ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সংস্কারের অভাবে জীর্ণ ৫৪৪ বছরের বাবা আদম মসজিদ

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৬, ১০ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৬:২১, ১০ এপ্রিল ২০২৩
সংস্কারের অভাবে জীর্ণ ৫৪৪ বছরের বাবা আদম মসজিদ

বাবা আদম মসজিদ

আরব দেশে জন্মগ্রহণ করেও ইসলাম ধর্ম প্রচারে ভারতবর্ষে এসেছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক বাবা আদম। উপমহাদেশে সেন শাসনামলে ১১৫২ সালে ধলেশ্বরীর তীরে মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমে আসেন তিনি। তখন বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জ ছিল বল্লাল সেনের রাজত্বে। ওই বছরই বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় তাঁকে। শহীদ বাবা আদমকে মিরকাদিমের দরগাবাড়িতে দাফনের পর তাঁর মাজারের পাশে ১৪৭৯ সালে নির্মাণ করা হয় বাবা আদম মসজিদ। এটি ছিল তাঁর মৃত্যুর ৩১৯ বছর পরের ঘটনা। সেই থেকে ৫8৪ বছর ধরে ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে এই মসজিদটি। কিন্তু মুসলিম ঐতিহ্যের চোখজুড়ানো এই শৈল্পিক স্থাপনার গায়ে এখন শুধুই অযত্ন-অবহেলার ছাপ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান,বাবা আদম ছিলেন একজন সুফি সাধক। ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর স্মৃতিবিজড়িত শহর তায়েফে ১০৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আধ্যাত্মিক জ্ঞান সাধনায় বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর সাহচর্য পেতে ইরাকের বাগদাদে যান তিনি। ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ১১৫২ সালে ১২ জন আউলিয়া নিয়ে মিরকাদিম পৌরসভার দরগাবাড়ি এলাকায় আসেন। ১১৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের রাজা বল্লাল সেনের হাতে প্রাণ দিতে হয় এই সুফি সাধককে।

আরো পড়ুন:

বাবা আদম শহিদ হওয়ার প্রায় ৩০০ বছর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ১৪৭৯ সালে বাংলার সুলতান জালাল উদ্দিন আবু জাফর শাহের ছেলে মালিক কাফুর শাহ ছয়গম্বুজ বিশিষ্ট একটি কারুকার্য খচিত নয়নাভিরাম মসজিদ নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৪৮৩ সালে মসজিদটির নির্মাণ শেষ হয়। এরপর থেকে এখানে নামাজ আদায় করছেন মুসল্লিরা। তবে বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঐতিহাসিক মসজিদটির এখন জীর্ণ দশা। স্থানীয়দের দাবি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উচিৎ দ্রুত মসজিদটির সংরক্ষণ করা।

শাহ হুমায়ুন কবির ‘The Battle of Kanai Changue’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১১৫২ খ্রিস্টাব্দে মুন্সীগঞ্জ সদরের প্রাচীন রামপালনগরে ধর্ম প্রচারের জন্য বাবা আদম শহার আগমন হয়। তিনি বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের কপালদুয়ার, মানিকেশ্বর ও ধীপুরে তিনটি খানকাহ নির্মাণ করে ইসলাম প্রচার শুরু করেন।

স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি রয়েছে, রাজা বল্লাল সেন ছিলেন অত্যন্ত অত্যাচারী শাসক। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বশবর্তী হয়ে স্থানীয় মসজিদে আজান দেওয়া ও গরু জবাই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন বল্লাল সেন। কিন্তু বাবা আদম বিচলিত হননি। তিনি বল্লাল সেনের শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। পরে বল্লাল সেনের বিরুদ্ধে ১১৭৮ সালে বিক্রমপুরের কালাইচং ময়দানে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন তিনি। সেই যুদ্ধ টানা ১৫ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। যুদ্ধের প্রথম ১৪ দিন জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়নি। যুদ্ধের শেষ দিন রাজা বল্লাল সেন নিজে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সেই যুদ্ধে বল্লাল সেন পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা করেন। তিনি বিপুল মুসলমান ধর্মের বিশাল বাহিনী দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যান এবং যুদ্ধে পরাজয়ের আশঙ্কায় বল্লাল সেন ২০ সেপ্টেম্বর বাবা আদম শহীদকে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব করেন। বাবা আদম শহীদও সরল বিশ্বাসে রাজা বল্লাল সেনের দেওয়া যুদ্ধ বিরতির সেই প্রস্তাব মেনে নেন। দরগাহ বাড়ি এলাকায় রাতে এশার নামাজের পর বাবা আদম শহীদকে রাজা বল্লাল সেন হত্যা করেন।

