ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নিষেধাজ্ঞায় বেকার জেলেরা, মেলেনি সহায়তা

ইমরান হোসেন, বরগুনা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ৩ জুন ২০২৩  
নিষেধাজ্ঞায় বেকার জেলেরা, মেলেনি সহায়তা

মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, উৎপাদন ও সংরক্ষণে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের জন্য সাগরে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে সাগরে টহল দিচ্ছে মৎস্য বিভাগ, নৌ বাহিনী, নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ড। কিন্তু এই সময়ে বরগুনা উপকূলের জেলে পরিবারগুলো এখন বেকার সময় পার করছেন। জেলেদের দাবি, জরুরি খাদ্য সহায়তা না দেওয়ায় অর্ধাহার-অনাহারে দিন কাটছে তাদের।

শনিবার (৩ জুন) বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া এলাকার জেলে পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে জেলে পরিবারগুলো।

কাকচিড়া লঞ্চ ঘাট এলাকার বাসিন্দা জেলে রাসেল ফকির (৪৯)। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন তিনি। শুধু খাদ্য সংকট নয়, রাসেল ফকিরের মেয়ে কাকচিড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী ইশরাত জাহান ও একই বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ইমামুজ্জামানের লেখা পড়ার খরচ বহন করতে পারছেন না তিনি।

রাসেল ফকির রাইজিংবিডিকে বলেন, “একই এলাকার ‘এফবি আরিফ-১’ ট্রলারের জেলে আমি। সাগরে মাছ শিকার করেই চলে আমার সংসার। নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার আগের দিন ১৯ মে রাতে গভীর বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ শিকার করে আমিসহ ট্রলারের ১৮ জেলে তীরে ফিরি। ঘাটে এসে দুই লাখ ৩৪ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করি আমরা। তবে, সাগরে মাছ শিকার করতে যাওয়ার সময় ট্রলারের জ্বালানি ও জেলেদের খাবারেই ব্যয় হয়েছে দেড় লাখ টাকার বেশি। জাল-দড়ি ট্রলার মালিককে বুঝিয়ে দিলে তিন হাজার টাকা করে ট্রলারের মালিক আমাদের হাতে দেন।” 

তিনি আরও বলেন, ‘তিন হাজার টাকা দিয়ে মুদি দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনি। ছেলে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে সব টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। এখন ঘরে আর কোনো খাবার নেই। ধারদেনা করে কোনোভাবে সংসার চালাতে হচ্ছে। জরুরীভাবে সরকার খাদ্য সহায়তা না দিলে অনাহারেই থাকতে হবে আমাদের।’

একই এলাকার জেলে রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘সাগরে মাছ কম ধরা পড়ায় ট্রলার মালিকরাই গত এক বছর ধরে লোকসানের মুখে আছেস। তাই জেলেরাও ভালো মজুরি পাচ্ছেন না। এর মধ্যে সরকার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার জন্য সরকার চাল বরাদ্দ দিয়ে থাকে প্রতি বছর। তবে সেই বরাদ্দ দেওয়া হয় নিষেধাজ্ঞার শেষ হওয়ার আগ মুহূর্তে। তখন এই সহায়তা কোনো কাজেই আসে না। সরকার যেহেতু বরাদ্দ দিচ্ছে তাই সহায়তা নিষেধাজ্ঞা শুরুর প্রথম দিকে দিলে জেলেরা উপকৃত হবেন।’

বরগুনের সদর উপজেলার গুলিসাখালি এলাকার ‘এফ বি হাইরাজ’ ট্রলারের মাঝিমাল্লারা বলেন, সরকার খাদ্য সহায়তা দেয় ঠিকই, তাদের জেলে কার্ড আছে। কিন্তু তারপরেও সরকারি সহায়তা পান না তারা। সাগরে একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় অসহায় হয়ে পড়েছেন বরগুনা উপকূলের জেলেরা। 

জেলে রফিক উল আলম বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই সাগরে মাছ শিকারে অভ্যস্ত। তাই অন্য কোনো পেশার কাজ আমরা পারি না। এ ছাড়া কেউ কোনো কাজ দিতেও চাচ্ছে না আমাদের। তাই নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে পরিবার নিয়ে খুব খারাপ অবস্থায় আছি আমরা।’ 

ফুলঝুড়ি এলাকার জেলে জালাল মিয়া বলেন, ‘আমরা মাছের উপরেই নির্ভরশীল। সাগরে কম-বেশি মাছ পাই। সেই মাছ বিক্রি করে ট্রলার মালিক আমাদের অন্তত খাবারের টাকা দিয়ে থাকেন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমাদের পাশে কেউ থাকে না।’

বাংলাদেশ মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এমনিতেই বিপাকে পড়েছেন ট্রলার মালিকরা। তার মধ্যে একের পর এক নিষেধাজ্ঞায় ফকির হতে চলেছেন মৎস্য পেশায় জড়িত সবাই। সরকারের উচিত নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আরো ভালোভাবে গবেষণা করা। নয়তো জেলেরা বাধ্য হয়ে পেশা ত্যাগ করবেন।’

বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘৪৭ হাজার জেলের অনুকূলে চাল সহায়তা দেওয়া হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে বরাদ্দের চাল চলে আসবে। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলেদের হাতে সহায়তা পৌঁছানো হবে। অনেক জেলেরা বিগত দিনে ইউপি সদস্য ও ইউপি চেয়ারম্যানদের গাফিলতি ও খাম খেয়ালির কারণে চাল সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এবার মৎস্য বিভাগ ও জেলা প্রশাসন সহায়তার বিষয়টি পুরোপুরিভাবে মনিটরিং করবে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘সহায়তা নিয়ে কোনো অনিয়ম হলে দোষীদের বিরুদ্ধে সরকার বাদী হয়ে মামলা করবে।’

মাসুদ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়