহশালা করে দায়িত্ব শেষ করেননি, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটে বেড়ান। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বীরত্বগাথা শোনান। 

১৯৬৫ সালে লোকমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে জওয়ান হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে দুই মাসের ছুটিতে বাড়ি আসেন। ২৮ মার্চ কর্মস্থলে ফেরার কথা থাকলেও তিনি থেকে যান এলাকাতেই। এরপর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ২২ জুন তিনিসহ ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা প্রথম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে পাঁচটি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তিনি। 

জেলার সবচেয়ে বড় গোলাইডাঙ্গা যুদ্ধে লোকমান হোসেন নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ যুদ্ধে তাঁর অসীম সাহসিকতায় ৮৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধে এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সহযোদ্ধারা তাঁকে ‘টাইগার’ উপাধি দেন। আজও তিনি এলাকায় ‘টাইগার লোকমান’ নামে পরিচিত।

লোকমান হোসেন জানান, শুরুতে পরিচিত সব মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে ছবি সংগ্রহ করতে শুরু করেন তিনি। এ জন্য তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি সংগ্রহ করা তাঁর জন্য ছিল সবচেয়ে কঠিন। তবে হাল ছাড়েননি তিনি। দূর-দূরান্তে পায়ে হেঁটে গিয়েও ছবি সংগ্রহ করে এনেছেন তিনি। অনেক সময় পাসপোর্ট সাইজের ছবি এনে নিজের টাকায় সেগুলো ল্যাবে নিয়ে বড় আকারে তৈরি করতে হয়েছে। এরপর সেগুলো যাতে সহজে নষ্ট না হয় এজন্য লেমিনেটিং করেছেন। এখনো তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। 

সংগ্রহশালা প্রসঙ্গে লোকমান হোসেন বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা চিরকাল বেঁচে থাকবেন না। যখন কোনো মুক্তিযোদ্ধা জীবিত থাকবেন না, তখন নতুন প্রজন্ম এই সংগ্রহশালায় এসে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে পারবে। এ জন্যই এটি আমি করেছি। 

সংগ্রহশালাটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়াই লোকমান হোসেনের স্বপ্ন। তিনি বলেন, নিজ জেলার সব মুক্তিযোদ্ধা, যুদ্ধের স্থানসহ ইতিহাস সংরক্ষিত রাখার চেষ্টা করছি। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে এবং তাদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে ৩০টিরও বেশি স্কুল ও কলেজে গিয়েছি। তাদের সেই সময়ের ঘটনার গল্প বলেছি। 

আঞ্চলিক কমান্ডার তোবারক হোসেন ওরফে লুডুর অধীনে মুক্তিযুদ্ধ করেন লোকমান হোসেন। জেলা সংসদের সাবেক এই কমান্ডার বলেন, মুক্তিযুদ্ধে লোকমানের ছিল সাহসী ভূমিকা। তিনি আজও সেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে স্কুল-কলেজে যাচ্ছেন। বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবির সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন।

অনন্য দেশপ্রেমীক লোকমান হোসেনের যুদ্ধ আজও শেষ হয়নি বলে মনে করেন তোবারক হোসেন। 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়