বাবা আদম মসজিদের (খতিব) মাওলানা মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘প্রায় ৫৪৪ বছর আগে মুন্সীগঞ্জ সদরের দরগাবাড়ি এলাকায় অবস্থিত বাবা আদম মসজিদটি ১৪৮৩ সালে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মালিক কাফুর নির্মাণ করেন। বাবা আদমকে মিরকাদিমের দরগাবাড়িতে দাফনের পর তার মাজারের পাশে নির্মাণ করা হয় এই মসজিদটি। এটি ছিল তার মৃত্যুর ৩১৯ বছর পরের ঘটনা।

ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদের নির্মাণশৈলী মনোমুগ্ধকর। মসজিদটির দৈর্ঘ্যে ৪৩ ফুট ও প্রস্থে ৩৬ ফুট। দেওয়াল প্রায় চার ফুট চওড়া। ভেতরে ইট-সুরকির গাঁথুনি। নির্মাণ নকশা বা স্থাপত্যকলা অনুযায়ী মসজিদ ভবনটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। সম্মুখের দিকে খিলান আকৃতির প্রবেশপথ। দুই পাশে সম আকারের দুটি জানালা। মসজিদের সামনে ওপরের দিকে রয়েছে ফারসি ভাষায় খোদাই করা কালো পাথরের ফলক।

মসজিদের ভেতরে ঢুকে সামনে গেলে দেখা মেলে চার কোনায় চারটি ত্রিভুজাকৃতির স্তম্ভ। মসজিদের খিলান, দরজা, স্তম্ভের পাদদেশ, মেঝে ও ছাদের কার্নিশের নিচে ইট কেটে মুসলিম স্থাপত্যকলার অপূর্ব নকশাও লক্ষ করা যায়।

বাবা আদম মসজিদ কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন রেনু বলেন, বাবা আদমের নামে নির্মিত এ মসজিদটি দেখতে বছরজুড়ে দরগাবাড়িতে দেশ-বিদেশে থেকে পর্যটক ও দর্শনার্থীরা আসেন। তবে পর্যটকদের আকর্ষণ ধরে রাখা কিংবা কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে টিকে থাকা এ স্থাপনাটি সংরক্ষণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উচিৎ দ্রুত মসজিদটি মেরামত ও সংরক্ষণ করা।

বাবা আদম মসজিদ কমিটির সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন খান বলেন, ৫৪৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটি সংস্কারের অভাবে এর ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। 

বাবা আদম মসজিদের মোয়াজ্জেম হাফিজ মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম জানান, এ মসজিদে দূর দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে আসেন। কিন্তু বৃষ্টি হলে মসজিদের ছাদ দিয়ে চুইয়ে পানি পরে ভেতরের মেঝে নষ্ট হয়ে যায়। মুসল্লিদের নামাজ আদায় করতে কষ্ট হয়। মসজিদ সীমানার রেলিংয়ে মরিচা ধরে সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেওয়ালের ইট খসে পড়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি তারা যেন দ্রুত এ মসজিদটি মেরামত ও সংরক্ষন করেন।

মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে চার কিলোমিটার পথ পেরুলেই বাবা আদম মসজিদ। রাজধানী ঢাকার জিরো পয়েন্ট থেকে সড়কপথে মসজিদের দূরত্ব মাত্র ২৮ কিলোমিটার। ঢাকার সদরঘাট থেকে নৌপথে মিরকাদিম লঞ্চঘাটে নামার পর আধা কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করলেই এই মসজিদটিতে আসা যাবে।

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়